আজকাল বাজারে ফলমূলের দোকানে গেলে মৌমাছি চোখে পড়ে না, মাছের বাজারে নেই মাছের গন্ধ আর মাছির আনাগোনা। এর কারণ কী? উত্তর একটাই—তা হলো, মাছে ফরমালিন মেশানোর ফলে বাজারে মাছের আঁষটে-পচা দুর্গন্ধ আর থাকে না। একইভাবে কোনো ফলমূলের দোকানেও মৌমাছির আনাগোনা নেই বললেই চলে। কারণ, কারবাইড মেশানোর কারণে মৌমাছি আর মধু আহরণ করতে ওই ফলে যায় না। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এগুলো বেশিদিন তাজা রাখার উদ্দেশ্যে ফরমালিন, কারবাইড ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় দুধ, ফল, মাছ-মাংস এমনকি শাক-সবজিতেও ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কারবাইডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করে থাকে। এসব কেমিক্যাল একধরনের বিষ, যা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হবে না; কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে।
এমনও শোনা যায় যে অনেক ব্যবসায়ী ফরমালিন পানিতে মিশিয়ে বরফ তৈরি করেন, আর সেই বরফে মাছ-মাংস সংরক্ষণ করেন। বাজারে আম, জাম, কলা, লিচু, পেঁপে—সব কিছুতেই কারবাইড মেশানো হয় এবং অনেক সময় ভেজালবিরোধী অভিযানে এসব ধ্বংসও করা হয়।
ফরমালিন সাধারণত মানুষের লাশসহ মৃত প্রাণীকে তাজা রাখতে ব্যবহার করা হয়। ফরমালিনে ফরমালডিহাইড ছাড়াও মিথানল থাকে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। লিভার বা যকৃতে মিথানল এনজাইমের উপস্থিতিতে প্রথমে ফরমালডিহাইড এবং পরে ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়। দুটোই শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফরমালডিহাইড চোখের রেটিনাকে আক্রান্ত করে রেটিনার কোষ ধ্বংস করে। ফলে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কারবাইডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে পেটের পীড়া, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে এসব রাসায়নিক পদার্থ লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন—সবকিছুুকে ধ্বংস করে দেয়। লিভার ও কিডনি অকেজো হয়ে যায়। হার্টকে দুর্বল করে দেয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়। শেষ পর্যন্ত ফরমালিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যানসার হতে পারে। অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হওয়ার ফলে রক্তশূন্যতাসহ অন্যান্য রক্তের রোগ, এমনকি ব্লাড ক্যানসারও হতে পারে। এতে মৃত্যু অনিবার্য। মানবদেহে ফরমালিন ফরমালডিহাইড ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়ে রক্তের এসিডিটি বাড়ায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। ফরমালিন কেবল ভোক্তাদের জন্য নয়, ফরমালিনযুক্ত মাছ বিক্রেতাদের জন্যও ক্ষতিকর।
ফরমালিন ও অন্যান্য কেমিক্যাল সামগ্রী সব বয়সী মানুষের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে। ফরমালিনযুক্ত দুধ, মাছ, ফলমূল এবং বিষাক্ত খাবার খেয়ে দিন দিন শিশুদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট, বিকলাঙ্গতা, এমনকি মরণব্যাধি ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোরেরা। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা দিন দিন কমছে। বয়স্ক লোকেরাও এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া গর্ভবতী মেয়েদের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা, বাচ্চার জন্মগত দোষত্রুটি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে, প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হতে পারে।
এ ধরনের খাদ্য খেয়ে অনেকে আগের তুলনায় এখন কিডনি, লিভারের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগের সমস্যায় ভুগছেন। দেখা যাচ্ছে, কয়েক দিন পরপর একই রোগী ডায়রিয়ায় ভুগছেন, পেটের পীড়া ভালো হচ্ছে না, চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
একবার চিকিৎসা শেষে আবারও তাঁরা একই রোগ নিয়ে হাজির হচ্ছেন। আগে হাসপাতাল-ক্লিনিকে এত রোগী দেখা যেত না। ফল-দুধ-মাছ-মাংসে বিভিন্ন কেমিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব এ অবস্থার অন্যতম কারণ।
এই বিষক্রিয়ার ফল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর হবে ভয়াবহ। আজকের শিশুরাই তো আগামীর ভবিষ্যৎ। ভেজাল খাবার কিংবা বিষাক্ত কেমিক্যাল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এটা সাদা চোখে দেখা না গেলেও ধীরে ধীরে এর খারাপ ফলাফল আমরা পাব। মানুষকে ঘন ঘন হাসপাতালে যেতে হবে। এতে দিন দিন মানুষের চিকিৎসা-ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। শিশুরা কম বুদ্ধিসম্পন্ন হবে, স্মৃতিশক্তি থাকবে না, শরীরে শক্তি থাকবে না, ভারী কোনো কাজ করতে গেলে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। এরাই তো একসময় দেশের নেতৃত্বে আসবে। বিভিন্ন পেশায় কম মেধাসম্পন্ন লোক ভরে যাবে। এদের মধ্যেই কেউ ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবে, কেউ সচিব হবে, কেউ রাজনীতিবিদ হবে। মোটকথা, একসময় পুরো জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। দেশ ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
এ থেকে প্রতিকার পেতে হলে সাধারণ মানুষকে বেশি সচেতন হতে হবে। বাজারে ফল-মূল দেখে-শুনে কিনতে হবে। জনগণকে ফরমালিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানাতে হবে।
সরকারকে আইনের মাধ্যমে এ সমস্যা নিরসন করতে হবে। ভেজাল ও বিষাক্ত খাবার থেকে নিরাপদ থাকতে ভেজালবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। দেখা যায়, আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় ভেজাল রোধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এমনকি আইনে মাছ, মাংস, ফলমূল ও সবজির ভেজাল পরীক্ষারও কোনো বিধান নেই। যারা খাবারে ভেজাল মেশায়, পরোক্ষভাবে তারা পুরো জাতিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ জন্য তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া উচিত। সরকার কঠোর হলেই খাবারে ভেজাল দূর করা সম্ভব। খাদ্যে ভেজাল পরীক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিতে হবে। প্রতিটি খাবার ভেজাল পরীক্ষা করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। ভেজালকারীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ফরমালিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। মাঝে ভেজালবিরোধী অভিযানের সময় খাবারে ভেজাল দেওয়া কিছুটা কমে গিয়েছিল। মানুষও সচেতন হয়েছিল। কিন্তু এখন আবারও খাবারে ভেজালের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
জনগণের সম্পৃক্ততা, সচেতনতা ও সরকারি উদ্যোগের দৃঢ়তার মাধ্যমেই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।
এ বি এম আবদুল্লাহ
ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক
মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৩, ২০১১
Leave a Reply