কথায় আছে বাঙালি মেয়ে কুড়িতেই বুড়ি। আর বয়সটা যদি হয় কুড়ি যোগ কুড়ি মানে চল্লিশ, তবে কি ‘বুড়ি থুত্থুড়ি’? মোটেও না। এ যুগে বয়সের কাছে হার মানা কখনোই নয়। মনটা সজীব থাকলে আর একটু সচেতন হলে বয়সকে হার মানাতে নিজের ইচ্ছাই যথেষ্ট। আপনি নন, বয়সই হার মানবে আপনার কাছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন হারমনি স্পার স্পা-থেরাপিস্ট রাহিমা সুলতানা।
বয়সের রেলগাড়িটা···
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বক স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য হারায়। কিছু নিয়ম মেনে এই বুড়িয়ে যাওয়া ভাবকে ঠেকানো যায়। যেমন-সঠিক খাদ্য তালিকা মেনে চলা, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং নিয়মিত ত্বকের যত্ন নেওয়া। শরীর আর মনেও আসে কিছু পরিবর্তন। যেমন-ত্বকে দাগ বা ভাঁজ পড়া, ত্বকের রং পরিবর্তন, ত্বক ছাপিয়ে শিরা দৃশ্যমান হওয়া, মেদ বেড়ে যাওয়া, বয়সজনিত দাগ, শারীরিক অবকাঠামো ভেঙে পড়া ইত্যাদি। এসব মিলে যে ব্যাপারটি সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, তা হলো মানসিক অবসাদ। ত্বকের ওপর বয়সের প্রভাব মূলত জীবনের চার অধ্যায়ে বিন্যস্ত। কৈশোর, তারুণ্য, মধ্যবয়স ও বার্ধক্য। কৈশোর ত্বক গঠন করে, তার পরিণতি মেলে তারুণ্যে। ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ার শুরুটা মধ্যবয়সে। এ বয়সে ত্বকে কোলাজেনের পরিমাণ প্রতিবছর শতকরা এক ভাগ কমতে থাকে। এতে কপাল ও চোখের চারপাশে দেখা দেয় বলিরেখা। শুষ্ক ত্বকের ক্ষেত্রে তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ত্বকনিঃসৃত তেলের নিঃসরণ কমে যায় বলে সহজেই ত্বকে দাগ পড়ে। বার্ধক্যে ত্বকের নিচে জমে থাকা চর্বি কমে যেতে থাকে বলে চামড়া বা ত্বক ঝুলে পড়ে।
বয়সকে করুন জয়
বয়সকে জয় করার মূলমন্ত্র কিন্তু ইতিবাচক চিন্তা আর হৃদয়ের তারুণ্য। তারুণ্য চিরকালীন। আপনার মন সজীব থাকলে কারও সাধ্য নেই বুড়িয়ে দেওয়ার। নিজের প্রতি মনোযোগ ও যত্ন আর সদা হাসিখুশি থাকার মূলমন্ত্র আয়ত্তে আনতে হবে নিজেকেই। বয়সের পরিপক্বতাকে আত্মবিশ্বাসের অনুষঙ্গ মনে করে বাকি সব উপসর্গ সহজেই মুছে নেওয়া সম্ভব।
‘আক্ষরিক অর্থে হিসাব করতে বসলে মনে পড়ে, বেশ কিছু বছর চলে গেছে জীবন থেকে। অথচ আমার মনেই থাকে না। আসলে কি, মন যদি সুন্দর থাকে, তবে কিছুই কিন্তু বাধা হতে পারে না।’ কথাগুলো বললেন সুরের ধারার শিশু বিভাগের সংগীতশিক্ষক গাজী শারমিন। গাজী শারমিন দুই মেয়ের মা, বড় মেয়ের বয়স ১৯ আর ছোট মেয়ের ১৬ বছর।
শারমিন বলেন, ‘আমার মতে, নিজেকে ঠিক রাখতে হলে সবার আগে মনটাকে হাসিখুশি রাখা চাই। জীবনে আনন্দের সঙ্গে বেদনারও বসবাস। তাই বলে সেটা ধরে বসে থাকলে চলবে কেন? আমি তো এখন আরও দুজন বন্ধু পেয়েছি-আমার দুই মেয়ে। এ তো গেল মানসিক স্থিতির কথা। বাইরে সুন্দর থাকাটাও কিন্তু খুব দরকার। আমাদের দেশের আবহাওয়া যেমন, তাতে ঘরে থাকলেও নিজের যত্ন নিতে হবে। সাধারণত আমরা নিজের প্রতি খুব একটা যত্ন নিই না। ব্যাপারটা আমরা সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারি যখন আমাদের ত্বক স্বাভাবিক কমনীয়তা হারায়। ছোটবেলা থেকেই পরিচ্ছন্ন থাকার চর্চা করতে হবে। মন যদি তরুণ থাকে, তবে এর অভিব্যক্তি মুখেও পড়ে বৈকি! আমি প্রচুর পানি খাই। পানি স্বাভাবিক রক্ত চলাচল ঠিক রেখে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বজায় রাখে। বাইরে যাওয়ার সময় হালকা সাজ আমার পছন্দ। আমার মন ভালো থাকে। মন ভালো থাকাটা খুব জরুরি।’
মেনে চলুন খাদ্যাভ্যাস
