আমার কানে কোনো সমস্যাই ছিল না। ২০০২ সালের মার্চ মাসে ভাইরাল জ্বর হলো হঠাৎ। পরদিন কান দুটো বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকটা নিঃসীম আঁধারে হারিয়ে গেল যেন। অতিচেনা পৃথিবীর সব কোলাহল যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল আমি কোনো শব্দই শুনছিলাম না। এ এমন এক পরিস্থিতি ভুক্তভোগী ছাড়া কাউকে বোঝানো অসম্ভব বোধহয় বলছিলেন প্রফেসর ডা. এম এন ফারুক, বিভাগীয় প্রধান, নাক, কান গলা বিভাগ, ন্যাশনাল হাসপাতাল, ঢাকা।
২০০২ সালের এপ্রিলেই তার কানের অপারেশন ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি করিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ ওয়েলসের ভিনসেন্ট হসপিটালে। ডাক্তার ছিলেন সার্জন ডা. ফিলিপ। খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ লাখ টাকা।
এখন তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। ডিপার্টমেন্টাল কাজ, রোগী দেখা, অপারেশন করা এমনকি টেলিফোনে কথা বলা, গান শোনা কোনো কিছুতেই কোনো সমস্যা নেই। যারা কানে শোনে না কিংবা একেবারেই কম শোনে তাদের চিকিৎসায় ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি এক অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতি। কানে না শোনাকে আমরা বলি বধিরতা। বধিরতা জন্মগত হতে পারে কিংবা জীবনের যেকোনো সময় হতে পারে। সে কানে কম শুনতে পারে কিংবা একেবারেই শুনতে পারে না। যারা জন্মগত বধির তাদের স্বরযন্ত্র স্বাভাবিক থাকার পরও তারা কথা বলতে পারে না। মানুষ শুনে কথা বলতে শেখে, সে শুনতে পারে না তাই কথাও বলতে পারে না। জন্মগত বধিরতা সাধারণত হয়
জেনেটিক কারণে, নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলে সন্তানদের এরকম সমস্যা হতে পারে, যদি সন্তান মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় মায়ের রুবেলা হয়, যদি জন্মগত সিফিলিস থাকে, মায়ের যদি ভাইরাস সংক্রমণ হয়, জন্মের সময় যদি শিশুর অক্সিজেনের অভাব হয় কিংবা যদি প্রিমেচ্যুর বেবি হয়, যদি জন্মগতভাবে সে থাকে রিটেইন্ড। জীবনের অন্য কোনো সময় সাধারণত অন্তঃকর্ণের সমস্যা যেমন মাথায় আঘাত লাগে, কানে কোনো অপারেশনের পর যদি লেবিরিন্থে ইনফেকশন হয়, হাম, মাম্পস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, বসন্তের পরবর্তী জটিলতা হিসেবে বধিরতা দেখা দিতে পারে। উচ্চরক্ত চাপ, ডায়াবেটিস, ঠাণ্ডা সর্দিসহ অনেক অজানা কারণে এ সমস্যা হতে পারে। স্নায়ুতন্ত্রের টিউমার কিংবা আঘাত লেগে এমনকি অটোটক্সিক কিছু ওষুধের কারণেও শ্রবণযন্ত্রের সংবেদনশীল অংশ ককলিয়া নষ্ট হয়ে কানে শোনার ক্ষমতা হারাতে পারে।
আমাদের দেশে প্রায় ৩০ লাখ লোক বিভিন্ন মাত্রায় বধিরতায় ভুগছেন। প্রতি ১ হাজার শিশুতে ১ জন শিশু জন্মবধির হয়। গর্ভকালীন মায়ের সেবা, শিশুদের চিকিৎসায় সঠিক ওষুধের ব্যবহার তো নেই-ই উপরন্তু শিশুর অপুষ্টির সাথে বাড়ছে উচ্চমাত্রার শব্দ দূষণ! তাই বধিরদের সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলছে। নতুনতর চিকিৎসা ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি তাই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বহুল প্রচলন জরুরি। ককলিয়ার ইমপ্লান্ট একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র। যার একটি অংশ সার্জনরা অপারেশন করে কানের ভেতর বসিয়ে দেন যা আমৃত্যু কার্যকর থাকে। বাকি অংশটুকু কানের পেছনে লাগিয়ে শব্দ শোনা যায় প্রায় একেবারেই স্বাভাবিকের মতো। যারা কানে একটু-আধটু কম শোনে তারা হিয়ারিং এইড লাগিয়েই স্বাভাবিকের মতো শুনতে পারে। কিন্তু যাদের হিয়ারিং এইডেও কাজ হয় না কিংবা যারা একেবারেই শুনতে পায় না তাদের বেলায়ই ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করলে লাভ হবে। জন্মগত যাদের কানে শোনার সমস্যা তাদের বেলায় ১০ মাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করলে ভালো শুনবে। যাদের বয়স বেশি তারাও অপারেশনকালে শুনবে; কিন্তু ব্রেইন শব্দকে ভালোমতো বিশ্লেষণ করতে পারবে না। ফলে তার কথা শোনা ও বলায় সঠিক সমস্যা হবে না। এমনকি যারা জীবনের অন্য কোনো সময় বধির হয়েছে তাদেরও বধিরতা শুরুর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ অপারেশন করতে হবে। বধির অবস্থায় যত বেশি দিন কাটাবে ততই সে স্বাভাবিক শব্দগুলো ভুলতে থাকবে। ২-৫ বছর পর তার ব্রেইনও সঠিকভাবে শব্দগুলোকে বিশ্লেষণ করতে পারবে না।
