পাখির মতো চঞ্চল ছিল বুলবুলের জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে পাখির হঠা ৎ কী হলো। নেশা তাকে পেল। শিরাপথে নেশা নেয়। দিন দিন শুকায়। একদিন দেখা দিল কাশি। ওষুধপথ্য, অ্যান্টিবায়োটিক, কোনো কিছুই ধরে না। পরে পরীক্ষা করে জানা গেল, তার রক্তে বইছে এইচআইভি জীবাণু। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো সঙ্গে যোগ দিয়েছে যক্ষ্মা বা টিবি রোগ। এই এইচআইভি ও যক্ষ্মার দ্বৈত সংক্রমণে সে এখন কাহিল। দুই দানবে পর্যুদস্তু এক হাড়কঙ্কাল মানুষ। যক্ষ্মা ছাড়াও এইচআইভি বা এইডসে ফুসফুসের আরও কিছু রোগ বেশি বেশি চড়াও হয় রোগীর শরীরে। মোটা দাগে এগুলো হলো—
নিউমোনিয়া
নিউমোসিস্টিস ইনফেকশন
ফুসফুসের ফাঙ্গাস রোগ বা ছত্রাক সংক্রমণ
ফুসফুসে পানি জমা ইত্যাদি।
অনেক সময় দেখা যায়, রোগী ফুসফুসের সমস্যা যেমন শ্বাসকষ্ট, কফ-কাশি নিয়েই প্রথম চিকি ৎসকের কাছে ধরনা দেয়। পরে কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসে সাপ। বের হয়ে আসে রোগের পেছনে কলকাঠি নাড়তে থাকা অন্য এক রোগ—এইচআইভি বা এইডস! শরীরে এইডস হয়ে গেলে মানবদেহ সংক্রমণপ্রবণ হয়ে পড়ে অর্থা ৎ খুব সহজেই নানাবিধ জীবাণু তাকে কাবু করে ফেলে। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থায় যেসব জীবাণু শরীরের অন্যান্য কোষের সঙ্গে সহাবস্থান করে তারাই এইডস রোগীদের দেহে মরণছোবল হানার সক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। এ আঘাত হানার অন্যতম প্রধান স্থান আমাদের ফুসফুস।
টিবি-এইচআইভি
বিশ্বব্যাপী এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির এক-তৃতীয়াংশ একই সঙ্গে যক্ষ্মাতেও আক্রান্ত। এ যক্ষ্মা ফুসফুসে বা ফুসফুসবহির্ভূত অন্যান্য অঙ্গেও হতে পারে। টিবি-যক্ষ্মা মূলত অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের রোগ হলেও এইচআইভি বা এইডসের কারণে এর বিশ্বায়ন ঘটছে। পৃথিবীজুড়ে এখন যৌথ টিবি-এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ মিলিয়ন, যা নিরন্তর ধরাছোঁয়াহীন গতিতে বাড়ছে। কোনো কোনো দেশে প্রতি তিনজন টিবি রোগীর একজন একই সঙ্গে এইচআইভিতেও আক্রান্ত। যক্ষ্মা সংক্রমণ ও যক্ষ্মারোগ দুটি ভিন্ন জিনিস। স্বাভাবিক অবস্থায় যক্ষ্মা জীবাণুর সংস্পর্শে এলেও বহু বছর ধরে বা সারা জীবনেও যক্ষ্মারোগ নাও হতে পারে। এইচআইভির বেলায় ঘটনা কিন্তু ভিন্ন। শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় বলে যক্ষ্মা জীবাণুর সঙ্গ পেলেই তা যক্ষ্মারোগে রূপ নেয় অতিদ্রুত। তা ছাড়া এইডস রোগীদের দেহে কোথাও যক্ষ্মা হলে তা অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার প্রবণতা, সুপ্ত কোনো টিবির হঠা ৎ অগ্ন্যু ৎপাতের মতো জেগে ওঠা, নতুন বংশের কোনো জীবাণু দ্বারা পুনরায় আক্রান্ত হওয়া, ফুসফুস ছাড়াও অন্যান্য স্থানকে টার্গেট করা—সবকিছুই বেশি বেশি এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে।
লক্ষণাদি
জ্বর, ব্যাখ্যাতীত কারণে ওজন কমে যাওয়া, সঙ্গে রাতের বেলা ঘামানো যক্ষ্মার মূল লক্ষণ। ফুসফুসের যক্ষ্মা হলে কফ-কাশি থাকে, কখনো রক্তও যেতে পারে কাশির সঙ্গে। ফুসফুসের বাইরে অন্য কোথাও যক্ষ্মা হলে তার লক্ষণ আক্রান্ত স্থান অনুযায়ী দেখা দেবে। নিউমোনিয়ার চিকি ৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক আর ধরছে না—তখনই সন্দেহ করতে হবে এ যক্ষ্মা বা টিবিকেই।
রোগ নির্ণয়
এইচআইভি-আক্রান্তদের যক্ষ্মা শনাক্ত করাও বেশ কঠিন। কফে টিবি জীবাণু পরীক্ষা যক্ষ্মারোগ ধরার সর্বোত্তম উপায়। কিন্তু এদের কফে সাধারণত টিবির জীবাণু পাওয়া যায় না। বুকের এক্স-রেতে যা পাওয়া যায়, তা ঠিক টিবির মতো নয়, একেবারেই বেমানান অন্য রকম আবছায়া। কখনো বা আবার এক্স-রেতে কিছুই পাওয়া যায় না।
শিরাপথে নেশা ও অনিরাপদ শারীরিক মিলনসম্পর্ক পরিত্যাগ করে এইচআইভি প্রতিরোধ ও পরাজিত করতে না পারলে অদূর ভব্যিষতে এইডসের সঙ্গে এই টিবি, এমডিআর বা এক্সডিআর টিবি মানবজীবনের ওপর ভয়াবহ হুমকি হিসেবে দেখা দেবে, সংকটে পড়বে তিলে তিলে গড়ে ওঠা বিশ্বসভ্যতা।
আমিনুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ৩০, ২০১১
Leave a Reply