এক মাস রোজা রাখার পরই মানুষের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে। ৩০ দিনের উপবাসের পর এদিন মানুষ খাবারের ব্যাপারে বেশ স্বাধীনতা অনুভব করে। কারণ, উপবাসের বিধিনিষেধ থেকে এদিন মুক্ত হয়। উৎসবের শুরুটাই হয় সুস্বাদু মিষ্টিজাতীয় খাবার দিয়ে। তারপর বিরতিহীনভাবে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে অতি সুস্বাদু বিভিন্ন ধরনের উচ্চ ক্যালরি ও অতিরিক্ত মসলাযুক্ত গুরুপাক খাবার দিয়ে। রোজার সময় মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন প্রণালিতে অনেকখানি পরিবর্তন আসে। মানুষ সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এর পরই হঠাৎ এক দিনে অতিভোজনের ফলে পাকস্থলীর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কারণ, অধিক চাপে পাকস্থলীর এনজাইম ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে পেটে ব্যথা, গ্যাসট্রাইটিস, ডায়রিয়া, মাথাধরা, বমি ইত্যাদি হতে দেখা যায়।
এ ছাড়া দীর্ঘস্থায়ীরূপে দেখা দেয় আইবিএস বা ইরিটেবল বা ওয়েল সিনড্রোম। এ জন্য খেতে হবে নিজ নিজ শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে।
ঈদের দিনে প্রতিটি বাড়িতেই থাকে মিষ্টান্নের ব্যবস্থা। যেমন—সেমাই, জর্দা, হালুয়া, পায়েস, পুডিং প্রভৃতি। এর পাশাপাশি থাকে ঝাল ও নোনতা খাবার। যেমন—পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, কাবাব, চটপটি, রেজালা, নুডল্স, ফুচকাসহ বিভিন্ন রকমের খাবার। আরও থাকে মুরগি-খাসি এবং মাছের কোরমা, মুরগির রোস্ট প্রভৃতি।
ঈদের দিন নারকেলের ব্যবহার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি হয়। হাতে কাটা চালের গুঁড়ার সেমাইয়ের সঙ্গে বা গুড়ের পায়েসের সঙ্গে নারকেলের ব্যবহার দেখা যায়। এ ছাড়া নারকেলের দুধ ব্যবহার করা হয় মুরগি, খাসির মাংস ও পোলাও রান্নার ক্ষেত্রে। গুড়ে লৌহ ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি রয়েছে। পুষ্টির দিক থেকে নারকেলও ভালো। এটি অনেকটা সহজপাচ্য এবং ক্যালরি ও চর্বিসমৃদ্ধ। সুস্বাদু তো বটেই। তবে যাঁদের রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লাইসেরাইডের পরিমাণ বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে নারকেল বর্জনীয়।
১০০ গ্রাম নারকেলে রয়েছে ৬৬২ ক্যালরি, ৬ দশমিক ৮ গ্রাম আমিষ, ৬২ দশমিক ৩ গ্রাম চর্বি, ১৮ দশমিক ৪ গ্রাম শর্করা ও ৪০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। মিষ্টি খাবার তৈরিতে পেস্তা, বাদাম, কিশমিশের ব্যবহার হয়। এগুলো যেমন পুষ্টিকর, তেমনি খাবারের স্বাদ ও শোভা বাড়ায়। ঈদের রান্নায় দই ও দুধ ব্যবহার হয়ে থকে।
দুধের প্রোটিন উৎকৃষ্ট মানের। মানুষের অন্ত্রে অনেক সময় জীবাণুর সংক্রমণের ফলে উদ্বায়ু, কোষ্ঠকাঠিন্য, গাঁজানো, পচন ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়। দইয়ে নিহিত ল্যাক্টোবেসিলি বুলগেরিকাস নামের ব্যাকটেরিয়া এই অসুবিধাগুলো দূর করতে সাহায্য করে। ঈদের ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবারগুলো বেশ গুরুপাক। এ জন্য এসব খাবার তৈরি করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে অধিক ঝাল, মসলা, ঘি ও ডালডার প্রয়োগ না ঘটে। ঘি ও ডালডার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে উদ্ভিজ্জ তেল ব্যবহার করাই ভালো। এ ছাড়া যাঁদের পেটের সমস্যা আছে, তাঁদের জন্য রোস্ট বা রেজালার পরিবর্তে হালকা রান্নার কোরমা করা যেতে পারে। পোলাও-বিরিয়ানি খেতে অসুবিধা থাকলে পোলাওয়ের চালের ভাত অথবা ফ্রায়েড রাইস করে খাওয়া যেতে পারে। ডায়াবেটিসের জন্য যাঁদের চিনি ও গুড় খাওয়া নিষেধ, তাঁরা বিকল্প চিনি দিয়ে মিষ্টান্ন তৈরি করে খেতে পারেন।
ঝাল খাবারগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের চাটনি রাখা যেতে পারে; যাতে খাবারে অরুচি না হয়। পুদিনা পাতা, ধনেপাতা, তেঁতুল, জলপাই, টমেটো, রসুন—এসব দিয়ে চাটনি করা যায়। এগুলো স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। এ ছাড়া লেবু ও টক-মিষ্টি দই রাখা যেতে পারে। ঈদের খাবারের আয়োজনে ফালুদা, ফলের সালাদ অথবা বিভিন্ন ধরনের আস্ত ফল অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন টেবিলের শোভাবর্ধন হয়, অন্যদিকে খনিজ লবণ ও ভিটামিনের অভাব পূরণ হয়।
ঈদের দিনে যত ভালো ও সুস্বাদু খাবারের আয়োজন থাকুক না কেন, মাত্রাজ্ঞান রেখে নিজ নিজ স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাবার গ্রহণ করতে হবে।
যেমন—যাঁদের হার্টের অসুখ, তাঁদের খাবারে চর্বি ও ঘি পরিহার করতে হবে। তেমনি কিডনির সমস্যা থাকলে অধিক মাছ-মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
এক মাসের অনভ্যস্ত পাকস্থলী হঠাৎ অধিক খাবারের চাপ সহ্য করতে পারে না বলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি হতেও দেখা যায়। এ কারণে খাবার হবে পরিমিত এবং সময়জ্ঞান রেখে বিরতি দিয়ে খাওয়া উচিত। সারা দিন ধরেই খাওয়া নয়, যখন-তখন খাওয়া নয়।
তাহলেই সুস্থ থাকা যাবে। খাবার হবে স্বাস্থ্যসম্মত ও সহজপাচ্য। পরিবেশিত হবে পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয়ভাবে। খাবারের টেবিলে একগুচ্ছ তাজা ফুল থাকলে আরও ভালো হয়।
আখতারুন নাহার আলো
প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা
বারডেম জেনারেল হাসপাতাল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৪, ২০১১
Leave a Reply