তার নাড়ি দ্রুত হলো, চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, পাকস্থলীর ভেতরে প্রজাপতি উড়তে শুরু করল; যখন সে কাছে এসেছে…। সে মনোযোগ দিতে পারে না, তবে খেয়ালও করে না।
সে উচ্ছল, মাথা ঝিমঝিম করছে তার, আনন্দে উৎফুল্ল। একে কি প্রেম বলে?
‘ঠিক তা নয়, তবে হতে পারে এটি সূচনা।’ হুস্টনে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস স্কুল অব পাবলিক হেলথের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ইমেরিটাস ব্লেয়ার জাসটিস বলেন, এই আচরণ প্রেম বা ভালোবাসার সূচনা পর্যায়ে হয় সচরাচর, একে বলে ‘প্রেমের মোহে পড়া’।
অন্ধ প্রেমেও নাকি এমন হয়। ‘ভালোবাসা কীভাবে আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে’—এ সম্পর্কে পাঁচটি পুরস্কার বিজয়ী বই লিখে খ্যাত ব্লেয়ার জাসটিস। ভালোবাসা সম্পর্কে আমাদের দেশেও কবি-সাহিত্যিক কত পদ্য ও গদ্য রচনা করেছেন, এ সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসাও কম নয়। ‘ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলই যাতনাময়’—এমন অভিজ্ঞতাও আছে অনেকের। ভালোবাসা নিয়ে মজার কথাও আছে: ১৯৮৮ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা রোমান্টিক প্রেমের তিনটি রকমফেরও করেছেন। অন্তরঙ্গতা, দায়বদ্ধতা, প্রতিশ্রুতি, প্যাশন—সব উপকরণ মিলিয়েই রোমান্টিক প্রেম।
ভালোবাসা যখন গবেষণাগারে
কী ধরনের ভালোবাসার অভিজ্ঞতা হবে, তা বড় কথা নয়, ভালোবাসা না থাকার চেয়ে ভালোবাসা থাকা ভালো, তা বড় হিতকরী।
এর মূলে রয়েছে রসায়নের খেলা: শরীরের ওপর এর হিতকরী প্রভাব কম নয়। অনুরাগ ও আসক্তি মগজের রসায়নের মূলে নিহিত।
তেমন একটি রাসায়নিক হলো এনডোর্ফিন। ১৯৭৫ সালে প্রথম আবিষ্কৃত এই রাসায়নিকটি দেহ প্রতিরোধব্যবস্থা উন্নত করে, ব্যথা উপশম করে, চাপ প্রশমিত করে, বার্ধক্যের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করে। এনডোর্ফিন হর্ষোৎফুল্ল করে আমাদের। ব্যায়াম ও শরীরচর্চা আরও উদ্দীপিত করে এনডোর্ফিন নিঃসরণ। এমনকি দূরপাল্লার দৌড়ে এনডোর্ফিনের জন্য ব্যথা ও অবসন্নতা বোধ ঘটে না, বরং দৌড়ের শেষে নিজেকে মনে হয় নমনীয় ও শক্তিমান।
যখন ভালোবাসা ও এনডোর্ফিন নিঃসরণ উদ্দীপ্ত করে
ভালোবাসার উষ্ণ যন্ত্রণা বরং শক্তি দেয় মানুষকে।
এনডোর্ফিন তীব্রতর হয়; আরও রাসায়নিক ক্রমে চড়া হয়ে ওঠে, আসে আমোদ উৎপাদক হরমোন রাসায়নিক ‘ডোপামিন’ ও নরইপিনেফ্রিন, এই নিউরোট্রান্সমিটারটি ইতিবাচক প্রণোদনার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ‘রোমাঞ্চকর ধেয়ে আসা’ কারও জন্য হয় হিতকরী, কাউকে করে বড় উদ্দীপ্ত; কেউ কেউ ভালোবাসাতে হয় আসক্ত।
সিক্রেটস অব দ্য সুপার ইয়ং বইটি লিখে খ্যাত নিউরোসাইকোলজিস্ট ডেভিড উইকস বলেন, জীবনসঙ্গী যাঁরা ঘন-ভালোবাসা করেন প্রায়শ; তাঁদের আয়ু বেশ বাড়ে।
কেবল ঘনিষ্ঠ ভালোবাসা নয়, দৈহিক সংস্পর্শ, নিঃসৃত করে এনডোর্ফিন; যেমন, হরমোন অক্সিটোসিনও। মানুষের মধ্যে বন্ধন স্থাপনে অক্সিটোসিনের ভূমিকা অনন্য। এই দুটো রাসায়নিক প্রাকৃতিক আফিমের মতো কাজ করে; নেশা ধরায় মনে, আসক্তি টানে, সুস্থিত করে রোমান্টিক সম্পর্ক—বলেন ডা. মাইকেল ওডেন্ট।
অন্তরঙ্গ স্পর্শ, যেমন, হাতে হাত ধরা, হাত ধরে হাঁটা, প্রেমিকের গালে টোকা দেওয়া—এমন আন্তরিক ভালোবাসা শরীরে রোগ প্রতিরোধ অ্যান্টিবডি বাড়ায়; গ্রোথ হরমোনকে প্রণোদিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতাল-নার্সারিতে অপরিণত শিশুদের নার্সরা বুকে ধরে গালে টোকা দিলে গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ বাড়ে—এই ফলাফল অনেক হাসপাতালকে ‘স্পর্শ করা চর্চা’ চালু করতে উৎসাহিত করেছে, যাতে নিওন্যাটাল নার্সারিতে শিশুরা বেড়ে ওঠে সহজে। বিখ্যাত হূদেরাগ বিজ্ঞানী ডিন অরনিশ লিখেছেন, আমাদের অসুস্থ হওয়া ও ভালো থাকা, আমাদের বিষণ্ন হওয়া, আমাদের সুখী হওয়া—এসব কিছুর মূলে রয়েছে ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গতা, আমাদের রোগভোগ ও নিরাময় এসবের মূলেও রয়েছে এই দুটো জিনিস। রোগীর হূদ্যন্ত্র ও রক্তনালির স্বাস্থ্যের ওপর খাদ্য, ধূমপান, বংশগতি ও ব্যায়ামের যেমন প্রভাব, ভালোবাসারও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব।
ক্যালিফোর্নিয়ার ইনস্টিটিউট অব হার্টম্যাথের গবেষকেরা ইদানীং দেখেছেন, মগজের মতো হূদ্যন্ত্রও ইমোশনের মুখোমুখি হলে উৎপন্ন করে হরমোন। ভালোবাসা, প্রেমের প্রভাবে খুব ছন্দময়, সংগতিপূর্ণ হূৎস্পন্দন ঘটে, অথচ নেতিবাচক ইমোশন জন্ম দেয় এলোমেলো স্পন্দন। জীবনসঙ্গীদের মধ্যে প্রেমঘন ভালোবাসা অনেক রোগ প্রতিরোধ করে, দীর্ঘায়ু করে দম্পতিকে। যাঁদের মা-বাবার সঙ্গে মধুর সম্পর্ক, তাঁদের হূদেরাগ হয় অনেক কম।
দার্শনিক ব্যাখ্যা বাদ দিলেও এর একটি প্রায়োগিক ব্যাখ্যাও আছে। একা জীবনযাপনে অভ্যস্ত যাঁরা, তাঁদের চেয়ে অনেক সুবিধায় থাকেন দম্পতিরা। যেমন, বিবাহিত পুরুষের কথা যদি বলি—স্ত্রীরা সুষম আহার পরিকল্পনা করেন, অনেকে রান্না করেন, চিকিৎসকের কাছে যেতে স্বামীদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং জোরও খাটান। বিবাহিত জীবন যেমন—প্রেমঘন, তেমনি নিরাপদ ও রুচিশীলও বটে। মূলকথা যা শাশ্বত; ভালোবাসার শক্তি স্বাস্থ্যকুশল বাড়ায়।
ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে এমন সংকল্প হোক সবার, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, এই সুরে, কাছে দূরে জলে স্থলে সর্বত্র।’
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১২
Narayan adhikary
দারুন একটা তথ্য দিলেন। এবার মনে হয় প্রেমে পড়বই।
Bangla Health
এভাবে জেনে শুনে কি কেউ বিষ পান করে? 🙂
Narayan adhikary
ঠিক বুঝলাম না। দয়া করে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিন
Bangla Health
রবীন্দ্রনাথ বলেন, প্রেমে পড়া মানে হলো জেনেশুনে বিষ পান করা।
আপনার সাথে একটু মজা করা হয়েছে।