৯ জানুয়ারি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন: সমস্যা ও সম্ভাবনাবিষয়ে স্বাস্থ্যকুশলের উদ্যোগে গোলটেবিলবৈঠকের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সহযোগিতায় আয়োজিত সেই গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনার সারসংক্ষেপ নিয়েই এবারের স্বাস্থ্যকুশল।
যাঁরা অংশ নিলেন
অধ্যাপক এ কে আজাদ খান
সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।
অধ্যাপক হারুন-উর রশিদ
সভাপতি, সোসাইটি অব অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট।
অধ্যাপক আবু সুফী আহমেদ আমিন
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল।
অধ্যাপক কামরুল হাসান খান
সভাপতি, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ও সহসভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন
অধ্যাপক আবুল মনসুর
প্রকল্প পরিচালক, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিট, বাডাস।
অধ্যাপক মির্জা মাহবুবুল হাসান
ইউরোলজি বিভাগ, বারডেম।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী
হেপাটোবিলিয়ারি-প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি, বারডেম।
অধ্যাপক এম এ সালাম
ইউরোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ।
অধ্যাপক রফিকুল আলম
চেয়ারম্যান, নেফ্রলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ।
ডা. এ এম শামীম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাবএইড।
তুলসী রানী বণিক
ভুক্তভোগী রোগীর পরিবারের সদস্য।
সঞ্চালক
ডা. তানজিনা হোসেন
এবং
আব্দুলকাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো।
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে ‘বাংলাদেশে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং সমস্যা ও সম্ভাবনা’। এ বিষয়ে আমি শুধু এটুকু বলব, একটা সময় ছিল যে বাংলাদেশে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যাবে, এ কথা আমরা কেউ ভাবতামও না, বিশ্বাসও করতাম না। গত কয়েক বছরে এই বিভাগ অনেকখানি এগিয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতাল হয়েছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও হয়েছে। এটি একটি আশার দিক—ভারত ও অন্যান্য দেশের মতো মানসম্মত চিকিত্সা এ দেশেও সম্ভব হচ্ছে। এখন সাধারণ মানুষ আর বাইরে যায় না, এমনকি উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষও এখানে চিকিত্সা করানোর মতো আস্থা রাখতে পারছে। এমনকি আমি শুনেছি, ভুটান থেকে এখানে মানুষ চিকিত্সার জন্য আসে।
তা হলে বলা যেতে পারে, এ বিষয় আমরা অনেকখানি এগিয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, কিছুদিন আগে অভিযোগ আসে, কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়ে এক ধরনের বাণিজ্যিক প্রতারণা চলছে এবং টাকার বিনিময়ে কাউকে কিডনি বিক্রয়ে বাধ্য করা হচ্ছে। এভাবে একটা সংবাদ বের হয় এবং সে সংবাদের সূত্র ধরে এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যাতে চিকিত্সক-রোগী-কিডনিদাতা সবাই এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে পড়ে। ফলে এই চিকিত্সাটি অনেকটা থমকে আছে। এর ফল হয়েছে যাদের সংগতি আছে, তারা চিকিত্সার জন্য বাইরে যাচ্ছে; যাদের সংগতি নেই, তারা চিকিত্সাহীনতায় ভুগছে। বিষয়টি পত্রপত্রিকায় এসেছে। এখন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, এখানে কী করা উচিত। বিভিন্ন দেশে তো চিকিত্সা হচ্ছে, সেখানে যদি সমস্যা না হয়, তাহলে আমাদের দেশে সমস্যা কিসের? আমরা যদি সমস্যাগুলো তুলে ধরে আলোচনা করি, তাহলে দেশের মানুষ উপকৃত হবে। সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের আলোচনা। এ বিষয়ে সামগ্রিক দিক নিয়ে আলোচনার জন্য অনুরোধ করছি অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে।
এ কে আজাদ খান
