হৃদযন্ত্র নিয়ে কত কথা শুনি আমরা। নানা ধারণা হয় আমাদের। সবই কি সত্যি? জনরবে অনেক কথা থাকে ভুল, একে বিশ্বাস করে ভুগতে হয় আমাদের।
যেমন ধরুন, চিরায়ত চীনা চিকিৎসায় এস্ট্রাগেলাস মূল ব্যবহূত হচ্ছে হূদিচকিৎসায় শতাব্দী শতাব্দী ধরে। বলা হয়, এর মূল কাজ হলো দেহের প্রতিরোধের ব্যবস্থাকে উজ্জীবিত করা। তবে এর ব্যবহার হচ্ছে হৃদরোগেও। কিন্তু হৃদরোগের প্রকোপ না হলে তো একে প্রমাণ করার উপায় নেই।
হার্টকে নিয়ে মিথের অভাব নেই। যেমন, রক্তচাপ উঁচুতে উঠলে বা কোলেস্টেরল রক্তে বেশি হলে বুঝব নিজেই। ঠিক নয়। রক্তচাপ না মাপলে বা কোলেস্টেরল না মাপলে তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। ঝুঁকিগুলো অনেক সময়ই নীরব বিপদ, তাই সহযোগী উপসর্গ তেমন হয় না। উচ্চরক্তচাপ যখন মাথা ধরা বা কিডনি বিকল হওয়ার মতো সমস্যা নিয়ে ধরা পড়ে, তখন একে চিকিৎসা করা বড় কঠিন হয়ে পড়ে। আগাম চিকিৎসা বড় প্রয়োজন, দেহযন্ত্র বিকল হওয়া ঠেকাতে হলে। কিডনি বা হার্ট বিকল হলে একে খণ্ডন করা হলো দুঃসাধ্য কাজ। উঁচুমান কোলেস্টেরলের ব্যাপারেও তা-ই। রোগা-পাতলা শরীর, গড়ন ভালো, তার পরও রক্তে উঁচু কোলেস্টেরল থাকতে পারে। দ্বিতীয় মিথের কথা বলি। হূদরোগ নারী-পুরুষ সবার জন্য একই রকম। তা নয় কিন্তু। ভিন্নভাবে এর প্রভাব পড়ে।
যেমন উপসর্গ।
হার্ট অ্যাটাকের চিরায়ত উপসর্গ ‘বড় একটি হাতি বুকে চেপে বসে বুক গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।’—এমন উপসর্গ অনেকের নাও হতে পারে, বিশেষ করে মেয়েদের। ২০০৩ সালে হার্টের বিশ্বখ্যাত জার্নাল সার্কুলেশন-এ বেরিয়েছিল একটি গবেষণা নিবন্ধ। ৫১৫ জন নারী যাঁদের গড় বয়স ৬৬, এদের উপসর্গ পরীক্ষা করতে গিয়ে গবেষকেরা দেখলেন, এদের উপসর্গ হয়েছিল হার্ট অ্যাটাকের আগেই। অ্যাটাক হওয়ার প্রায় এক মাস আগেই ৭০ শতাংশ নারীদের অস্বাভাবিক ক্লান্তিবোধ হয়েছিল, ৫০ শতাংশ নারীর হয়েছিল দুর্বলতা বোধ, ঘুমের সমস্যা বা শ্বাসকষ্ট। আর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সময় ৪৩ শতাংশ নারীর বুকে তেমন ব্যথা হয়নি। বমিভাব বা বদহজম হয়েছিল কারও কারও। পুরুষদের হতে পারে, সচরাচর দেখা যায় না এমন উপসর্গ। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে তা বেশি। বয়স্ক নারীদের উপসর্গ পুরুষদের মতো—বুকব্যথা এসব। কী বোঝা গেল? অস্বাভাবিক উপসর্গ সব কটিই যে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ তাও নয়। তবে যদি ঝুঁকি থাকে, তাহলে খেয়াল করতে হবে বেশি।
নতুন কোনো উপসর্গ, পরিবর্তন হচ্ছে এমন উপসর্গ—খেয়াল রাখতে হবে। এমনও মিথ আছে: তরুণীদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কম। মাইরেস বলেন, ‘সবচেয়ে বড় মিথ হলো, এখনো নারীরা মনে করেন তাঁদের হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা খুব কম। তাঁদের ধারণা, এ রোগ হলো বুড়ো পুরুষ ও নারীদের রোগ। তাই ৪০ বা ৫০ বছর বয়স যে নারীদের এঁরা মনে করেন, তাঁরা ঝুঁকিমুক্ত।’ এ দেশের পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই, তবে আমেরিকার নারীদের এক নম্বর ঘাতক রোগ হৃদরোগ। বছরে এ জন্য মারা যান চার লাখ ৬০ হাজার নারী। নারীদের হার্টের রোগ বেশি হচ্ছে মধ্য ষাটে আর পুরুষদের মধ্য পঞ্চাশে। এ জন্য ইস্ট্রোজেনের ভূমিকা বলা হলেও কার্যকারণ সম্পর্ক স্পষ্ট নয়। এমনও মিথ চালু আছে যে হূদরোগ থাকলে ব্যায়াম করা খুব বিপজ্জনক। সত্যি নয় কথাটি। করোনারি অ্যাটাকের পরও লোকজনকে বিহারে ফিরে যেতে হয় সত্বর, প্রয়োজন হয় পুনর্বাসনের, দুই সপ্তার পর কর্মজীবনেও।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিতা রিডবার্গ বলেন, ব্যায়ামে হৃদরোগের অগ্রগতি শ্লথগতি হয়: আর যাঁদের হৃদরোগ আছে, তাঁদের প্রথম হার্ট অ্যাটাক হওয়া বা পুনঃ পুনঃ হার্ট অ্যাটাক হওয়া রোধ হয়। রিতা রিডবার্গের পরামর্শ: প্রথম প্রথম দিনে ১০ মিনিট ব্যায়াম দিয়ে শুরু এবং সপ্তাহে ১০ মিনিট করে ব্যায়াম বাড়ানো—এভাবে পর্যায়ক্রমে সপ্তাহের প্রায় দিন আধঘণ্টা করে মাঝারি মানের ব্যায়াম। চিকিৎসক দেবেন পরামর্শ ব্যক্তিভেদে।
অনেকের ধারণা, হার্টের জন্য অ্যাসপিরিন ও ওমেগা-৩ মেদাম্ল সবই ভালো।
হৃদরোগ ঠেকায়। কিছুটা সত্যি, তবু কথা আছে। রেডবার্গ পরামর্শ দেন, কোনো বিধিনিষেধ না থাকলে পুরুষদের জন্য ৫০ বছর বয়স হলেও নারীদের ৬৫ হলে প্রতিরোধের জন্য অ্যাসপিরিন দেওয়া যেতে পারে। অ্যাসপিরিন সেবন করলে পাকস্থলীর সমস্যা বাড়ে, অনেকের হতে পারে অ্যালার্জি। প্রতিটি সাপ্লিমেন্ট ও ওষুধের রয়েছে ভালো-মন্দ। জ্যাকসন বলেন, অ্যাসপিরিন খেয়ে হৃদরোগের হিত হওয়ার চেয়ে বড়ি খেয়ে পাকস্থলীতে রক্তক্ষরণের বিপদ অনেক বেশি। যাঁদের ইতিমধ্যে হার্টে সমস্যা এবং অন্য একটি আক্রমণ ঠেকাতে চান, এঁদের জন্য ওমেগা-৩ মেদ-অম্ল হিতকর হতে পারে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শ: সপ্তাহে অন্তত দুদিন চর্বিবহুল মাছ খাওয়া অথবা প্রতিদিন সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ৩ গ্রাম ওমেগা-৩ মেদাম্ল গ্রহণ। তবে উচ্চমাত্রা নিলে বিপদ। সবই গ্রহণ করা ভালো চিকিৎসকের পরামর্শে। অনেকের ভুল ধারণা, একবার হৃদরোগ হয়েছে, আর কিছু করা যাবে না। সত্যি নয় কথাটি। গবেষকেরা দেখেছেন, অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিকে খণ্ডানো যায়, প্রয়োজন হলো জীবনযাপনের পরিবর্তন।
ব্যায়াম করা, ফল, শাকসবজিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার, ধূমপান না করা, পার্শ্ববর্তী ধূমপায়ী লোকের ধোঁয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা—রোগ প্রতিরোধে বেশ কার্যকর এসব পরিবর্তন। মাইরেস বলেন, কখনো দেরি নয় এসব পরিবর্তন আনা, জীবনযাপনে ছোটখাটো পরিবর্তন হলো হৃদরোগ ঠেকাতে বড় ভূমিকা নেওয়া। ঝুঁকিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা আরও কার্যকর হয় প্রতিরোধে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৯, ২০১১
Leave a Reply