জীবনের পড়ন্ত বিকেল। খাবেন কেমন? অ্যান্টিঅক্সিডেন্টপূর্ণ খাবার খান। বার্ধক্যে শরীরের ভেতর যে অস্থায়ী অক্সিজেন অণুর সমাহার ঘটে, সেই ফ্রি রেডিকেলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য চাই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি পাওয়া যায় রঙিন শাকসবজি ও ফলে। রঙিন সবজি, বিট, মূল, টমেটো, জাম কত বলব? সুষম খাদ্যও পাবেন, আর ক্যানসার, হূদেরাগ এসব রোগের ঝুঁকিও হ্রাস পাবে। প্রতিদিন প্রচুর ফল ও শাকসবজি খাবেন। রঙিন সব সবজি আর ফল।
জলপাই তেলের কথা বলি। স্বাদু মনোআনস্যাচুরেটেড চর্বি। স্মৃতিশক্তির উজ্জীবকও বটে। এক্সট্রা-ভার্জিন জলপাই তেলে আছে ওলিওক্যানথল, যা প্রকৃতিজাত প্রদাহরোধী উপকরণ—বেদনাহর বটে। তেমন জলপাই তেল ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার করলে বাড়ে রক্তে হূদিহতকর এইচডিএল, রক্তনালির চর্বি সরিয়ে নিতে এর জুড়ি নেই।
জাম খাবেন প্রচুর
কালোজাম, গোলাপজাম। আবার স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি। আছে পলিফেনোলসমৃদ্ধ বেরি। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ঠাসা। এই শক্তিশালী যৌগগুলোর ক্ষমতা আছে ক্যানসার ও মগজের জরাকে ঠেকানোর।
মাছ মগজের খাদ্য
গোশত না খেয়ে মাছ খান। মাছের ঝোল। ভাপে সেদ্ধ মাছ, এমনকি সেদ্ধ মাছ ও সবজি, জলপাই তেল, সরিষা ও ভিনেগার, পুদিনা—এসব মিশিয়ে সালাদ। মজার খাবার। টুনা ও স্যামন মাছের কথা বলা হয়, তবে এ দেশের সাগরের মাছও খুব ভালো। মাছে আছে ডিএইচএ এবং ইপিএ মগজ ও স্নায়ুতন্ত্রের জন্য বড় তকর। এসব মেদঅম্ল খুব স্বাস্থ্যহিতকর। সপ্তাহে কয়েক বেলা মাছ খেলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমে অনেকটা। চর্বিযুক্ত মাছে আছে ওমেগা-৩ মেদঅম্ল। তা কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিনাবাইড কমাতে সহায়ক। প্রদাহ রোধ হয়, আর প্রদাহ রোধ হলে হার্টের বড় রোগ অ্যাথারোস্কেলরোসিস, হার্ট অ্যাটাকও প্রতিরোধ হয়।
আঁশ পেতে হলে বিনস
সপ্তাহে অন্তত চার-পাঁচবার খাবারে বিনস থাকা চাই, আঁশসমৃদ্ধ বিনস। আঁশ কমাতে সাহায্য করে রক্তচাপ, কোলেস্টেরলও কমায়, কোষ্ঠে বদ্ধ ভাব কমায়, হজমও বাড়ায়। পেট ভরাট লাগে দীর্ঘসময়, কম খেতে হয়, ওজন কমাতে তাই আঁশসমৃদ্ধ খাবার-সহায়ক। বিনস, যেমন—শিমের বীচি, মটরশুঁটি, বরবটি খাওয়া যায় নিরামিষে, এমনকি মাছের ঝোলে, গোশতের স্যুপেও। কেবল আঁশ কেন? বিনসে রয়েছে জটিল শর্করা, এতে রক্তে গ্লুকোজের মান নিয়ন্ত্রণ হয়, ডায়াবেটিস রোগীদের যা বেশি প্রয়োজন।
শাকসবজি খাওয়ার মূল্য সবাই তো জানেন না
ভেজ, ভেজি, সবজি যা-ই বলি, এতে রয়েছে আঁশ, ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট, প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ—ক্রনিক রোগ থেকে দেহ সুরক্ষায় বড় প্রয়োজন। গাঢ়-সবুজ পত্রবহুল সবজিতে ভিটামিন-কেও আছে মজবুত হাড়ের জন্য। মিষ্টিআলু ও গাজরে ভিটামিন-এ (বিটা ক্যারোটিন) চোখ ও ত্বক রাখে সুস্থ, সংক্রমণ থেকে দেয় সুরক্ষা। বেশি বেশি টমেটো খেলে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমে বলে জানান বিজ্ঞানীরা। তবে নির্ভেজাল হলে তবে তো!
