১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ বার্লিনে ডা. রবার্ট ককস যক্ষ্মার মারাত্মক জীবাণু মাইকো ব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস চিহ্নিত করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এই আবিষ্কারের ফলে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্ভব হয়। যক্ষ্মার জীবাণুকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার ৭০ বছর পর যক্ষ্মার চিকিৎসা উদ্ভাবিত হয়। কার্যকর ওষুধ বাজারে আসতে কেটে যায় আরো কয়েক বছর। তবে কার্যকর কোনো ওষুধ না আসার কারণে এবং লোক জানাজানির ভয়ে এ রোগকে নীরবে চেপে রাখতেন অনেকেই। ১৯৮২
সালে ডা.
ককস ঘোষণার শতবর্ষ পালনের বছরে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়।
প্রতি দু’মিনিটে একজন করে মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। কেবল যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুবরণ করে প্রতি বছর ৭০ হাজার মানুষ; অর্থাৎ প্রতি ১০ মিনিটে একজন যক্ষ্মায় মৃত্যুবরণ করে। তবে প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী সংক্রামক যক্ষ্মা রোগীদের সঙ্গে চলাফেরা, ওঠাবসার দরুন বছরে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১০৫ জন লোক সংক্রামক যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয় এবং ২৩৪ জন নতুন যক্ষ্মা রোগী সংক্রামক ও অসংক্রামক সব ধরনের যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি বছর সংক্রামক যক্ষ্মা রোগীদের সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার নতুন সংক্রামক যক্ষ্মা রোগী। এছাড়াও বছরে নতুন সংক্রামক ও অন্যান্য যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে আরো প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার।
সংক্রামক রোগের মধ্যে মহিলা মৃত্যুর একমাত্র এবং প্রথম কারণ যক্ষ্মা। উন্নয়নশীল দেশে যক্ষ্মা রোগীদের প্রায় ৭৫ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ উপার্জনক্ষম বয়সে। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ড যে কোনো একজন মৃত্যুবরণ করে। একজন সংক্রামক যক্ষ্মা রোগী ১০-১৫ জনকে আক্রান্ত করে। এ কারণেই বিশ্ব স্বাস্হ্য ১৯৯৩ সালে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণকে আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্হা বলে ঘোষণা করেছে। যক্ষ্মা ধনী, দরিদ্র, সাদা-কালো, শিশু-বৃদ্ধ যে কোনো বয়সে হতে পারে। শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে যক্ষ্মা হতে পারে না; যেমন-হাড়, জোড়া, চর্ম, চক্ষু, কিডনি, মস্তিষ্ক, অন্ত্র, গ্রন্হি ইত্যাদি। তবে ফুসফুসের মধ্যেই যক্ষ্মা বেশি হয় এবং রোগ ছড়ায়। এ রোগের ভয়াবহতা আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে উন্নত দেশগুলোয়। এইডস রোগীর সংখ্যা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোয় দরিদ্র লোকের সংখ্যা বৃদ্ধিই এর কারণ। তাই যক্ষ্মা রোগ নিরাময় এবং নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে উন্নয়নশীল দেশসহ সারা বিশ্বের জন্য। যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়লে মানসম্মত ওষুধ নিয়মিত ৬ মাস সেবন করলে এ রোগ সম্পুর্ণ ভালো হয়ে যায়। আর এ কারণেই যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসুচিতে ডটস অর্থাৎ শর্ট কোর্স কেমোথেরাপি ষ্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করা হয়েছে। ডটস নতুন কোনো চিকিৎসা ব্যবস্হা নয়, এটি একটি পদ্ধতি। নিয়মানুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রোগীকে ওষুধ সেবন নিশ্চিত করাই হচ্ছে ডটস পদ্ধতির মুল উদ্দেশ্য। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশেষ করে কফ পরীক্ষা করে রোগ শনাক্ত করা হয়; তারপর যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু করা হয়। এই পদ্ধতিতে স্বল্পমেয়াদি কেমোথেরাপি রেজিম দেয়া হয়। অর্থাৎ মাত্র ৬ মাস যক্ষ্মার ওষুধ সেবন করতে হয়। এর মধ্যে প্রথম ২ মাস মোট ৪টি ওষুধ এবং পরবর্তী ৪ মাস শুধু ২টি ওষুধ সেবন করতে হয়। রোগী প্রতিদিন স্বাস্হ্যকেন্দ্রে এসে একজন স্বাস্হ্যকর্মীর মাধ্যমে ওষুধ সেবন করে যাবেন। এভাবে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রোগীর চিকিৎসা চলবে। আর স্বাস্হ্যকর্মীর দায়িত্ব হচ্ছে রোগীর ওষুধ সেবন নিশ্চিত করা।
যক্ষ্মার ভয়াবহতা অনুধাবন করে বাংলাদেশে যক্ষ্মার সংক্রমণ কমানোর লক্ষ্যে দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য বিশেষ করে ছোঁয়াচে যক্ষ্মা রোগীর দ্রুত চিকিৎসা এবং যক্ষ্মার সংক্রমণ রোধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্হ্য মন্ত্রণালয় ১৯৯৩ সালে বহুল আলোচিত ডটস কার্যক্রম হাতে নেয়। এ কার্যক্রমের লক্ষ্য হচ্ছে ৭০ শতাংশ ছোঁয়াচে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা এবং তার ৮৫ শতাংশ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগমুক্ত করা। ডটস কার্যক্রমে চিকিৎসার ব্যয় খুবই কম এবং যেহেতু রোগী প্রথম ২ মাস স্বাস্হ্য প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট স্বাস্হ্যকর্মীর কাছে উপস্হিত হয়ে নিয়মিত ওষুধ খেয়ে থাকেন, তাই অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে রোগ নিরাময় আশাব্যঞ্জক। এ কার্যক্রম সফল করে তোলার জন্য প্রয়োজন জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকারের অঙ্গীকার। কাশি পরীক্ষার মাধ্যমে সাধারণ স্বাস্হ্য ব্যবস্হায় যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত করা, জ্ঞানসম্পন্ন শর্ট কোর্স কেমোথেরাপি রেজিম ঠিক করা, নিয়মিত যক্ষ্মা রোগের ওষুধ সরবরাহ করা এবং এ কর্মসুচির তত্ত্বাবধান ও মুল্যায়ন লিপিবদ্ধ করা। এ পদ্ধতির সুফল বহুবিধ; যেমন তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয়, সম্পুর্ণ রোগ নিরাময়, মৃত্যুর হার ও মাল্টি-ড্রাগ রেজিষ্ট্যান্ট যক্ষ্মার হার কমা এবং রোগে আক্রান্তের হার কমা ইত্যাদি। তাই বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে নিয়মিত এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী বর্তমানে এ কার্যক্রমের আওতাধীন আছে।
দেশের ছোঁয়াচে রোগীর ৪৬ শতাংশ বর্তমানে রোগ নির্ণয় শেষে চিকিৎসা পাচ্ছে। ফলে যক্ষ্মা আক্রান্ত ৮৪ শতাংশ রোগী রোগমুক্ত হচ্ছে।
——————————
ডা. এস এম মোস্তফা জামান
বক্ষব্যাধি ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ, ঢাকা। চেম্বারঃ ল্যাবএইড লিমিটেড, বাড়ি-১, রোড-৪, ধানমন্ডি, ঢাকা।
আমার দেশ, ১৮ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply