মাহমুদ সাহেবের হাঁপানি বা অ্যাজমার সমস্যা ছোটবেলা থেকেই। তাঁর জন্য শীতের সময়টা অত্যন্ত যন্ত্রণার। কেননা, এই শীতে ও শুষ্কতায় প্রতিবারই তাঁর শ্বাসকষ্ট ও কাশি বেড়ে যায়। তাঁকে শরণাপন্ন হতে হয় চিকিৎসকের। হাঁপানির প্রকোপ অনেক বেড়ে যায়। কয়েকবার শীতে তাঁকে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছে। মাহমুদ সাহেবের এ ধরনের হাঁপানিকে আমরা মৌসুমি হাঁপানি বা সিজনাল অ্যাজমা বলে থাকি। এটি একটি বিশেষ ধরনের অ্যাজমা, যা বিশেষ ঋতুতে বেড়ে যায়।
কোনো কোনো মানুষের শ্বাসনালি বিভিন্ন নিয়ামকের প্রতি অতিসংবেদনশীল থাকে। এই নিয়ামকগুলোকে, যেমন ধুলোবালি, ফুলের পরাগরেণু, কীটাণু ইত্যাদিকে বলা হয় অ্যালার্জেন। এই নিয়ামকগুলোর প্রতি তার বিশেষ অ্যালার্জি আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। প্রত্যেকের অ্যালার্জেন একই বস্তু না-ও হতে পারে। আবার ঋতুভেদে অ্যালার্জির চেহারাও পাল্টে যায়। এই হেমন্তে আর শীতে শুষ্ক বায়ু, ভাইরাস সংক্রমণ, সর্দিজ্বর ইত্যাদি অ্যালার্জির রোগীদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। আবার বসন্তে যখন প্রকৃতি জেগে ওঠে, পুষ্প-পল্লবে বৃক্ষরাজি পল্লবিত হয়, তখন পরাগরেণু ভেসে বেড়ায় বাতাসে। এরা হাঁপানির বড় শত্রু। গ্রীষ্মে অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও ঘাম-গরম অনেক সময় বাড়তি জ্বালার কারণ হয়ে ওঠে। তাই বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন নিয়ামক হাঁপানির রোগীদের জন্য অ্যালার্জেন হয়ে ওঠে।
প্রস্তুতি কী ও কীভাবে
হাঁপানির সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি হলো নিজের জন্য সংবেদনশীল এমন নিয়ামক বা অ্যালার্জেন সম্পর্কে অবগত থাকা এবং যথাসম্ভব তা এড়িয়ে চলা। ঋতু পরিবর্তনের সময় কী কী বিষয় আমাদের শ্বাসযন্ত্রে গোলমাল পাকিয়ে ফেলতে পারে, তা যদি পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে জানা থাকে, তবে প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হয়। যেমন, যার ফুলের রেণুতে সমস্যা, তার এ সময় পার্কে বেড়াতে না যাওয়াই ভালো। অতিরিক্ত ধুলো থেকে নাকমুখ বাঁচিয়ে রাখা উচিত, যার ধুলোয় অ্যালার্জি আছে। আরেকটা কথা, যাদের ফুসফুসে অ্যালার্জি আছে, তাদের অন্যান্য অঙ্গেও অ্যালার্জি থাকতে পারে, যেমন নাকে সর্দি বা অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বা ত্বকে ফুসকুড়ি, একজিমা ইত্যাদি থাকতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এদের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এ জাতীয় সমস্যার ইতিহাস থাকে।
এখন কীভাবে বুঝবেন যে আপনার এ ধরনের সমস্যা আছে? এ জন্য আপনার রোগের পূর্ণ ইতিহাস, বিশেষ বস্তুর প্রতি অতিসংবেদনশীলতার প্রমাণ, ঋতু-সম্পৃক্ততার নজির, পারিবারিক ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষাই রোগ নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট। কারও কারও রক্তে অ্যালার্জি প্রতিরোধক ইমিউনোগ্লোবিন আইজিই বেশি থাকতে পারে। তবে ত্বকে অ্যালার্জি টেস্ট নামে যে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে, তার প্রয়োজন ও কার্যকারিতা বিতর্কিত।
এ ধরনের রোগের কোনো স্থায়ী নিরাময় নেই। প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণই একমাত্র উপায়। প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি হচ্ছে নিজের রোগ, অ্যালার্জেন ও ঋতু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা। যেসব বিষয় অ্যালার্জি সৃষ্টি করে, তা থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকাই চিকিৎসার প্রথম ও সর্বোত্তম পন্থা। এ ক্ষেত্রে এই সময়ে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলতে পারেন। যেমন—
এক. খুব ধুলোবালির সময় জানালা বন্ধ রাখতে পারেন।
দুই. বিশেষ ঋতুতে জনবহুল ও খোলা স্থানে যেখানে অ্যালার্জেনের প্রকোপ বেশি, সেসব স্থান এড়িয়ে চলতে পারেন, যেমন মেলা, মার্কেট, পিকনিক, পার্ক ইত্যাদি।
তিন. যদি বাইরে বেশি বেরোতেই হয়, তবে নাকে মাস্ক ব্যবহার করেও সুফল পাওয়া যায়।
চার. ঘরদোর, বাড়ির আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখবেন, নিজেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবেন। তবে ঘর ঝাড়ু দেওয়ার সময় কাছে না থাকাটাই ভালো।
চার. পরিবেশ ও বায়ুদূষণ এসব রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই এ বিষয়ে সবারই সচেতন হওয়া উচিত।
হাঁপানির আক্রমণ কীভাবে সামলাবেন
এত সাবধানতার পরও যদি অ্যালার্জেনে আক্রান্ত হয়ে যান, তখন কী করবেন? চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ইনহেলার সাময়িক বা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবহার করতে পারেন। চিকিৎসক প্রয়োজন বোধে দু-একটি খাওয়ার ওষুধও দিতে পারেন। রোগের প্রকোপ যদি এত বেশি হয় যে তা নিদ্রাভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বারবার নেবুলাইজার মেশিনের সাহায্য নিতে হয় ইত্যাদি বিশেষ ক্ষেত্রে অনেক সময় চিকিৎসক স্বল্পকালীন স্টেরয়েড ট্যাবলেট ব্যবস্থাপত্রে দিতে পারেন।
তবে কখনোই তা দীর্ঘ মেয়াদে সেবন করবেন না, যদিও এই ওষুধে চমৎকার উপশম লাভ হয়। অনেকে এ কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই এ ধরনের ট্যাবলেট দিনের পর দিন খেয়ে থাকেন, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কখনো কখনো রোগের আক্রমণ এত গুরুতর হয় যে তা প্রাণসংহারিও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোগীকে অতিসত্বর হাসপাতালে নেওয়াই কর্তব্য। কেননা জরুরি ভিত্তিতে রোগীর অক্সিজেন, নেবুলাইজারের সাহায্য ও শিরায় স্টেরয়েড ইনজেকশন প্রয়োজন হতে পারে।
মোট কথা, এই শুষ্ক শীতের মৌসুমে যাদের হাঁপানি ও অ্যালার্জি আছে, তাদের একটু ভোগান্তি হতেই পারে। কিন্তু বর্তমানে রোগ নিয়ন্ত্রণের ও উপশমের আধুনিক পদ্ধতিও আছে হাতের কাছে। তাই একটু সাবধান ও সচেতন হোন, প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। শীত মৌসুমে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
আমিনুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৩, ২০১১
Leave a Reply