গ্রিসের লোকদের মতো খেলে হয়
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ধারেকাছে যাঁদের বাস, তাঁদের খাবারে রয়েছে জলপাই তেল, মাছ, সবজি, গোটাশস্য এবং কদাচিৎ এক গ্লাস রেড ওয়াইন। নুন নিয়ে খাবারকে স্বাদু না করে মসলা ও গুল্ম যোগ করে সুবাস আনেন তাঁরা খাদ্যে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের এ খাদ্য হূদ্স্বাস্থ্যের অনেক উপকার করে, স্মৃতিশক্তি উজ্জীবিত রাখে, কিছু ক্যানসারও ঠেকায়।
বাদামে আছে অনেক পুষ্টি
গোটা বাদাম খান আর পিষে গুঁড়া করে পেস্ট বানিয়ে খান, বাদামে আছে প্রচুর কোলেস্টেরলমুক্ত প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ। কাঠবাদামে রয়েছে পর্যাপ্ত ভিটামিন-ই, যা নারীদের ক্ষেত্রে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশ কমায়। পিকান বাদামে বেশ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। আখরোটে আছে যে অসম্পৃক্ত চর্বি, তা ক্ষতিকর এলডিএল কমায় আর বাড়ায় এইচডিএল। তবে বাদাম চর্বিমুক্ত নয়। এক আউন্স আখরোট ২৪টি বাদামে আছে ১৬০ ক্যালরি। তাই এক মুঠের বেশি নয়।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য বড় ভালো
ভিটামিন-ডি ও ক্যালসিয়াম আছে দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যে। ভিটামিন-ডি ফরটিফাইড দুধ ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়ক। তাই যাঁদের ওস্টিওপরোসিস হওয়ার ঝুঁকি আছে, তাঁদের জন্য দুধ ভালো। ঘরে পাতা দই, টক দই খুবই স্বাস্থ্যকর।
গোটাশস্য ভালো
আটার রুটি, ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত কমায় কিছু ক্যানসার, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হূদেরাগের ঝুঁকি। বার্লি দিন স্যুপে। ওটমিল। আঁশ আছে। কমে কোষ্ঠ, সচল হয় অন্ত্র।
ওজন কমাতে হবে স্বাস্থ্যের জন্য
শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে রাখলে হাড়ের গিঁটে চাপ পড়ে কম। হার্টে চাপ পড়ে কম, ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে। তবে বুড়ো হলে ওজন ঝরানো আবশ্যক; পেশি শরীর দৃঢ় হয়ে যায়, বিপাক হয় শ্লথ। তবু চেষ্টা করা উচিত। নিয়মিত হাঁটা। প্রোটিন, যেমন—কৃশমাংস, মাছ ও বিনস। প্রচুর শাকসবজি-ফল, গোটাশস্য।
স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন
বয়স হলে, বুড়ো হলে অনেকের ওজনও কমে। ওজন বেশি-কম হলে অসুখ থেকে সেরে উঠতে, আঘাত থেকে সেরে উঠতে দেরি হয়। দিনে তিনবেলা আহার, মধ্যে নাশতা দুবার। স্বাস্থ্যকর নাশতা। ননী তোলা দুধের বদলে হোলমিলক। তবে সম্পৃক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরল পরিহার। প্রাতরাশে বেশি ক্যালরি খাবার, পরপর বেলায় কমাবেন।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০২, ২০১১
Leave a Reply