ইমপ্লান্ট সার্জারির আগে অডিওসেটিং, সিটিস্ক্যান, এমআরআই করে দেখে নিতে হয় তার সমস্যাটা ককলিয়ার কি না। অপারেশনের পরবর্তী জটিলতা সামান্যই। আর দশটি সাধারণ অপারেশনের মতো।
অপারেশনের ১ মাস পর সুইচ অন করতে হয়। রোগী তখন শুনতে পায়। প্রশিক্ষিত ট্রেইনার স্পিচ থেরাপিস্ট তখন তাকে কথা বলতে শেখায়। তার মানে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির সফলতা নির্ভর করে সার্জন, অডিওলজিস্ট এবং স্পিচ থেরাপিস্টের সমন্বিত কার্যক্রমের ওপর।
তবে কানে না শোনার কারণ যদি স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা হয় তবে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করে আর লাভ নেই। তখন প্রয়োজন পড়ে অডিটরি ব্রেইনস্টেম ইমপ্লান্টের, যদিও এরকম ইমপ্লান্ট এখনো পৃথিবীতে বহুল প্রচলন ঘটেনি। বিদেশে এই ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির খরচ অনেক। যেমন সিঙ্গাপুরে ১৮-২০ লাখ, অস্ট্রেলিয়ায় ২৫-৩০ লাখ, আমেরিকায় ৭০-৮০ লাখ টাকা এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এর খরচ ১০-১২ লাখ টাকা। টাকার চেয়েও বড় সমস্যা হলো সেসব দেশে বাংলা শেখানোর টিচার পাওয়া দুষ্কর। অথচ আমাদের দেশে মাত্র ৭-৮ লাখ টাকায় সফলতার সাথে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করানো এখন সম্ভব। প্রেস কনফারেন্সে ২০ ফেব্রুয়ারি জানালেন প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ (প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, নাক, কান, গলা ও হেডনেক সার্জারি বিভাগ এবং অধ্যক্ষ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ) এবং তার বিভাগীয় বিশেষজ্ঞ সার্জনরা। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মিটফোর্ড হাসপাতালে সরকারিভাবে একটি ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি হয়েছিল। রোগী ছিলেন একজন ডেন্টাল সার্জন। তিনি এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। সাহিক ও বাংলাদেশ মেডিক্যালে দু’টি করে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট হয়েছে।
সার্জারি করেছেন ডা. ইকবাল ও ডা. হ্যান্সের মতো ইউকে এবং ভারতের প্রখ্যাত ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জনরা, সাথে ছিলেন মিটফোর্ড হাসপাতালের অভিজ্ঞ সার্জন টিম। প্রাথমিকভাবে সার্জারি সফল হয়েছে। ১ মাস পর সুইচ অন হলে নিশ্চয়ই রাহাত-সালমারা ফিরে পাবে স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু ৭-৮ লাখ টাকা ব্যয়ের এই ককলিয়ার কমপ্লান্ট আমাদের দেশের গরিবরা কিভাবে করাবে? সরকারি সহায়তা, এনবিআর, কাস্টমস যদি যন্ত্রটির ট্যাক্স ফ্রি করে দেয় কিংবা সাহায্যের এতটুকু হাত বাড়ায় বিদেশী দাতাসংস্থা কিংবা দেশী-বিদেশী দানশীল ব্যক্তিরা তবেই সম্ভব কম মূল্যে অত্যাবশ্যকীয় এই চিকিৎসা মানুষের দ্বারে পৌঁছে দেয়া। এ ছাড়া ব্যাংক সহজ শর্তে কল্যাণমুখী দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ঋণ দিতে পারে যা বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে। সর্বোপরি প্রয়োজন সাধারণ সচেতনতা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন।
—————–
ডা. অপূর্ব পণ্ডিত
সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার, নাক, কান, গলা বিভাগ, ন্যাশনাল হাসপাতাল, ঢাকা
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৩ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply