১৪ নভেম্বর স্যার ফ্রেডেরিক গ্রান্ট বেনটিং নামের এক অসাধারণ নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর জন্মদিন, ১৯২২ সালে যাঁর ইনসুলিন আবিষ্কার দুনিয়ার লক্ষ-কোটি ডায়াবেটিসের রোগীকে দেখিয়েছিল জীবনের আলো। তাই এই ১৪ নভেম্বর দিনটিকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) বেছে নেয় বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে। আজকের ৭০০ কোটি মানুষের এই বিশ্বে ২৮৫ মিলিয়ন মানুষ নীরব ঘাতক ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। ২০৩০ সালে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হতে যাচ্ছে। এই বিশালসংখ্যক ডায়াবেটিসের রোগীর ৭০ শতাংশেরই বসবাস দরিদ্র ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে স্বাস্থ্য তথা ডায়াবেটিস খাতে বার্ষিক বরাদ্দ সবচেয়ে কম। আর বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে বিশ্বে ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যার দিক দিয়ে অষ্টম দেশ। তাই ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর ধরে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের বক্তব্য একটাই—ডায়াবেটিস সম্পর্কে শিক্ষা নিতে হবে এবং একে প্রতিরোধ করতে হবে। একটি নীল বৃত্তের মধ্যে জড়ো হতে হবে বিশ্বের সবাইকে, যেখানে স্লোগান থাকবে—ডায়াবেটিসকে নিয়ে কাজ করুন, এখনই।
চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে এই অঞ্চলে মানুষের গড় আয়ু ছিল অনেক কম। কলেরা, ডায়রিয়া, বসন্ত ইত্যাদি সংক্রামক রোগের আক্রমণে উজাড় হতো গ্রামের পর গ্রাম। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি ও নিরাপদ পানি বা খাদ্যের সরবরাহ এসব সংক্রামক ব্যাধি থেকে আমাদের মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে অনেক। আর তাই বয়সজনিত জটিলতা, যেমন—ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, হূদেরাগ ইত্যাদি এখন হয়ে উঠেছে বড় ঘাতক। সত্তর দশকের শুরুতে প্রথম যখন আমরা ডায়াবেটিস নিয়ে এ দেশে কাজ করতে শুরু করি, তখন ডায়াবেটিসের প্রকোপ ছিল মোট জনসাধারণের মাত্র ১ শতাংশের মতো। আজ ৪০ বছর পর মোট জনগণের ৬ থেকে ৭ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী। বর্তমানে ২০ থেকে ৭৯ বছর বয়সী প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বাংলাদেশে এই ভয়ংকর ব্যাধিতে আক্রান্ত। আর আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে ডায়াবেটিস-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর অষ্টম দেশ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তাই আজ এক মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। ডায়াবেটিসের কারণে আমরা হারাব কর্মক্ষম ও সম্ভাবনাময় এক তরুণ যুবা প্রজন্মকে, যার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মন্দ প্রভাব গোটা জাতিকে স্থবির করে দেবে। ডায়াবেটিসের কারণে অন্ধত্ব, কিডনি ও হূদ্যন্ত্র বিকল হওয়া, পা কাটা যাওয়া হাজার হাজার রোগী নিজেদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে, পরিবারের ও সমাজের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। তাই এখনই সময় এই ব্যাধিকে প্রতিহত করার, প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আর এই প্রতিরোধ কেবল চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবকদের কাজ নয়, এটি হবে একটি সামাজিক প্রতিরোধ।
চিকিৎসার আগে প্রতিরোধ, কেন?
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এক অভাবনীয় দ্রুততার সঙ্গে আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম হয়ে যাচ্ছে শহর, শহর হয়ে যাচ্ছে বস্তি, জীবনযাত্রা পরিবর্তিত হচ্ছে দ্রুত, বাজার সংস্কৃতি ও প্রতিযোগিতা জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন স্ট্রেস বা চাপের। খাদ্যাভ্যাস, জীবনাচরণ, মানসিক গঠন, চাল-চরিত্র ও সংস্কৃতি পরিবর্তনের ধাক্কাগুলো এখানেই এসে লাগে বেশি। গবেষণাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ডায়াবেটিস রোগের জন্য পারিবারিক ও জেনেটিক ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ হলেও তৃতীয় বিশ্বে পারিপার্শ্বিক কারণগুলোই হয়ে উঠছে মুখ্য। স্থূলতা, মন্দ খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ, উত্তেজনা—এ সবই হচ্ছে ডায়াবেটিসের পারিপার্শ্বিক কারণ। অধিক ক্যালরিসমৃদ্ধ ও অধিক চর্বি-শর্করাজাতীয় খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস শিশু-কিশোরদের মধ্যে স্থূলতা বাড়াচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খেলার মাঠের অভাব, বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা-স্পোর্টস-খেলাধুলার সংস্কৃতির বিলোপ, টেলিভিশন-কম্পিউটার গেম-ফেসবুককেন্দ্রিক শহুরে অলস জীবন, গাড়ি-লিফট-চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহারের প্রবণতা, ছেলেবেলা থেকেই অত্যধিক প্রতিযোগিতা ও মানসিক চাপ। গ্রামের শিশুদের ছেলেবেলার অপুষ্টি এবং বড় হয়ে শহরে অভিবাসনের পর অধিক পুষ্টির মন্দ চক্রও এখানে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী। এই শিশু-কিশোরেরা তরুণ হতে না-হতেই পড়ছে ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ও হূদেরাগের ঝুঁকিতে। চল্লিশ না পেরোতেই আক্রান্ত হচ্ছে মারাত্মক সব রোগে। যে রোগগুলো আগে ৫০ বা ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে দেখা যেত, সেগুলো এখন ৩০-৪০ বছরের তরুণ যুবাদের আক্রমণ করছে। নষ্ট করে দিচ্ছে তাদের কর্মক্ষমতা ও সম্ভাবনাগুলো। গবেষকেরা বলেন, শতকরা ৫০ ভাগ ডায়াবেটিস ধরা পড়ার আগেই শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যেমন—চোখ, কিডনি, হার্ট, স্নায়ু ইত্যাদিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। তাই ডায়াবেটিস হওয়ার আগেই একে প্রতিরোধ করতে হবে। ডায়াবেটিসজনিত অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্বকে প্রতিরোধ করতে হলে গোড়ায় ঠেকানো ছাড়া বিকল্প নেই। আর শুধু জীবনযাত্রার একটুখানি পরিবর্তন, একটু সচেতনতা ও সদিচ্ছা শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করতে পারে।
প্রতিরোধ, কীভাবে?
ডায়াবেটিস রোগে প্রতিরোধ বলতে সুস্পষ্টভাবে তিন ধরনের বা তিনটি ধাপে প্রতিরোধ করার কথা বলা হয়। প্রথমটি হচ্ছে প্রাথমিক প্রতিরোধ বা প্রাইমারি প্রিভেনশন। অর্থাৎ রোগ হওয়ার আগেই একে প্রতিরোধ করা। রোগটি আদতে না হতে দেওয়া। এ জন্য চাই সামাজিক সচেতনতা। ছোটবেলা থেকেই সবুজ শাকসবজি, মাছ ও কম চর্বি-শর্করাযুক্ত খাদ্য গ্রহণে সবাইকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। ধূমপানের বিরুদ্ধে যেমন গণসচেতনতা গড়ে উঠেছে, তেমনিভাবে মন্দ খাদ্যাভ্যাসের বিরুদ্ধেও সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। শিশু, কিশোর ও বয়স্ক—সবার মধ্যেই কায়িক শ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খেলার মাঠ ছাড়া কোনো স্কুল-কলেজ থাকতে পারবে না। পাড়ায় পাড়ায় চাই পার্ক বা খোলা জায়গা, চাই হাঁটার উপযোগী ফুটপাত, সর্বোপরি নিরাপদে হাঁটার পরিবেশ। এই সচেতনতা গড়ে তুলতে পাঠ্যপুস্তকে সঠিক জীবনাচরণ সম্পর্কে তথ্য অন্তর্ভুক্তি, মিডিয়ার ব্যবহার, শিক্ষক-ধর্মীয় নেতা-সামাজিক নেতাদের প্রশিক্ষণ, সমাজকর্মীদের সচেতন করে তোলা, সচেতনতা ক্যাম্প ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিরোধের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদান। রোগের লক্ষণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে অবগতি, কখন কেন রক্তের চিনি পরীক্ষা করা জরুরি, শনাক্তকরণ পরীক্ষার সহজলভ্যতা ও ব্যয় সংকোচন—এই বিষয়গুলো সেকেন্ডারি প্রিভেনশনের আওতায় পড়ে।
চল্লিশ-পরবর্তী সব নাগরিকের অন্তত তিন বছর পরপর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা জরুরি। স্থূলতা, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি ঝুঁকি থেকে থাকলে বছরে একবার। গর্ভবতী হওয়ার পর অবশ্যই প্রতিবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু করলে অনেক জটিলতাই এড়ানো সম্ভব। তৃতীয় ধাপে আছে যাদের ইতিমধ্যে জটিলতা দেখা দিয়েছে তাদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া ও আরও জটিলতা এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। ডায়াবেটিস নীরবে রোগীর চোখ, রক্তনালি, হার্ট, কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র ও পদযুগলের ভয়ানক ক্ষতি করে থাকে। জটিল রোগীদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা ও পুনর্বাসন করাও ডায়াবেটিস চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আসুন, সবাই মিলে কাজ করি
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসা একটি সমন্বিত, সামাজিক পদক্ষেপ। সরকার, চিকিৎসক, কোনো প্রতিষ্ঠান বা কারও একার পক্ষে কখনো এই বিপুল কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সমাজের প্রতি স্তরে, পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত—সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে একে প্রতিরোধ করার জন্য। আসুন, একটি সুস্থ, কর্মোদ্যম ও প্রাণবন্ত জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবাই মিলে এই নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।
জাফর আহমেদ লতিফ
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
এন্ডোক্রাইন ও মেটাবলিজম বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল
ছবি: সৈকত ভদ্র
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৬, ২০১১
Leave a Reply