বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর হারের তুলনায় সারা পৃথিবীতে সংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। এক ধরনের ক্ষুদ্র জীবাণুর দ্বারা এই ব্যাধি ছড়ায় এবং সেই সকল জীবাণু বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান রয়েছে। বাতাস, পানি এবং মাটিতে এই রোগ-জীবাণু অবস্থান করে। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে খাবার, পানীয়, এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমেও এই রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাছাড়াও জীবজন্তু ও পোকা-মাকড়ের কামড়, চুম্বন ও যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে এই রোগের বিস্তার ঘটে থাকে। সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগের জীবাণুকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যথাঃ
-ব্যাকটেরিয়াঃ এক কোষী জীবাণু যা অতি অল্প সময়ের মধ্যে বহুগুণ বংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম এবং তার লালা নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ মানুষের রোগ সৃষ্টি ও অসুস্থতা ঘটিয়ে থাকে।
-ভাইরাসঃ এক ধরনের জীবকোষ যা মানুষের দেহের কোষের মধ্যে অবস্থান করে বংশ বৃদ্ধি করে থাকে।
-ছত্রাকঃ আদি শাক-সবজি সাদৃশ্য, যেমন-মাসরুম।
-প্রোটোজোয়াঃ এক কোষী পরজীবী জীবাণু যা অপরাপর জীবজন্তুকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে এবং জীব দেহে বসবাস করে থাকে।
সংক্রামক রোগ দৃশ্যমান হয় এবং তা আক্রান্ত ব্যক্তির প্রভূত ক্ষতি সাধন করে থাকে। মানব দেহে এই রোগ সৃষ্টি হয় এক অথবা একাধিক ধরনের জীবাণুর সাহায্যে যথাঃ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং এক কোষী জীবন্ত জীবাণু বা বহুকোষী বিচিত্র ক্ষতিকর জীবাণু, যা প্রিয়ন বলে পরিচিত। এই সকল জীবাণু মানুষ ও উদ্ভিদের রোগের কারণ হতে পারে। সংক্রামক রোগ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে, দূষিত ও জীবাণুমুক্ত খাবার ও পানির ব্যবহার অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রভৃতি বিভিন্ন উপায়ে সংক্রমিত হতে পারে। ইনজেকশন, ওষুধ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দ্বারা এই রোগের সংক্রমণ হতে মুক্ত থাকা যায়। ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর নিঃসৃত তরল নির্যাস ও তার ব্যবহ্নত দূষিত দ্রব্যাদির ব্যবহারের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে থাকে।
সংক্রামক রোগ এমন এক প্রকার রোগ যার জীবাণু মানব দেহে অনুপ্রবেশ করে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের মধ্যে বংশ বৃদ্ধির ক্ষমতা রাখে এবং অতি সহজেই সেই জীবাণু অন্য ব্যক্তির মাঝে রোগের সংক্রামণ ঘটাতে সক্ষম হয়। সংক্রামণ ও সংক্রামক রোগ শব্দ দুইটি সমার্থক নয় কারণ অনেক সময় সংক্রামণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে না অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে কোন প্রকার বৈকল্য সৃষ্টি করে না।
পৃথিবীতে অজস্র বিভিন্ন প্রকৃতির জীবাণুর মধ্যে মাত্র তুলনামূলক নগণ্য কিছু জীবাণু সুস্থ দেহী মানুষের দেহে অনুপ্রবেশ করে অসুস্থতার কারণ ঘটায়। সংক্রামক ব্যাধির সৃষ্টিকারী কিছু জীবাণু ও আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতার সংঘর্ষের স্বাভাবিক পরিণতিতে অনেক সময় সংক্রামক রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত রোগের প্রকাশ এবং তার তীব্রতা নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর। তাই সংক্রামক রোগের জীবাণুকে রোগীর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতার বিবেচনায় দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে- প্রাথমিক জীবাণু এবং সুযোগ সন্ধানী জীবাণু।
