এই নগরে যার যার কাজ নিয়ে সবাই সকাল থেকে রাত অবধি ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করে। প্রতিদিন কাজ করার ফলে প্রত্যেকের শরীরে চলে আসে অলসতা। পিছিয়ে পড়তে হয় জীবনে চলার পথে গতির রেসে। শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং বন্ধু ও সহকর্মীদের মধ্যে নিজেকে সুস্থ শরীরের অধিকারী হিসেবে তুলে ধরার জন্য আপনার শরীরকে রাখতে হবে সুস্থ-সবল ও সুঠাম দেহের অধিকারী। তাহলেই আপনি হতে পারবেন সবার সেরা।
শাহাদাত হোসেনের সেই সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাজার করতে করতে অফিসের সময় হয়ে যায়। অফিসের সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষ করে, বাসার ফেরার পর ছেলেমেয়েদের পড়া দেখানোর পর রাতের খাবারের সময় চলে আসে। তখন সারা দিনের সব ক্লান্তি ভর করে চোখের পাতায়।
আরিফুর রহমানকে নিজের শরীরের জন্য বন্ধু মহলে শুনতে হয় নানা রকম কথা। ঘুম থেকে ওঠার পর সকাল আটটা থেকে চারটা পর্যন্ত ক্লাস করতে হয়। সন্ধ্যার পর টিউশনি করে ফিরতে ফিরতে ১০টা সাড়ে ১০টা বেজে যায়। নিজের পড়া শেষ করতে রাত গভীর হয়ে যায়। কিন্তু নিজের শরীর ঠিক রাখতে হবে নিজের দায়িত্বেই। শহরে এ রকম ব্যস্ত লোকের সংখ্যা বেশি। অনেকেই সময় নিয়ে যেতে পারে না জিমে। কিন্তু জিমে না গিয়েও শরীর ঠিক রাখা যায়। বাসা, হল ও মেসে যেখানেই আপনি থাকেন না কেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিনে আনতে পারেন ব্যায়ামের নানা উপকরণ এবং বাসা বা হলে বসেই ঠিক রাখতে পারেন আপনার শরীর। থাকবেন সুস্থ-সবল এবং কর্মক্ষেত্রে পেতে পারেন গতি।
নিজের ঘরই জিম
কর্মব্যস্ত এই শহরে বাইরে গিয়ে যখন শরীরচর্চার সুযোগ সীমিত, তখন নিজের ঘরটাকেই কিছু সময়ের জন্য বানিয়ে ফেলুন খোলা মাঠ বা জিমনেশিয়াম। ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে ফিটনেস ওয়ার্ল্ডের কর্ণধার ও প্রশিক্ষক এম আর মানিক বলেন, ঘরে করার উপযোগী ব্যায়ামগুলোর মধ্যে সাইক্লিং, জগিং, সুইমিং, স্কিপিং অন্যতম। এতে হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়। সব বয়সের নারী-পুরুষই এগুলো করতে পারে। বয়সের ওপর লক্ষ রেখে ব্যায়ামের বিষয় ঠিক করা উচিত। সাধারণত উঠতি বয়েসের ছেলেমেয়েদের করা উচিত ভারী ও ইনস্ট্রুমেন্টাল ব্যায়াম এবং একটু বয়সীদের করা উচিত হালকা ব্যায়াম। তবে যে ব্যায়ামই করা হোক না কেন, এর সময়সীমা ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের বেশি হওয়া উচিত নয়। আর দৈর্ঘø-প্রস্থে পেশি বাড়াতে হলে ডাম্বেল-বারবেল দিয়ে ব্যায়াম করা যায়। এ ছাড়া খেয়াল রাখা উচিত, শরীরের মেদ কমানোর প্রতি। এ ক্ষেত্রে স্পোর্টêস ব্যায়াম করা উচিত।
রকমারি ব্যায়াম
ব্যায়াম দুই ধরনের হয়ে থাকে। ১· ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ ২· ইনস্ট্রুমেন্টাল এক্সারসাইজ। ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ দৌড়, হাঁটা, দড়িলাফ, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি। এটা সাধারণত বেশি বয়সীদের করা উচিত। ইনস্ট্রুমেন্টাল এক্সারসাইজ উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা বেশি করে থাকে। এর মধ্যে ফ্লাইং, উইথ ওয়েট, পুশআপ, চিপআপ, ডাম্বেল, বারবেল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ইনস্ট্রুমেন্টাল ব্যায়ামের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। যদি সেটা হয় পেশিবহুল শরীর গঠনের উদ্দেশ্য। তবে এ ধরনের ভারী ব্যায়াম করার আগে মাস তিনেক ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরটাকে গঠন করে নেওয়া দরকার। ইনস্ট্রুমেন্টাল এক্সারসাইজ করার আগে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, ভুলে গেলে চলবে না আমাদের দেহের ভেতর লিভার, ফুসফুস, পাকস্থলী, হৃৎপিণ্ডর মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করে। তাই এলোপাতাড়ি ব্যায়াম করে শরীর ঠিক রাখতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
দরদাম