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন বর্তমান চিকিত্সাবিজ্ঞানে একটি বিস্ময়কর সাফল্য। এমন অনেক অসুখ আছে, যার পরিণতি একেবারে মৃত্যু, যেমন লিভার সিরোসিস হলে কিছুই করার নেই। তবে কিডনি যদি অকেজো হয়ে যায়, তাহলে ডায়ালাইসিস করে বাঁচিয়ে রাখা যায়। কিন্তু সেটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেখানে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করলে সে প্রায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে। এখন লিভার, কিডনি, বলতে গেলে, হার্টেরও প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম বাংলাদেশ। যেটার প্রতিস্থাপন এখনো নেই, সেটা হলো বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। পৃথিবীতে গবেষণা করে দেখা গেছে, কিডনিদাতাদের গড়পড়তা আয়ু যারা কিডনি দেয় না তাদের চেয়ে বেশি। তাহলে দাতাদের যদি আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহলে আরও বেশি মানুষকে আমরা সাহায্য করতে পারব। আরেকটি কথা হলো মরণোত্তর বা ক্যাডেবারিক প্রতিস্থাপন, এটা বাংলাদেশে এখনো শুরু হয়নি। তবে আমাদের শুরু করতে হবে। কারণ, লাইফ ডোনার সব সময় সীমিত হয়ে যাবে। অঙ্গদান করলে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। আবার মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাণিজ্যিকীকরণ তথা ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত থাকা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চিকিত্সকেরা করে থাকলেও অপরাধ। কাগজে যখন খবরটি এসেছিল, তখন চিকিত্সকদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা গেছে। আদালত বলেছেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ, আদালত তো ঠিকই বলেছেন। চিকিত্সকেরা করলেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর চিকিত্সকেরা করলে বিএমডিসির সেটা দেখা উচিত। জনসাধারণের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব তো বিএমডিসির। তাহলে আদালতের বলতে হবে কেন, তার আগেই তো বিএমডিসিকে বিষয়টি দেখতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসেছে। এখন বলবেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী।
মোহাম্মদ আলী
বাংলাদেশে কিডনি বা লিভার প্রতিস্থাপনে অনেক উন্নতি হয়েছে। এটা জীবন রক্ষাকারী চিকিত্সা-পদ্ধতি হিসেবে কাজ করছে কিন্তু একটা আইনি ভুল ব্যাখ্যার জন্যএই সাফল্যযাত্রা অঙ্কুরেই নষ্ট হতে বসেছে। কিসের জন্য নষ্ট হতে চলেছে? আইনটা সবার দেখা উচিত। আইনটাকে সূত্রবদ্ধ করে কীভাবে জাতীয় স্বার্থরক্ষা করা যায়, সেটা দেখার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি।
দ্বিতীয়ত হলো, আইনে আছে, সম্পর্কিত ব্যক্তি অঙ্গদান করতে পারবে, যেমন: ভাই-বোন, মামা-খালা, ফুফু ইত্যাদি। কিন্তু এর বাইরেও একটি বিধান থাকা উচিত, যেন একজন বন্ধু তার বন্ধুর জীবন রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে পারে। আপনারা শুনলে খুশি হবেন, জাপানে স্ত্রী বা স্বামীর দিকের আত্মীয়দের তৃতীয় মাত্রা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়। এসব বিষয় কাজ করছে আসলে অঙ্গদাতার অভাব। শত শত রোগী শেষ পর্যন্ত অঙ্গদাতার অভাবে মারা যাচ্ছে। অঙ্গদাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্যই স্বেচ্ছা প্রণোদিত অঙ্গদাতা, পরিবর্তিত অঙ্গদাতা, প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় মাত্রার আত্মীয় পর্যন্ত আনা হচ্ছে। সম্পর্কের বাইরে যেসব অঙ্গদাতা আছে, তার জন্য একটা নৈতিকতা কমিটি থাকবে, যারা অর্থের যোগসূত্রসহ অন্য বিষয়গুলো নিশ্চিত করবে, যাতে আমরা দাতাদের সংখ্যা বাড়াতে পারি। কিন্তু সংবাদটি এমনভাবে দেখানো হয়েছে, যাতে মনে হয়েছে চিকিত্সকেরা আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। এই দুর্নাম থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি করে নৈতিকতা কমিটি থাকা দরকার। জাপান, অস্ট্রেলিয়ার হাসপাতালগুলোতে এ রকম নৈতিকতা কমিটি আছে, যারা ছাড়পত্র দেওয়ার পরই কেবল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। নৈতিকতা কমিটিতে প্রতিস্থাপনের সঙ্গে জড়িত চিকিত্সকসহ অন্য কেউ অন্তর্ভুক্ত থাকবেন না। তা হলে বিষয়টি স্বচ্ছ হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
আপনি আইনের কথা বলেছেন, আইন নিয়ে কি কেউ আপত্তি করেছে বা বিষয়টি আনা হয়েছে আমাদের আইনপ্রণেতাদের কাছে, যে আইনটি পরিবর্তন করা উচিত?
মোহাম্মদ আলী
আইনটি নিয়ে গণমাধ্যমে বলেছি, আইনটি পরিষ্কার নয়। কে এই সম্পর্ক নির্ধারণ করবে, কীভাবে এই সম্পর্ক নির্ধারিত হবে, এটা এই আইনে নেই। এটা আমরা সব সময় গণমাধ্যমে বলে আসছি। এটা আমাদের একটি প্রধান আলোচ্য বিষয়।
মির্জা মাহাবুবুল হাসান
সম্ভাব্য অঙ্গদাতাদের মধ্যে যে সম্পর্কটা আছে, সেটা নির্ণয় কী করে হবে, কে করবে, সেটা খুব পরিষ্কার করে দিতে হবে। এটা একটা জরুরি ব্যাপার। বিষয়টি আমরা সরকারের গোচরে এনেছি। সরকারও বলেছে, নতুন করে উপবিধি, প্রবিধি করে একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, সম্পর্ক নির্ণয় কমিটিতে প্রতিস্থাপনের সঙ্গে জড়িত সদস্যদের কেউ থাকবেন না। সম্পূর্ণ আলাদা কমিটি এই সম্পর্ক নির্ণয় করবে। বিএসএমএমইউ ও জাতীয় কিডনি ইউরোলজিক্যাল ডিজিজেস সেন্টারসহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো কমিটি করে নেবে। কিন্তু যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতিস্থাপন করবে, তাদের বেলায় বোধ হয় নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সরকার একটি কমিটি করে দেবে। এখন একটা কথা বলা হচ্ছে যে প্রতিস্থাপন বন্ধ আছে। কথাটি ঠিক নয়। বিএসএমএমইউ জাতীয় কিডনি ইউরোলজিক্যাল ডিজিজেস সেন্টারে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। তাই রোগীদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে সরকারি প্রবিধির জন্য।
আব্দুল কাইয়ুম
আপনি যখন আলোচনা কিছুটা করেছেনই, আরেকটা বিষয় বলবেন কি, যারা দাতা, অধ্যাপক আজাদ যেটা বললেন, তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ? পত্রিকায় অবশ্য একটু বিভ্রান্তিকর খবর এসেছে। কিডনি যারা দিয়েছে, তাদের ভুল বুঝিয়ে আনা হয়েছে। এখন তারা সারা জীবন নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে ভুগছে। আসলে তারা কতটা নিরাপদ?
মির্জা মাহাবুবুল হাসান
যখন একজন দাতাকে কিডনি বিশেষজ্ঞ কিডনি দেওয়ার জন্য মূল্যায়ন করেন, তখন তার যাবতীয় পরীক্ষা করেন। পরীক্ষাগুলো হয় আন্তর্জাতিক মানের। কিছু ব্যত্যয় যে হয়নি, সে কথা বলছি না। হয়তো হয়েছে। এটা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় হতে পারে। কাউকে প্রতারণা করে এখানে আনা হয়েছে কি না, চিকিত্সকেরা সজ্ঞানে এটা করতে পারেন না। কেবল এক শ এক ভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই একজন অঙ্গদাতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিই।
আব্দুল কাইয়ুম
খবরটা হয়তো ভুল। কিন্তু এটা যে ভুল, সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত করতে পারি কি না। কোনো কোনো পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, একটা গ্রামের ১০ জনকে নেওয়া হয়েছিল এই কথা বলে যে তাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পরে তারা বছরের পর বছর অসুখ-বিসুখে ভুগছে, সারা জীবন তাদের এই বোঝা টানতে হবে। হয়তো খবরটি সত্য না-ও হতে পারে। এখন এ ব্যাপারে অধ্যাপক সালামের কাছ থেকে শুনি।
এম এ সালাম
অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে আমি একেবারে প্রথম থেকে জড়িত। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে একজন অবিবাহিত নারী কিংবা পুরুষ সামান্য একটি শাড়ি কিংবা লুঙ্গির জন্য ভ্যাসেকটমি অথবা টিউবেকটমি অপারেশনের সময় নানাভাবে প্রতারিত হয়েছেন। অতএব, এ দেশে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। এ বিষয় হয়তো কিছু কিছু জায়গার ব্যত্যয় ঘটেছে এবং যেটা সংবাদে এসেছে। এর কারণটা হলো, কিডনি গ্রহীতার সংখ্যা এত বেশি যে তার তুলনায় সরবরাহ একেবারেই কম। আমরা ভেবেছিলাম, আইন কাঠামো মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপনে উত্সাহ জোগাবে। কিন্তু ২০ বছর প্র্যাকটিস করেও দেখছি, সেখানে বিশেষ কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। আমি এ বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে বলতে চাই, এই একটা সুযোগ এসেছে, বিদ্যমান আইন, যেটা প্রতিপালন করে আমরা কিডনি প্রতিস্থাপন করে এসেছি, এর মধ্যেও অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যেসব রোগী শত চেষ্টার পরও আইসিইউতে, যাদের ব্রেন ডেথ ঘোষণা করে জীবন রক্ষাকারি ব্যবস্থা (লাইফ সাপোর্ট) বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, এই সব ব্যক্তি কিন্তু অঙ্গদাতা হতে পারে। এই অঙ্গগুলো সংগ্রহ করতে পারলে এ দেশে লিভার সংযোজন, কিডনি সংযোজন, হার্ট সংযোজন খুবই সহজ হয়ে যেত। আমরা শুধু কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা চিন্তা করি। আমরা কেন চিন্তা করছি না হার্ট প্রতিস্থাপন করা উচিত? কারণ, ভবিষ্যতের দুনিয়ায় প্রতিস্থাপন একটা বিরাট সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে, যাতে মানুষ দীর্ঘজীবী হতে পারে।
অনেক দেশে মৃতদেহ সরকারি সম্পত্তি হয়ে যায়। যদি কেউ আপত্তি করে, সেটা আলাদা কথা। আপনারা যদি জনসচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করেন, তাহলে অঙ্গ বিক্রি যে দণ্ডনীয় অপরাধ, সেটি বন্ধ হয়ে যাবে।
আমাদের বুঝতে হবে, এটি একটি মহত্ কাজ। এগুলো করতে হলে কতগুলো নিয়মনীতির মাধ্যমে করতে হবে। যে নিয়মনীতি আছে, তা যদি পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে হয়, তাহলে তা এখনই করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু, বিশেষ করে বাঙালি, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জীবন পর্যন্ত দিয়েছে; কিন্তু যখন অঙ্গদানের মতো বিষয় আসে, তখন কিন্তু সচেতনতার অভাবে সেটা ঠিকমতো হয় না। এটা কিন্তু সেই তুলনায় কিছুই নয়। এর মাধ্যমে যে আরেকজনের জীবনে নবজীবন দেওয়া সম্ভব, এই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অবার আইনটা হলেও তার পরও কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে। আইন এবং সচেতনতার বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের এখানে উপস্থিত আছেন একজন রোগীর আত্মীয়, তুলসী রানী বণিক। আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনি।
তুলসী রানী বণিক
আমার ভাইয়ের জীবনে ঝড়ের মতোই হঠাত্ করে এই সমস্যাটা দেখা দেয়। সে ডায়ালাইসিস করছে, ডায়ালাইসিসের একপর্যায়ে আমার মামা কিডনি দিতে আগ্রহী হন। আমরা মোটামুটি মানসিকভাবে প্রস্তুত, ঠিক তখনই গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। আমরা যখন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছি, ঠিক ওই সময়ই সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। আমরা চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি, একটা সুন্দর নীতির মাধ্যমে অতিসত্বর ব্যবস্থা নিলে আমাদের মতো পরিবারগুলো বেঁচে যেতে পারে।
আব্দুল কাইয়ুম
সমস্যা কী? আত্মীয় তো আইনত দিতে পারেন। আপত্তি কোথায়?
তুলসী রানী বণিক
এখন সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে হচ্ছে না। আমার বাবার ইচ্ছা, বারডেমে করবে। আমরা ওইভাবে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছিলাম। এখন তো বিভিন্ন কারণে হচ্ছে না। আশা করব, এটি যেন আবার চালু হয়।
আব্দুল কাইয়ুম
কী সমস্যা সৃষ্টি করেছে, আমরা শুনলাম। এখন আমি অনুরোধ করছি অধ্যাপক আবু সুফী আহমেদ আমিনকে কিছু বলার জন্য।
আবু সুফী আহমেদ আমিন
৫০ বছর আগে চিকিত্সকদের কী সম্মান ছিল, আর আজকের অবস্থা কী, সেটা আমরা বুঝতে পারি। চিকিত্সকেরা এখন নানাভাবে অসম্মানিত হচ্ছেন।
আমরা যখন গণমাধ্যমে দেখলাম, একটা অভাবী এলাকার মানুষ কাপড় খুলে পেট দেখাচ্ছে এবং বলছে আমাদের ভুল বুঝিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে, তখন উচ্চ আদালত থেকে আমাকে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে বলা হলো। আমি পেশা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের লাইসেন্স বন্ধ করে দিয়ে তাঁদের সাধারণ বানিয়ে দিতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে আমি আদালতকে বলি, তাঁদের বিরুদ্ধে যদি কোনো প্রমাণ থাকে, তাহলে আমি তাঁদের নিবন্ধন বাতিল করে দেব। এই প্রমাণের জন্য আদালত তখন উদ্যোগ নিলেন।
এই ঘটনা যে শুধু আমাদের দেশে হচ্ছে তা নয়, ভারতেও এ রকম ঘটনা হয়ে থাকে। সেখানে যেহেতু প্রতিস্থাপন বেশি হয়, তাই দুর্নীতিও বেশি হয়। গণমাধ্যম যেভাবে অভাবী এলাকার লোকের পেট কাটা দাগ দেখাল, একজন দাতাকে তো দেখাতে পারল না। এক হাজারের মধ্যে বলা হয়েছিল ৩০০, কিন্তু আপনারা ৩০-৪০ জনের বেশি খুঁজে পাননি।
আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের জায়গা নেই। অভিযোগের জায়গা হলো অপরাধ আদালত। চিকিত্সকদের অবস্থাগত কারণে আমি এখানে ভোক্তা আদালতের প্রস্তাব করছি। তাঁরা যদি সংক্ষুব্ধ হন, বিক্ষুব্ধ হন, তাহলে তাঁরা কনজিউমার কোর্টে যাবেন। ভোক্তা আদালত থেকে দেওয়ানি আদালত, প্রয়োজন হলে ফৌজদারি আদালতে যেতে পারেন—এটা হলো এক। দুই. আমি চিকিত্সকদের জন্য শুধু নয়, পেশা বিশেষজ্ঞদের জন্য প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা আইন করতে চাই। এটা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে আছে। আমি এখানে ভারতের কথা বিবেচনায় নিচ্ছি। কিছুদিন আগে আপনারা চেন্নাইয়ে দেখেছেন এক মহিলা মারা গেছেন। এক গাইনোকলজিস্টের প্রতি তাঁর আত্মীয়রা ক্ষুব্ধ ছিল এবং তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। তাই আমি মনে করি, প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। যারাই চিকিত্সকদের ওপর হামলা করবে, তাদের বিচার হবে, জরিমানা হবে। সম্পত্তি ধ্বংস করলে ভারতে দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। পৃথিবী এ বিষয়ে অনেক এগিয়েছে। আমরাও অনেক দূর পৌঁছেছিলাম, কিন্তু এই সংবাদ আমাদের অনেক পিছিয়েছে। তার পরও গণমাধ্যম যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে আমি সাধুবাদ জানাব।
আব্দুল কাইয়ুম
চিকিত্সকদের সনদ পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটা নিয়মিত ব্যবস্থা দরকার। অনেকে আবার ভুয়া চিকিত্সক সাজেন। এটা দেখার কি কোনো ব্যবস্থা আছে?
আবু সুফী আহমেদ আমিন
আমাদের রেজিস্টার্ড সব চিকিত্সকের ডেটাবেইস ওয়েবসাইট আছে। রেজিস্টার্ড চিকিত্সকেরা প্রতারণা করলে আমাদের কাছে আসবেন। নন-রেজিস্টার্ড চিকিত্সকেরা করলে সরকার দেখবে।
আব্দুল কাইয়ুম
আমি শুধু একটা কথা যোগ করব। আমি আশা করি, আপনার সঙ্গে দ্বিমত হবে না। গণমাধ্যমের সংবাদ অসত্য হলে আলাদা কথা। কিন্তু উদ্দেশ্য থাকে একটা সমস্যা বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা। কয়েক দিন আগে আমি দেখেছি, বিদেশি গণমাধ্যমেও ভারতের কয়েকটি গ্রাম ধরে একই ধরনের সংবাদ প্রচারিত হয়েছে এবং ওইভাবে ওই দাগগুলো দেখিয়েছে। আমি বলব না যে এটার কোনো অন্য উদ্দেশ্য ছিল।
আবু সুফী আহমেদ আমিন
এ দেশে আমরাই প্রথম সমস্যা চিহ্নিত করি। আজ থেকে ১৫ বছর আগে রোগী এসেছিল জাপান থেকে, সার্জন এসেছিল চেন্নাই থেকে, আর আমাদের বস্তি থেকে এসেছিল অঙ্গদাতা। দুটি করার পর আমরাই প্রতিরোধ করেছিলাম। আমরা গণমাধ্যমকে ভারতীয় ওই সব চিকিত্সকের বিরুদ্ধে জানাই। আমরা ভারতীয় মেডিকেল কাউন্সিলে এদের বিরুদ্ধে জানাই। ভারতীয় মেডিকেল কাউন্সিল তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিয়েছিল।
আব্দুল কাইয়ুম
আমাদের আলোচনার মধ্য থেকে এটুকু বলা যায়, একজন পেশাজীবী হিসেবে আপনাকেও থাকতে হবে, সাংবাদিক হিসেবে আমাকেও থাকতে হবে। প্রফেসরদের মধ্যে যাঁরা এই স্তরে গিয়েছেন, আমি মনে করি না তাঁদের মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকবে। যেভাবেই হোক, সংবাদটি এসেছে। আজাদ খান সাহেবও বলেছেন, একটি বিতর্ক সামনে এসেছে এবং সুযোগ হয়েছে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার।
আজাদ খান
প্রথম কথা হলো, ক্যাডেবারিক বা মরণোত্তর প্রতিস্থাপন। এ কথা সত্যি, উন্নত দেশও অনেক ক্ষেত্রে সফলভাবে ক্যাডেবারিক প্রতিস্থাপন করতে পারে না। আবার আইনের আর্থসামাজিক একটা প্রেক্ষিত আছে, সেই জন্য আমাদের দেশে মরণোত্তর অঙ্গ প্রতিস্থাপন অত সহজ হবে না হয়তো। আমাদের দেশের আইনের দুর্বলতা আছে। চিকিত্সকেরা যখন কাজ করেন, তখন তাঁদের ভুল হতেই পারে। অনিচ্ছাকৃত ভুলের দ্বারা কোনো রোগীর যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে সেটা অন্য উন্নত দেশে ক্ষতিপূরণ আইন (ল অব টট) দিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেটা ফৌজদারি আইনে আসে না। আমাদের দেশে ক্ষতিপূরণ আইন নেই, এর সংযোজন করা খুবই জরুরি।
আবুল মনসুর
২০ বছর ধরে এ ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হচ্ছে, তাতে আমরা ধীরে ধীরে মরণোত্তর প্রতিস্থাপনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। তবে যে ঘটনা ঘটে গেছে, তাতে প্রায় অচল অবস্থা বিরাজ করছে। এটাকে আবার কীভাবে চালু করা যায়, সেটা ভাবতে হবে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বিদ্যমান অঙ্গ সংগ্রহ আইন যেটা আছে, সেটা যাচাই-বাছাই করে যা করার, সেটা করে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা আইন ঠিক করে দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করতে পারি। যেকোনো বিষয়ের বেলায় চাহিদা সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য থাকলে একটা তৃতীয় পক্ষ তৈরি হয়। বিদেশে আত্মীয় ও অনাত্মীয়, উভয় ধরনের অঙ্গদাতা আছেন। আমরা ওই দিকে না গিয়ে জীবিত আত্মীয় স্বজনের অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে ধরে মরণোত্তর প্রতিস্থাপনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। এ ব্যাপারে একটা প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে।
তানজিনা হোসেন
আমরা এখানে শুনতে পেলাম, বেসরকারি হাসপাতালে মূলত প্রতিস্থাপন বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু বিএসএমএমইউ এবং জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে এখনো চালু আছে। এ পর্যায়ে আমি ডা. এ এম শামীমকে প্রশ্ন করব, এ মুহূর্তে বেসরকারি হাসপাতালগুলো কতটা প্রস্তুত এ কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে?
এ এম শামীম
অনেকে ভাবেন, বেসরকারি হাসপাতাল মানে বাণিজ্য। বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিস্থাপন করা একটা স্বপ্ন, এটা বাণিজ্যিক ব্যাপার নয়। আমরা যে কয়টা লিভার প্রতিস্থাপন, পাঁচ-ছয়টা কিডনি প্রতিস্থাপন করেছি, তার চার ভাগের এক ভাগ টাকাও কিন্তু পাইনি। সবাই চাই সব কাজের পর একটা স্বীকৃতি হবে। এই চিন্তা করেই কিন্তু আমরা লিভার প্রতিস্থাপন শুরু করেছি। বাস্তবে বা যুদ্ধক্ষেত্রে কিন্তু আমরাই আছি।
আমরা শুধু কিডনি নিয়ে কথা বলছি, প্রায় দুই লাখ রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন করতে হবে। আমরা যেটা ছুঁয়েই দেখিনি, সেটা হলো বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন, থ্যালাসেমিয়া থেকে শুরু করে ‘অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া’, লিউকোমিয়া।
সেদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক আমাদের বলল, গণমাধ্যমের প্রচণ্ড চাপ, আমাদের একটা কিছু করতে হবে। আমাদের খুব আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়েছে। অথচ আমরা অনেক কষ্ট করে দেশে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাটা এত দূর নিয়ে এসেছি। বিদেশে গেলে যেটায় ১৫ লাখ টাকা লাগে, সেটা আমরা তিন লাখ টাকায় করে দিই। বিভিন্ন চাপে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে আছে। আপনাদের কাছে আমরা সহযোগিতা চাই, এটা অনেক বড় ব্যাপার। আমরা প্রতিস্থাপন নিয়ে ব্যবসা করি না, এটা নিয়ে ব্যবসা করতে পারে গ্রামের লোকজন।
তানজিনা হোসেন
এ প্রসঙ্গে চলে আসে, আইনটা আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারি। এর কোনো পরিবর্তন দরকার কি না? এ বিষয়ে ডা. কামরুল হাসান খানকে বলার জন্য আনুরোধ করছি।
কামরুল হাসান খান
কিছুদিন আগে যে ঘটনাটা ঘটে গেল, তার ফলে জনগণ এবং চিকিত্সকেরা দুই পক্ষই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। বলা যায়, ওই বিষয়টিতে তথ্যের অভাব ছিল, যোগাযোগের অভাব ছিল, অর্থাত্ পুরো বিষয়টা অবন্ধুত্বপূর্ণ হয়েছে। আর্থিক বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। এই ঘটনাগুলো চিকিত্সা পেশায় একটা খারাপ প্রভাব ফেলেছে। আর ভালো দিকটি হলো আলোচনার ফলে আমরা একটা সঠিক পথে যাব, যা মানুষের মধ্যে আগ্রহ জাগিয়েছে। আমরা সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করি। আমি এ বিষয় নিয়ে বলছি, যারা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে কাজ করে, তারাও বিষয়টা বুঝবে। এটা নিয়ে কিছু করতে হবে। আমরা কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে যেটা করেছি, আমার মনে হয়, এটা সবারই অনুসরণ করা উচিত। তাহলে এত কিছু ঘটত না।
আমার ধারণা, অনেক কমসংখ্যক শিক্ষিত লোকই আছে, যারা সন্ধানী, সন্ধানী-জাতীয় চক্ষুদান সমিতি, স্বেচ্ছায় রক্তদান এবং মরণোত্তর চক্ষুদানের ঘটনা জানে না। মরণোত্তর চক্ষুদানের ভালো-মন্দ নিয়ে অনেক প্রচারণা আমরা চালিয়েছি। আমরা ২৭ বছর যাবত্ এই কাজটা করছি, তাতে আমাদের ফলাফলটা হলো প্রায় তিন হাজার ৬০০ কর্নিয়া আমরা সংগ্রহ করেছি, এর মধ্যে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন হয়েছে প্রায় তিন হাজার ২০০-র মতো। আমরা দাতা সংগ্রহ করেছি অনেক, কিন্তু তার মধ্যে শুধু ৯২ জন দাতার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে, বাকিগুলো মৃতদেহ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
’৯৯ সালের আইনে একটা জটিলতা আছে, যাতে আমরা কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। দাতার ক্ষেত্রে ১২ ঘণ্টা, বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা, কিন্তু আমাকে নিতে হবে ছয় ঘণ্টার মধ্যে। আমরা এই আইনটা সংশোধনের চেষ্টা করছি, কিন্তু ধীরগতিতে এগোচ্ছে।
তানজিনা হোসেন
এ প্রসঙ্গে আমি অধ্যাপক রফিকুল আলমকে বলতে অনুরোধ করছি।
রফিকুল আলম
আমি বলতে চাই, প্রতিস্থাপন কার্যক্রম একটা সম্মানের কাজ। আমাদের এই গৌরবের বিষয়টা যদি ধরে রাখতে হয়, তাহলে গণমাধ্যম, সরকার, রাজনীতিবিদ—সবাইকে এই বিষয়টা ধারণ করতে হবে।
কিছুদিন আগে ঢাকায় অটিজম সম্মেলনে ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতের কিছু কিছু নির্দেশকে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে।’ এটা গর্বের বিষয়।
আমাদের হাসপাতালে অঙ্গদাতার পরবর্তী চিকিত্সা বিনা পয়সায় করা হয়। এইভাবে ২৫-৩০ বছর চলার পর দেখা যায়, শুধু কিডনিদানের কারণে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অঙ্গদাতার যে সমস্যা হয়, তা মূলত বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির কারণে হয়।
এখানে চিকিত্সকদের আতঙ্কের বিষয় হলো, প্রতিস্থাপন আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। একজন রোগী যখন কিডনি বিশেষজ্ঞের কাছে আসেন, তখন তিনি রোগীকে কে কে কিডনি দিতে পারবে, তার একটি দিকনির্দেশনা দিয়ে দেন। এখন রোগী যদি কোনো ভুল লোককে নিয়ে আসেন, সে ক্ষেত্রে চিকিত্সকের কী করার আছে? মরণোত্তর ডোনেশন নিয়ে আমার একটি অনুরোধ হলো সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ মিলে এই বিষয়ে অগ্রগতির জন্য কাজ করতে হবে।
তানজিনা হোসেন
এই আলোচনা থেকে বলতে পারি, অঙ্গদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে চিকিত্সক কোনো পক্ষই নয়। আমরা মোটামুটি সবার কথাই শুনেছি। সর্বশেষে আমি ড. হারুন-উর-রশিদ স্যারকে উপসংহার টেনে কিছু বলতে বলব।
হারুন-উর-রশিদ
বর্তমান বিএসএমএমইউতে ১৯৮২ সালে ঝুঁকি নিয়ে আমরা প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু করি। পৃথিবীতে যদি নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হয়, সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতেই হবে। কিডনি সংযোজনের পর রোগীর কিডনির সক্রিয়তা শুরুর জন্য সারা রাত অপেক্ষা করেছিলাম। নতুন কিছু উদ্ভাবনের কী আনন্দ সেদিন আমরা পেয়েছিলাম। সেই রোগী বেঁচে ছিল ছয় সপ্তাহ। এই হলো বাংলাদেশে প্রতিস্থাপন শুরুর ইতিহাস। দ্বিতীয়জন বেঁচে ছিল নয় মাস। তারপর ১৯৮৮ সাল থেকে যে প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে, সেটা প্রায় হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
১৯৯৯ সালে ‘অর্গান অ্যাক্ট ল’ পাস হয়। তখন বিদেশিরা এসে অনাত্মীয়দের অঙ্গ প্রতিস্থাপন শুরু করতে যাচ্ছিল। সেটা বন্ধ করতে এই আইন পাস হয়। তখন চিকিত্সকেরা জীবিত আত্মীয়দের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কথা চিন্তা করেই এই অর্গান অ্যাক্ট ল তৈরি করেন। ক্যাডেভারিক বা মরণোত্তর প্রতিস্থাপন যাতে শুরু করা যায়, তার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করার জন্য এ আইনে বলা হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশেই অঙ্গ প্রদানকারীর স্বল্পতা আছে। এ জন্যই বিশ্বে জীবিত আত্মীয়দের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে মরণোত্তর প্রতিস্থাপনও করা হয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ জীবিত আত্মীয়দের অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়, আর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মরণোত্তর প্রতিস্থাপন হয়। আর দক্ষিণ এশিয়ায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ হয় জীবিত আত্মীয়দের অঙ্গ প্রতিস্থাপন, আর ভারতে পাঁচ শতাংশের নিচে মরণোত্তর প্রতিস্থাপন হয়। সুতরাং মরণোত্তর প্রতিস্থাপন আমাদের এগিয়ে নিতে হবে, তবে তা জীবিত আত্মীয়দের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিনিময়ে নয়। আমাদের বছরে প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হলো ২০ হাজার, আর আমরা করি ১০০ থেকে ১২০টি। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম, জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন—এগুলো সবই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে ৯৫ শতাংশ প্রতিস্থাপন হয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে, আর বাকি পাঁচ শতাংশ হয় লাভজনক প্রতিষ্ঠানে।
আমরা প্রথমে বুঝতে পেরেছি পাঁচ শতাংশের নিচে অনাত্মীয়দের অঙ্গ প্রতিস্থাপন চিকিত্সকের অজ্ঞতায় ঘটে গেছে। আরেকটি প্রশ্ন উঠেছে, অঙ্গদাতা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগেছে। দ্বিতীয় বিশ্বে যুদ্ধে যারা একটা কিডনি হারিয়েছিল, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, তারা সুস্থ স্বাভাবিক আছে। ৩০ বছর আগে যারা কিডনি দিয়েছিল জার্মানিতে, সুইডেনে, নরওয়েতে, তাদের স্বাস্থ্য যারা দেয়নি তাদের চেয়ে ভালো। কারণ তারা নিয়মিত ফলোআপ করে।
এখন যে অর্গান অ্যাক্ট ল, সেটার উপধারা অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আমাদের একটা জাতীয় কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানিক কমিটি করা হয়েছে। আমরা দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে যদি এই উপধারা পেয়ে যাই, তাহলে আমাদের মরণোত্তর প্রতিস্থাপন এবং জীবিত আত্মীয়দের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমি আশা করি, এর ফলে আমাদের প্রতিস্থাপন সার্জনরা আরও দ্রুত এগিয়ে যাবেন। আমি মনে করি, বেসরকারি হাসপাতালে এটা বন্ধ থাকা উচিত নয়। অন্তত বাবা মা ভাই বোন তথা সরাসরি আত্মীয়দের ক্ষেত্রে এখনই শুরু করতে পারে। আমার কাছে এখন প্রায় ৮০ জন রোগী আবেদন করে বসে আছে, দাতার সব তথ্য তদন্ত করা আছে। তারা শুধু অপেক্ষা করছে কখন আমরা অর্গান অ্যাক্ট ল হাতে পাব। সুতরাং, গণমাধ্যম যদি এগিয়ে আসে, বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাত্কার যদি প্রচার করা হয়, প্রতিস্থাপনে উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে হাজার হাজার রোগী বেঁচে যাবে। একজন কিডনি সংযোজিত রোগী নতুন জীবন পাবে এবং সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবে।
আব্দুল কাইয়ুম
আমরা প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু, যা দেশের লাখ লাখ মানুষের ভালো-মন্দের সঙ্গে জড়িত, সেই বিষয়টি সামনে আনার জন্য। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা এসেছেন, আমরা কৃতজ্ঞ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০১২
Leave a Reply