সবার আগে নিজের খাদ্যাভ্যাস নজরে আনা উচিত। কোন খাবার ত্বকের বন্ধু, কোনটি নয়-সে বিষয়ে রাহিমা সুলতানা বলেন, রঙিন খাবার, যেমন-প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল খাওয়া উচিত। তাজা খাবার ত্বক সতেজ করে। বাসি-পচা তাই এড়িয়ে চলুন। মাংস বাদ দিয়ে মাছ খাওয়ার অভ্যাস বাড়িয়ে তুলতে হবে। ইচ্ছামতো ভাত বা ভাতজাতীয় খাবার না খেয়ে সবজির স্যুপ বা এজাতীয় খাবার খান। শাকাহারী শব্দটিকে ভালোবাসতে শিখুন। বাদাম, পেস্তা অথবা মাছের তেল বাদে অন্যান্য তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। মিষ্টিজাতীয় খাবার, চিনি ইত্যাদি যথাসম্ভব খাদ্য তালিকার বাইরে রাখুন। সপ্তাহে এক বা দুই দিন মাংস খেলেও প্রচুর সবজি সঙ্গে রাখুন। বার্ধক্যে কাজের পরিমাণ সাধারণত কমে যায় বলে ক্যালোরির চাহিদাও কমে যায়। তাই উচ্চ ক্যালোরিসম্পন্ন খাবার এড়িয়ে চলুন। সামুদ্রিক মাছ ও প্রচুর পানি পান ত্বককে বয়সের বিপরীতে চলতে সাহায্য করে। সময়মতো খাদ্যগ্রহণ জীবনাচরণ উন্নত করে। কফি, অ্যালকোহল, চিনি বাদ দিয়ে মধ্যবয়স থেকে সবুজ চা (গ্রিন টি) খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ত্বকের দাগ ও ভাঁজ নির্মূলে সাহায্য করে সামুদ্রিক মাছ, তিল ও সূর্যমুখী বীজের তেল। পুষ্টিকর খাবার, আঁশযুক্ত খাবার খাদ্য-তালিকায় সংযোজন করুন।
শরীরচর্চার বিকল্প নেই
নিয়মিত শরীরচর্চা, হাঁটা শরীরকে রাখে উপযুক্ত, মনেও আনে প্রশান্তি। রোগপ্রতিরোধ-ক্ষমতা বাড়াতেও শরীরচর্চার কোনো বিকল্প নেই। সুনিদ্রা সুস্বাস্থ্যের বড় বন্ধু। নিয়মিত শরীরচর্চা সুনিদ্রার সহায়ক। শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দূরীকরণে এর কোনো বিকল্প নেই।
ত্বকের প্রতি খেয়াল
ত্বক নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে। রূপবিশেষজ্ঞর পরামর্শ নেওয়া উচিত। হাত ও পায়ের যত্নে মনোযোগ বাড়িয়ে দিতে হবে। উপযুক্ত মালিশ করানো উচিত নির্দিষ্ট সময় অন্তর, তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞর পরামর্শ অনুযায়ী।
প্রতিরোধ, অতঃপর প্রতিকার
যেকোনো ব্যাপারে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই ভালো। তবু প্রতিরোধের সময় পেরিয়ে গেলে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে-জানান লেজার মেডিকেল সেন্টারের কনসালট্যান্ট ডারমাটোলজিস্ট ঝুমু খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের ত্বকের স্তর তিনটি। ওপরের স্তর এপিডার্মিস, যা চামড়া নামে পরিচিত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এ স্তরের আর্দ্রতা কমতে থাকে। ত্বক মলিন হয়। বলিরেখা দেখা দেয় এ স্তরেই। এর পরের স্তর ডার্মিস, যেখানে থাকে কোলাজেন ও ইলাস্টেন। ত্বক টান টান রাখার দায়িত্ব এ স্তরের। বয়সের সঙ্গে টানটান ভাব কমতে থাকে। শেষ স্তরের নাম সাবকিউটেনাস টিস্যু। বয়স অনেক হয়ে গেলে ভেতরের এ স্তরটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঝুমু খান আরও বলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়ার ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যুক্ত খাবার খেতে হবে। ভিটামিন এ ও ডি সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের পরিমান প্রচুর বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। হলুদ ফলমূল, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদির পরিমান খাদ্য তালিকায় বাড়াতে হবে। আমিষ খাওয়ার বেলায় মাংসের পরিবর্তে মাছের দিকে পক্ষপাতিত্ত বাড়ান। সে চর্চা কম বয়স থেকে থাকাই ভালো। বিশষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ই ক্যাপসুল খাওয়া যেতে পারে বয়সের উপর ভিত্তি করে। চুল ও ত্বকের জন্য বাজারে ভিটামিন সমৃদ্ধ ক্যাপসুল কিনতে পাওয়া যায়। মনে রাখা ভাল সেগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিষেশজ্ঞের পরামর্শ জরুরী।
জিনাত রিপা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৯, ২০০৯
Leave a Reply