ঘরে বসে ব্যায়াম করার উপযোগী যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে রানার মেশিন সাত হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। সাইক্লিং মেশিন তিন হাজার ৫০০ থেকে ১২ হাজার টাকা। স্কিপিং রোপ দেশি ৫০, বিদেশি ১৫০ টাকা। জিম বল ৮০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা। ওয়েট লিফটি বেঞ্চ চার হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা । ডাম্বেল প্রতি কেজি ৪৫ থেকে ৬৫ টাকা। পুশআপ ২২০ থেকে ৫৫০ টাকা। পাওয়ার টুইস্টার ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা। ম্যাসেজ স্টিক ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। রোয়িং মেশিন ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা। ইলেকট্রিক ম্যাসেঞ্জার ফুট পাঁচ হাজার ৫০০, এজি ওয়াকার তিন হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার ৫০০ টাকা। ইলেকট্রিক বাইক পাঁচ হাজার ৫০০ থেকে আট হাজার। থ্রি ইন ওয়ান ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এব কিং প্রো তিন হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার ৮০০ টাকা। সিট আপ বেক ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। ব্যায়ামের ম্যাট ৫০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। স্টেডিয়াম মার্কেটের আইডিয়াল দোকানের কর্ণধার মো· আবু তাহের বলেন, এসব ছাড়াও রয়েছে মাল্টিজিম বা ওয়ানস্টেশন জিম, যেখানে একই সঙ্গে অনেক ব্যায়ামের সুবিধা পাওয়া যায়। এর দাম পড়বে ৪০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা। তবে মার্কেট ও দোকান ভেদে দামের কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
যেখানে পাওয়া যাবে
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যায়ামের সরঞ্জামাদি পাওয়া যায়। এর মধ্যে স্টেডিয়াম মার্কেট, গুলিস্তান, গুলশান, বনানী, পান্থপথ, তেজগাঁও, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে খেলাধুলার পণ্য বিক্রি করার দোকানগুলোয় জিমের সরঞ্জাম পাওয়া যায়।
মেনে চলুন কিছু নিয়মকানুন
বয়স ও শরীরের ওপর ভিত্তি করে সব লোকের জন্য ব্যায়ামের আগে-পরে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। গ্রুপ ফিটনেস জিম, ফিটনেস ওয়ার্ল্ডের কর্ণধার ও প্রশিক্ষক ফাহমিদা হক এবং এস আর মানিকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ব্যায়াম করার আগে ও পরে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। এগুলো দেওয়া হলো-
— আলো-বাতাস আসতে পারে এ রকম ঘর বেছে নেওয়া উচিত ব্যায়াম করার জন্য।
— ব্যায়াম শুরু করার আগে ভালোমতো ওয়ার্ম আপ করে শরীর গরম করে নিন।
— শুরুতে বেশ কিছুক্ষণ আগে হালকা কিছু খেয়ে নেবেন, যাতে শর্করা থাকে, সে সঙ্গে আধা গ্লাস পানি।
— দেহের ছন্দ আনার জন্য ব্যায়ামের সময় মিউজিক শুনতে পারেন।
— ব্যায়ামের সময় নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিন, মুখ দিয়ে নয়।
— ব্যায়ামের মধ্যবর্তী বিরতির সময় যেন খুব বেশি না হয়।
— একবারে সব ব্যায়াম না করে ধারাবাহিকভাবে একটি একটি করে ব্যায়াম শেষ করুন।
— ব্যায়াম চলাকালে কোনো খাবার বা পানি না খাওয়াই ভালো।
— ব্যায়াম শেষে শরীর শিথিল হওয়ার জন্য সময় নিন।
— ব্যায়ামের পর গোসল করে নেওয়া ভালো।
— ব্যায়ামের পর পর পানি খাবেন না।
— খাবারের তিন ঘণ্টা আগে ও পরে ব্যায়াম করুন।
— ব্যায়ামের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমন-বেশি ক্ষুধা লাগা, খুব ঘুম পাওয়া, শরীর ব্যথা করা এ জন্য ছেড়ে না দিয়ে প্রতি দিন চালিয়ে যান।
— ব্যায়ামের পর প্রোটিনযুক্ত খাবার খান।
— খাদ্যতালিকায় চর্বিযুক্ত খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিন।
— শাকসবজি ফলমূলের ওপর জোর দিন এবং প্রচুর পানি পান করুন।
— দিনে বা রাতে যেকোনো একসময় অভ্যাস করে ব্যায়াম করুন।
— নতুন কোনো ব্যায়াম শুরুর আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
বাদল খান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৬, ২০০৯
Leave a Reply