ভোরে আজানের সুরেই শামীমা হোসেনের ঘুম ভেঙে যায়। ৫০ বছর বয়সী শামীমা হোসেনের এ নিত্যদিনের অভ্যেস। ২০০৬ সালের অক্টোবরের হালকা শীতেও এ নিয়মে ব্যত্যয় হয়নি। কিন্তু সে দিন তিনি প্রচণ্ড পায়ের ব্যথায় উঠতে পারলেন না। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর ডাক্তার হাড়ের ক্ষয় মনে করে চিকিৎসা চালালেন। কিন্তু শামীমা হোসেনের পায়ের ব্যথার কোনো সুরাহা হলো না। এরপর নিউরো সার্জনের সহায়তা গ্রহণ করার পর ধরা পড়ল শামীমা হোসেনের বোন টিবি হয়েছে। আত্মীয়স্বজন অনেকের চোখে-মুখে বিস্ময়। বোন টিবি সে আবার কী? এর চিকিৎসা কী? অনেকে আবার যক্ষ্মা শুনেই আঁৎকে উঠলেন। যক্ষ্মা তো ছোঁয়াচে মনে করে। কিন্তু তাদের সবার আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে ডাক্তার শামীমা হোসেনের চিকিৎসা শুরু করলেন। বর্তমানে তিনি অনেক সুস্থ আছেন; তবে ডাক্তার বলেছেন, হাড়ে ছোট একটা অপারেশন করলে আরো সুস্থ হয়ে উঠবেন তিনি। হাড়ের যক্ষ্মা খুব কম দেখা গেলেও যে কারোর এ অসুখ হতে পারে তাই বলে ভয় পেলে চলবে না। সঠিক নিয়মে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ খেলে এ রোগ কেন সব ধরনের যক্ষ্মাই ভালো হয়ে যায়। বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী সাইফুদ্দিন (সহকারী অধ্যাপক রেসপিরেটরি মেডিসিন, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল) বলেন, আমাদের দেশে ঘনবসতি, অপুষ্টি, অসচেতনতা ইত্যাদি কারণে যক্ষ্মার প্রকোপ রয়েছে। তবে যক্ষ্মার চিকিৎসা সঠিক নিয়মে করালে তা ভালো হয়ে যায়। অনেকের ধারণা, যক্ষ্মা শুধু ফুসফুসে হয় এবং তা থেকে অন্যের শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু প্রবেশ করে। যক্ষ্মা ফুসফুস ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে। আবার সব যক্ষ্মার রোগী জীবাণু ছড়ায় না। তিনি বলেন, এসব তথ্য সাধারণ মানুষ জানে না। তাদের মধ্যে এসব তথ্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে।
প্রান্তিকজনদের কথা
শিক্ষিত নাগরিকদের মধ্যে যক্ষ্মা নিয়ে সচেতনতা দেখা গেলেও যাদের মধ্যে যক্ষ্মা হওয়ার ভয় সবচেয়ে বেশি থাকে অর্থাৎ বস্তি এলাকা বা ঘনবসতি এলাকার লোকজনের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করা, অপুষ্টির শিকার হয়ে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় খেটেখাওয়া অনেক মানুষ। মিরপুরের এক বস্তিতে থাকা রিকশাচালক আক্তার আলী বলেন, ‘বাবা, রিকশা চালাইবার সময় পাই না, তার যক্ষ্মা বিষয়ে কী জানুম।’ বাড়ি বাড়ি কাজ করে জীবনযাপন করা ৪৫ বছর বয়সী রাখী বেগম বলেন, ‘আমি যেই হানে থাকি হেই হানে একজনের একবার যক্ষ্মা হইছিল, হের বাদে তারে ডাক্তার ওষুধ দিয়া দিছিল তয় আমরা আর তার কোনো খোঁজ লই নাই আফা। তাই কইতে পারি না হের কী অবস্থা হইছে।’
প্রয়োজন সচেতনতার বিশ্বে প্রতি বছর ৯০ লাখেরও বেশি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে। আর এ রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য হলেও প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ এ রোগে মারা যাচ্ছে। এসব মৃত্যুর ৯৮ ভাগই উন্নয়নশীল দেশে ঘটছে। যাদের বেশিরভাই কর্মক্ষম বয়সের নারী ও পুরুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বের যে ২২টি দেশে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক, তাদের মধ্যে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাদেশের অবস্থান। প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ মানুষ নতুন করে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং ৭০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। যক্ষ্মা বাংলাদেশের একটি বোঝা, একে নির্মূল করার কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার না হলেও ব্যাপক গণসচেতনতার মাধ্যমে একে নির্মূল করা সম্ভব। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের ওপরে) জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ যক্ষ্মার জীবাণু বহন করছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডাক্তার মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি রোগ শনাক্তকরণ ও নিরাময়ে অনেক সফল হয়েছে। তার পরও মানুষ সচেতন হচ্ছে না। কাশি হলে অবহেলা করে দীর্ঘ দিন কাশিতে ভুগে আসছে এবং ফলে সেই রোগীর কাছ থেকে আরো দু-একজন আক্রান্ত হচ্ছে। আবার অনেকে প্রথম দিকে চিকিৎসা নিলেও চিকিৎসার মেয়াদ পূর্ণ না করেই ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে তারা এমডিআর বা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্টেন্সে আক্রান্ত হচ্ছে। এর ফলে নতুন করে যক্ষ্মার জন্য ওষুধ তৈরি করতে হবে, যা এখনো সহজ হচ্ছে না। ওষুধের মাত্রা বেশি হলে তার ক্ষমতা করতে থাকবে এটি অনেকেই বোঝে না। তাই এখানে জনগণকে সচেতন করতে হবে যে, ওষুধ খাওয়া কোনোভাবেই মাঝপথে ছেড়ে দেয়া যাবে না। যক্ষ্মা হলে দীর্ঘ দিন ওষুধ নিয়মিত খেয়ে যেতে হবে।
বাঁচতে হলে জানতে হবে যক্ষ্মা একটি জীবাণুঘটিত রোগ, যা মাইক্রো ব্যাকটেরিয়া টিউবারকুলোসিস (যক্ষ্মা জীবাণু) নামক জীবাণু দিয়ে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সংক্রমণ হয়ে থাকে। যক্ষ্মা দুই রকমের হয় ফুসফুসের যক্ষ্মা ও ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষ্মা। সমগ্র যক্ষ্মার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগের ঊর্ধ্বে ফুসফুসে আক্রান্ত রোগী রয়েছে। যক্ষ্মা রোগীর কফ, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু বের হয়ে বাতাসে মিশে ও শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তা সুস্থ ব্যক্তির ফুসফুসে ঢুকে বংশবৃদ্ধি করে। একজন যক্ষ্মা রোগীর জীবাণু চিকিৎসা ছাড়া সারা বছরে ১০ জন সুস্থ লোককে আক্রান্ত করতে পারে। এভাবে সে তার পরিবারের সদস্য ও আশপাশের ব্যক্তিদের মাঝেও রোগ ছড়াতে পারে। যক্ষ্মা কোনো মরণব্যাধি নয়। যক্ষ্মা হলে নিয়মিত পুরো মেয়াদের ওষুধ খেলে যক্ষ্মা রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়। এটি কোনো বংশগত রোগ নয়। তিন সপ্তাহ বা এর অধিক সময় কাশি থাকলে কফ পরীক্ষা করতে হবে। যক্ষ্মা রোগ সন্দেহ হলে ভয় বা সঙ্কোচবোধ না করে নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি ও থুথুর দ্বারা বাতাসের মাধ্যমে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়। তবে চিকিৎসা শুরুর দু’সপ্তাহ পর থেকে যক্ষ্মার জীবাণু বাতাসে ছড়ায় না। সব উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, নির্দিষ্ট এনজিও ক্লিনিক ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে কফ পরীক্ষা, চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান করা হয়। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লক্ষ্য, যক্ষ্মা জীবাণুযুক্ত রোগীর ৭০ শতাংশ শনাক্ত করা এবং তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৮৫ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করা। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ব্র্যাকের নেতৃত্বে ২৮টি এনজিও সারাদেশে কাজ করছে। কর্মসূচির আওতায় ২০১০ সালের মধ্যে শনাক্তকরণের হার ৭০ শতাংশ এবং শনাক্ত করা রোগীর ৮৫ শতাংশকে সুস্থ করে তোলার লক্ষ্যমাত্রা ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়েছে। ব্র্যাক বিনামূল্যে কফ পরীক্ষা ও ওষুধ সেবনের জন্য যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তাকে টিকা কেন্দ্র বলা হয় এবং এসব কেন্দ্রের ফলোআপের মাধ্যমে রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করে। ঢাকা শহরের আশপাশের এলাকায় ব্র্যাকের ১৮টি টিকা কেন্দ্র রয়েছে। যে কেউই এখানে এসে যক্ষ্মার পরীক্ষা থেকে শুরু করে সব ধরনের সহায়তা পেতে পারে।
————————
কামরুন নাহার
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৩০ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply