তিথির বয়স আট বছর। দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছে। তার ওজন ৫৫ কেজি। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ক্লাসে সে সবার চেয়ে মোটা ও লম্বা, বাড়ন্ত শরীর। মাঝেমধ্যে এর জন্য বিব্রত হতে হয়। মা-বাবাও উদ্বিগ্ন। বুঝতে পারছেন না, কী করবেন। এই যে বয়সের তুলনায় ওজন অনেক বেশি, এটাকে আমরা বলি অবেসিটি বা স্থূলতা। শিশু ও কিশোরদের মধ্যে স্থূলতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্থূলতা অনেক ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। অনেকেই জানতে চান, শিশু অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাচ্ছে কেন। স্থূলতার কারণগুলোকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করি।
বংশানুক্রমিক ধারা: মা, বাবা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে মোটা হওয়ার প্রবণতা থাকলে শিশুরাও মোটা হতে পারে। মায়ের যদি ডায়াবেটিস থাকে বা মা যদি মোটা হন, তাহলে নবজাতকের ওজনও বেশি হয়। শৈশবে শিশুদের ওজন বেশি থাকলে পরবর্তী সময়েও তারা মোটা হতে থাকে।
হরমোনজনিত কারণ: শরীরে কোনো কোনো হরমোনের তারতম্য হলে শিশুরা স্থূল হতে পারে।
পরিবেশগত কারণ: এর মধ্যে আছে শিশুর জীবনাচরণ; যেমন—দৈনন্দিন কাজ, খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক শ্রম।
শিশুর জীবনাচরণ ওজন বাড়ার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। আমাদের শৈশবের কথা যদি আমরা মনে করি, তাহলে বর্তমান সময়ের শিশুদের জন্য আমাদের কষ্ট হয়। আমরা স্কুলে, বাইরে অবারিত মাঠে খেলাধুলা করেছি, সাঁতার কেটেছি, হেঁটে স্কুলে গিয়েছি এবং বাসায় নিজের কাজ নিজেরাই করতে চেষ্টা করেছি।
এখনকার শিশুরা খেলাধুলার সুযোগ পায় না। টেলিভিশন দেখে, ভিডিও গেম খেলে আর কম্পিউটারের বোতাম টিপে সময় কাটায়। অনেক শিশু, বিশেষ করে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা আঁশযুক্ত খাবার, যেমন—শাকসবজি, ফলমূল খেতে চায় না। ফাস্টফুড, চকলেট, কোমল পানীয়, ফলের রস বেশি খায়। শারীরিক শ্রমে যেটুকু শক্তি ব্যয় হয়, তার চেয়ে বেশি ক্যালরি খাওয়া স্থূলতার প্রধান কারণ। তা ছাড়া একটু বড় হয়ে শিশুরা কিছু কাজ বাসায় করতে পারে; যেমন—নিজের বইখাতা, ব্যাগ, কাপড় গুছিয়ে রাখা; ঘর পরিষ্কার করা, বাসায় অন্যান্য কাজে মা-বাবাকে সাহায্য করা। কিন্তু আজকের শিশুরা এসব কাজে কোনো আগ্রহ দেখায় না। এমনকি নিজের কাজেও অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে। শিশুর ওজন বেড়ে গেলে পরবর্তী সময়ে অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ ব্যাপারে অনেক মা-বাবাই সচেতন নন।
স্থূলকায় শিশুদের জটিলতাগুলো হলো—
রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া।
উচ্চ রক্তচাপ, হূৎ পিণ্ডের সমস্যা।
ডায়াবেটিস, হাড় ও গিঁটে ব্যথা।
শ্বাসকষ্ট, ঘুম ঘুম ভাব, ঘুমের মধ্যে নাকডাকা, ঘুমের ভেতর শ্বাসকষ্ট হওয়া।
পিত্তথলিতে পাথর বা প্রদাহ, চর্বি জমে লিভারের স্থায়ী সমস্যা।
অল্প বয়সে দাড়ি-গোঁফ ওঠা বা মেয়েশিশুদের মাসিক হয়ে যাওয়া।
ঘাড় ও ভাঁজে ভাঁজে কালো দাগ দেখা দেওয়া।
শারীরিক ও মানসিক অবসাদ।
স্থূলতা রোধে মা-বাবার করণীয়
শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ দেওয়া। কৌটার দুধ বা কৃত্রিম খাবার খেলে শিশু দ্রুত মোটা হয়ে যায়।
ছয় মাস বয়স থেকে পরিবারের খাবার, যার মধ্যে অবশ্যই শাকসবজি, ফলমূল থাকবে। ভাত, আলু, মিষ্টি কম খেতে দিতে হবে যদি শিশুর ওজন বেড়ে যেতে থাকে। ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, চকলেট, আইসক্রিম কম খেতে দিতে হবে।
শিশুকে নিজের কাজ করতে উৎ সাহিত করতে হবে।
বাইরে খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে।
মনে রাখবেন, স্থূলতা একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। শিশুর ওজন বেড়ে গেলে তা বাড়তেই থাকে। শিশুর জীবনযাপন পরিবর্তনে মা-বাবার সচেতনতাই স্থূলতাকে প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট। আপনার শিশু ও আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
তাহমীনা বেগম
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
বারডেম ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৫, ২০১১
Leave a Reply