নানারকম ডায়েট
রোজার খাদ্যাভ্যাসে যারা এতদিনে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন এখন তারাই আবার ফিরে গেছেন আটপৌড়ে খাবার রুটিনে। এরই মাঝে শরীর নামের মহাশয়ের উপর দিয়ে বয়ে গেছে ঈদের ভাল-মন্দ খাবারের ঝড়ও! তবে খাবার গ্রহণের সময় আর খাদ্যতালিকায় এতদিনের সব অভ্যাস-অনভ্যাসকে ভুলে শরীর নামের যন্ত্রটাকে একটা মসৃণ গতি দিতে চাইলে নতুন করে কিঞ্চিৎ ভাবনা চিন্তারও প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে সবাই যে ঢালাওভাবে একই খাবার তালিকা অনুসরণ করে নিজেদের শরীরটাকে ঝরঝরে করে তুলবেন তা হয়তো ঠিক নয়। আবার রাতারাতি কঠিন তপস্যা’র মতো কঠিন সব ডায়েট করে নিজের মুখের স্বাদটাকে জলাঞ্জলী দেবারও কোনো মানে হয় না। সবমিলিয়ে নিজের জিহ্বাটাকে নিয়ন্ত্রণ করা আর সুস্থ থাকার জন্য পরিমিত ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণই হলো হাজার কথার এক কথা। আর ঈদ-পার্বণের পর হররোজকার এই খাদ্য ভাবনা নিয়েই লিখেছেন রাশেদুল হাসান শুভ
ফুডস্টাইলে ট্রাফিক
‘না খেয়ে মানুষকে মরতে দেখেছি কম, কিন্তু অতিরিক্ত খেয়ে মরতে দেখেছি অনেককে’- বিখ্যাত আমেরিকান দার্শনিক বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন একবার অনেকটা রসিকতা করেই বলেছিলেন এই কথাগুলো। আশপাশের দু’চার দশটা মানুষের দিকে তাকালে ফ্রাঙ্কলিনের এই রসিকতার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতও হয়তো মিলতে পারে। তবে একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, এই দুনিয়ায় হরেক রকম খাবার চেখে দেখার সাধ ও সাধ্য যাদের আছে তাদের কাছে গোটা পৃথিবীটাই যেন একটা রসময় স্থান। এখানে সেখানে জিভের জল ফেলবার মতো খাবারের অভাবও এদের কাছে কদাচিৎই অনুভূত হয়। তবে খেতে পারাটাই যে জীবনের একমাত্র স্বার্থকতা নয় এটা কেবল তারাই বোঝেন যারা কোনো কিছু খাবার পর সেটা হজম করতেই গলদঘর্ম হন। ঠিক খাবারটি ঠিক সময়ে না খাবার দায়ে এদের কেউ ভোগেন মুটিয়ে যাবার বিমারে, আবারো কারো বা এই রোগ, সেই রোগে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আবার খাবার নিয়ে অবহেলার কারণে বাজে রকমের শুকিয়ে যাবার ভোগান্তিতেও ভুগতে হয় অনেককে। তবে ঈদ-পার্বণের পরবর্তী এই সময়টিতে আপনার অবস্থান যেই দলেই হোক না কেন, নতুন করে পুরোনো শরীরটাকে আরো একবার কর্মক্ষম করে তোলার চেষ্টা থেকে নিশ্চয়ই পিছপা হবেন না কেউই। আর শরীরের প্রতি যত্নবান এইসব পাঠকের জন্যই এখানে দেয়া হলো বেশ কয়েক ধরনের ডায়েটের ফর্দ।
মুটিয়ে যাওয়াদের ডায়েট
সিয়াম সাধনার এক মাস অনেকেই হয়তো তাদের শরীরটাকে বেশ মানিয়ে নিয়েছিলেন একটা রুটিনমাফিক খাদ্যাভ্যাসের মাঝে। তবে এ বেলায় ঈদ আর ঈদের পরের ঝক্কিতে সেই রুটিনকে বেমালুম ভুলে যাওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের মতো কাজ নয়। বরং পরিমিত ও পুষ্টিকর খাবার অভ্যাসটাকে এ বেলাতেও একইরকমভাবে চালু রেখে মুটিয়ে যাওয়া লোকদের ভাবতে হবে যথাযথ ডায়েট নিয়ে। এমনিতেই একটু মেদভুরিওয়ালা লোকেরা নিজেদের স্বাস্থ্য আর ডায়েট নিয়ে এতবেশি ভাবেন যে তাদেরকে নতুন করে কিছু বলতে যাওয়াটাই বিপদ। তবু নতুন করে পুরোনো যে কথাগুলোই আরেকবার মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন তাহলো, অতিরিক্ত চিনি তথা সুগারের কারণেই মূলত আমাদের হজম প্রক্রিয়ায় খানিকটা ভজঘট পাকিয়ে যায়। চিনি আমাদের শরীরে যে ইনসুলিন তৈরি করে তার ফলে অনেক স্ট্রিক্ট ডায়েট অনুসরণ করেও ওজন কমানো সহজ হয় না। কাজেই মুটিয়ে যাওয়া লোকদের খাদ্য তালিকায় যেন চিনিযুক্ত খাবারের পরিমাণ কিছুটা হলেও কম থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এক্ষেত্রে যারা একেবারে অঙ্কের হিসেবে মেনে ডায়েট করতে চান তাদের জন্য ডায়েটের তালিকায় থাকতে হবে ৩০ ভাগ প্রোটিন, ৪০ ভাগ ফ্যাট আর ৩০ ভাগ কার্বোহাইড্রেটের সমন্বয়। আর যারা অতশত না বুঝে সরাসরি জেনে নিতে চান খাওয়া ভাল এমন সব খাবারের নাম তাদের জন্য আমাদের পরামর্শ হলো আলু, ভাত, রুটি কিংবা অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। আর উদরপূর্তি করুন পরিমিত পরিমাণ মাছ, মাংস, সবজি আর ফলমূল দিয়ে। আর হ্যাঁ মোটা থেকে যারা চিকন হতে চান তাদের জন্য পরিমিত খাবারের পাশাপাশি শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট বার্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যায়ামও জরুরী।
ক্ষীণকায়দের ডায়েট
অনেকেই ভাবেন যারা এমনিতেই খানিকটা রোগা পাতলা তাদের জন্য আবার অতসব ‘ডায়েট-ফায়েট’ এর দরকার কি। এরা ভাবেন ‘নগদ যা পাও হাত পেতে খাও বাকীর খাতায় শূন্য’ এই নীতিতে অবিরাম খেয়ে গেলেই বুঝি ক’দিনে বেশ মুটিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর এই নির্বিচারে খাদ্য ভক্ষণের নাম করে অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়েই এই দলের লোকেরা বারোটা বাজান তাদের স্বাস্থ্যের। তবে মোদ্দাকথাটি হলো, একটা সুন্দর সুঠাম দেহের জন্য পরিশ্রমের সাথে গৃহিত খাদ্যের একটা সামঞ্জস্য যেকারো জন্যই জরুরী। এছাড়া কোনোরকম অসুখ-বিসুখ কিংবা হজমের গন্ডগোলের কারণে শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাও দেখা জরুরী। দেখা যায়, যাদের শরীরে কারণে অকারণে মেদ জমবার বাতিক নেই তাদেরকে রোজার পরে আরো খানিকটা ক্ষীণকায় বলে মনে হয়। তবে রোজার খাদ্যাভ্যাস যে শরীরকে আরো শুকিয়ে ফেলে একথা কিন্তু মোটেও সত্য নয়। বরং রুটিন মেনে সঠিক খাবার খেলে যেকোনো সময়েই যে একটা ফিট স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায় একথা প্রমাণিত এক সত্য। মনে রাখবেন একটু ক্ষীণকায় থেকে সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়ার জন্য নিরোগ দেহের পাশাপাশি আপনার প্রয়োজন পরিমিত পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট। আর এ লক্ষ্যে আপনাকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে সকল প্রকার চিনিযুক্ত খাবার, কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার, ভাত, রুটি, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, পনির এবং লো-কোলেস্টরল আর ভাল ফ্যাটযুক্ত খাবারের প্রতি। এছাড়া সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবারের মাঝে একবার আর দুপুর থেকে রাতের খাবারের মাঝে একবার; মোট এই দু’বার স্বাস্থ্যমানসম্পন্ন স্ন্যাক্স খাওয়াটাও উপকারী। তবে মনে রাখবেন, শরীরটাকে ফিট রাখার জন্য ক্ষীণকায়দেরও প্রয়োজন রয়েছে শরীর উপযোগী ব্যায়ামের দ্বারস্থ হবার।
জীবনের জন্য ডায়েট
এই পৃথিবীতে এমন লোকের সংখ্যাও নেহাত কম নয় যারা ইচ্ছা থাকলেও নানা রোগের কারণে প্রাণভরে খেতে পারেন না। আর এই দলে সবার আগে যাদের কথা আসে তারা হলো ডায়বেটিসে ভোগা রোগীরা। কি ঈদ আর কি রোজা, বছরের বারোটা মাসই এদের থাকতে হয় কঠিন ডায়েটের মধ্যে। তবে রোগ এবং রোগের প্রতিকার সম্পর্কে ভাল করে জানা থাকলে ডায়বেটিস শরীরেও যে ভালমন্দ খাবার দিব্যি চেখে দেখা যায় সেটা বহু আগেই প্রমাণিত। মূলত কোন খাবারে কি পরিমাণ সুগার আছে সেটির উপর নির্ভর করেই তৈরি হয় ডায়বেটিক রোগীদের ডায়েট প্ল্যান। আর সুগার নিয়ন্ত্রণের মূল লক্ষ্য হলো ইনসুলিনকে এমন একটি পর্যায়ে রাখা যা শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট বার্ন করে শরীরকে রাখতে পারে ঝরঝরে। অঙ্কের হিসেবে এ জাতীয় ডায়েটে ৪০ ভাগ কার্বোহাইড্রেট, ৩০ ভাগ প্রোটিন ও ৩০ ভাগ ফ্যাট থাকা বাঞ্চনীয়। আর সরাসরি খাদ্যের প্রসঙ্গে এলে মানতে হবে ‘লো ফ্যাট-হাই প্রোটিন তত্ত্ব’। অর্থাৎ এমন সব খাবার খেতে হবে যেগুলোতে ফ্যাটের মাত্রা কম হলেও প্রোটিন থাকবে ষোলআনা। আর এই ধারার খাবারের মধ্যে প্রাধান্য দিতে হবে আঁশযুক্ত ফল ও সবজি, পরিমিত পরিমাণ ভাত, রুটি, মাছ আর মাংসকে। অন্যদিকে হজমের গন্ডগোলের কারণে যারা এসিডিটির মতো সমস্যায় ভোগেন তারা ডায়েট চার্টে পরিমিত অন্যসব খাবারের পাশাপাশি বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিতে পারেন শসা, পেয়ারা, পাকা পেঁপে, পটল, লাউ ইত্যাদি ফল ও সবজির প্রতি। আর হ্যাঁ, সবরকম ডায়েটের সাথে দিনে কমপক্ষে ৮ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি খাওয়াটা কিন্তু মর্ত্যলোকের সব মানুষের জন্যই সমান জরুরী।
ডায়েটিং টিপস্
১. সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য এমন কোনো ডায়েট চার্টের অস্তিত্ব আদতেই নেই। কাজেই আপনার জীবনযাত্রা আর পরিশ্রমের ধরণের উপরই নির্ভর করবে আপনার ফুডস্টাইলে ডায়েটিং এর বাস্তবায়ন।
২. ডায়েট এর জন্য খাবার তালিকাটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সংৗষ্িট খাবারের খাদ্যমাণও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজেই যেকোনো খাবার গ্রহণের আগে সেটি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রস্তুত কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে।
৩. কম খেয়ে বেঁচে থাকাটাই যে জীবনের মূলমন্ত্র নয় এটি বুঝতে হবে। আবার যা পেলাম তাই খেলাম এমনটাও ভাবা উচিত হবে না। ভাবতে হবে এ দুইয়ের মাঝামাঝি।
৪. দিনের পর দিন রুটিন মেনে একই খাবার খাওয়া মানেই ডায়েট নয়। বরং খাদ্যগুন ঠিক রেখে খাবারের উপকরণে পরিবর্তন আনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
৫. যেকোনো ধরণের ডায়েটের সাথে শরীর ফিট রাখার জন্য ব্যায়ামের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই আপনি মোটা হোন কি চিকন, পুষ্টিবিদদের পরামর্শ মেনে সঠিক ব্যায়ামের অভ্যাস আপনাকে গড়ে তুলতেই হবে।
৬. মোটা কিংবা স্লিম হবার চাইতে শরীর সুস্থ্য রাখাটা অনেক বেশি জরুরী একথা ভুলে গেলে চলবে না।
কড়চা’র এই সেশনে মডেল হয়েছেন সারিকা আর ছবি তুলেছেন তাহের মানিক
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০০৯
Leave a Reply