প্রাথমিক শ্রেণীর রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু সুস্থ মানবদেহে অনুপ্রবেশ করে সেখানে অবস্থানকালে তার কার্যক্রম, বংশ বৃদ্ধি এবং বিস্তৃতির স্বাভাবিক পরিণতির ওপর নির্ভর করে রোগের তীব্রতা। অনেক সাধারণ প্রাথমিক শ্রেণীর রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু আছে যা শুধুমাত্র মানবদেহে রোগের সংক্রামণ ঘটায়, পক্ষান্তরে পরিবেশ হতে প্রাপ্ত অনেক রোগ-জীবাণু অনেক জটিল ও মারাত্মক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু আছে যা শুধু মানবদেহকে আক্রান্ত করে না বরং অন্যান্য প্রাণীকেও সংক্রামিত করে থাকে।
যে সকল রোগ-জীবাণু মানুষের দুর্বল প্রতিরোধ শক্তির সুযোগে মানুষকে আক্রান্ত করে তাদের সুযোগ সন্ধানী রোগ-জীবাণু হিসাবে শ্রেণীকরণ করা হয়। এই ধরনের রোগ জীবাণু সাধারণত মানবদেহের পাকস্থলী ও শ্বাস নালীতে অবস্থান করে। কোন কোন সময় এই জাবীণু অন্য ব্যক্তির সংস্পর্শে, পরিবেশ হতে প্রাপ্ত জীবাণু, ছত্রাক অথবা আঘাতজনিত ক্ষত হতে উৎপন্ন হয়ে থাকে। সুযোগ সন্ধানী রোগ-জীবাণুসমূহ মানুষের অন্তর্নিহিত রোগ প্রতিরোধক শক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে। এই দুর্বলতা মানুষের উত্তরাধিকার সূত্রে হয়ে থাকে। কোন কোন সময় এই দুর্বলতা রোগ প্রতিষেধক ওষুধ, ক্যামোথেরাপির রেডিয়েশন অথবা অন্য কোন রোগ প্রতিরোধক হামের টিকা, ম্যালেরিয়া অথবা HIV রোগের চিকিৎসার কারণে হতে পারে। অনেক সময় প্রাথমিক রোগ-জীবাণু অত্যন্ত মারাত্মক ও গুরুতর রোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং তা শক্তিশালী প্রতিরোধ শক্তিধর ব্যক্তির তুলনায় দুর্বল শক্তির লোকদেরই বেশি রোগগ্রস্ত করে থাকে।
সংক্রামক রোগ নির্ণয়ের অন্যতম কার্যকর উপায় হল বৈজ্ঞানিক কচ-এর স্বীকৃত তত্ত্ব অনুসরণ করা। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে শুধুমাত্র আক্রান্ত ব্যক্তি অথবা রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তির ওপর এই পরীক্ষা পরিচালনা করলেই সংক্রামক রোগ নির্ণয় করা যাবে। কোন স্বাস্থ্যবান সুস্থ ব্যক্তির ওপর এই পরীক্ষা চালালে আরোধ্য ফল পাওয়া যাবে না। এই পরীক্ষার দ্বারাই কোন রোগ সংক্রামক তা জানা যাবে। এই পরীক্ষা সর্বপ্রথম পরিচালিত হয়েছিল অতি ক্ষুদ্র যক্ষ্মা রোগের জীবাণুর ওপর। এখানে মনে রাখতে হবে সকল রোগের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক কচ-এর তত্ত্ব প্রযোজ্য নয়। জীববিদ্যা অনুযায়ী জীবাণুবাহী প্রাণীর দেহে ধারণকৃত রোগ জীবাণু তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এবং কার্যকরভাবে কামড়ের মাধ্যমে রোগের বিস্তার ঘটিয়ে থাকে। এই সকল রোগ জীবাণু রক্ত দূষণের দ্বারা ম্যালেরিয়া, ভাইরাল এনসেফালাইটিস (Viral Encepalities), ক্যাগাস (Chagas) এবং আফ্রিকার বিরক্তিকর ঘুমের মত মারাত্মক ও ভয়ঙ্কর রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এই সকল জীবাণুবাহী প্রাণীর মধ্যে সাধারণত মশা, রক্তশোষা আটুলি ও অন্যান্য রক্তপায়ী কীট-পতঙ্গ ও উকুন বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। অনেক সময় রোগ-জীবাণুর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন হয় জীবাণুবাহক প্রাণীর (Host)। এই সকল পরজীবী রোগ-জীবাণু ধ্বংস করে রোগের সংক্রামণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
রোগের সংক্রামণ এবং তার তীব্রতার মাঝে সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল এবং তার পরিণতির সাথে জীবাণুর দীর্ঘস্থায়ী বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জীবাণু এবং তার বাহক প্রাপ্তির বিষয়টি সময় সাপেক্ষ, তাই সৃষ্ট জীবাণু তার প্রাক্তন আক্রান্ত রোগীকে অত্যন্ত তীব্রতার সাথে আঘাত হানে এবং প্রাথমিকভাবে সেই ক্ষেত্রে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। যেই সকল ব্যাধি অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে মারাত্মক ও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে সেই সকল রোগের জীবাণু অন্যদেহে সঞ্চালিত হওয়ার পূর্বেই আক্রান্ত রোগীর জীবনাবসান ঘটে থাকে।
————————–
ড. জাকারিয়া আহমেদ,
সহকারী অধ্যাপক, অণুজীব বিজ্ঞান (মাইক্রোবায়োলজি) বিভাগ,
প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, এইচবিআর টাওয়ার, ৯, বনানী বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১২১৩, বাংলাদেশ।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply