গতকাল পালিত চলতি বছরের রক্তদাতা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল আরও রক্ত আরও জীবন। অর্থাৎ রক্তের পর্যাপ্ত সঞ্চয় রক্ষা করবে আরও অনেক জীবন। ২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারা বিশ্বে প্রতিবছর নয় কোটি ৩০ লাখ ব্যাগ রক্ত সংগৃহীত হয় (১৭৩টি দেশে)। এর ৫০ শতাংশ সংগৃহীত হয় উন্নত দেশে, যাঁরা সারা বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ১৬ শতাংশ। উন্নত বিশ্বে প্রতি হাজারে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয় ৪৫০ জন; অপরদিকে উন্নয়নশীল মাত্র তিনজন। অনেক দেশেই এখনো রক্তের চাহিদা ও প্রাপ্যতার মধ্যে রয়েছে বিশাল ব্যবধান। এই ব্যবধান কমিয়ে আনার একমাত্র উপায় স্বেচ্ছায় রক্তদানে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দেশের এক শতাংশ মানুষ যদি স্বেচ্ছায় রক্ত দেয় তাহলে রক্তের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ছয় লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। সংগৃহীত রক্তের প্রায় ৭০ শতাংশ আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে পাওয়া যায়, ৩০ শতাংশ পাওয়া যায় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে। যদি বলা হয়, চাহিদা তো মিটছে, তাহলে ঘাটতি কোথায়? ঘাটতি তাদের জন্য যাদের মুমূর্ষু অবস্থায় রক্ত দেওয়ার কোনো আত্মীয়স্বজন থাকে না। অভাবটা তাদের জন্য যাদের প্রতি মাসে এক ব্যাগ রক্তের জন্য আত্মীয়স্বজনের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। যেমনটি থ্যালাসিমিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। ঘাটতি রয়েছে নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার মানসিকতায়। সুতরাং রক্তের অভাবের ঝুঁকিটা তার পরও থেকে যায়।
বাংলাদেশে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা গত ১০ বছের ১০ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। থাইল্যান্ডে এই হার ১০০ শতাংশ এবং ভারতে ৬৫ শতাংশ। এ জায়গায় আমরা অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে ২০০০ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচি শুরু হয়। এর আওতায় এ পর্যন্ত ২০৩টি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এ সব কেন্দ্রে এইডস, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়ার স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। এর পাশাপাশি প্রায় ৫০টি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ব্লাড ব্যাংক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স সংগ্রহ করে রক্ত পরিসঞ্চালন পরিচালনা করছে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ মোট ১৮টি কেন্দ্র থেকে রক্তের উপাদান প্রস্তুত করে সরবরাহ করা হয়। সরকার নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ করেছে। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচি বাস্তবায়নের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সারা দেশে এইচআইভি/এইডস, হেপাটাইটিস বি-সি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়ার রোগের স্ক্রিনিং করা। এর ফলে দেশে পেশাদার রক্তদাতার সংখ্যা ৭০ থেকে কমিয়ে প্রায় শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকার প্রণীত নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন ২০০২-এর নির্দেশনা এবং এসআরও ১৪৫-এর ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদের কয়েকটি বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জাতীয় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ কমিটির অধীনে ন্যাশনাল ভলান্টারি ব্লাড ডোনার কমিটি করা হবে, যারা ভ্রাম্যমাণ রক্ত সংগ্রহ ক্যাম্প পরিচালনা ও সারা দেশের ভলান্টারি ব্লাড ডোনেশন কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করবে।
যদিও আমাদের দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে রক্তদানকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি, বিভিন্ন স্তরে সমন্বয় করে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজনে জাতীয় পর্যায়ে সবার অংশগ্রহণে একটি কৌশল নির্ধারণ করতে হবে যার মাধ্যমে সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে সার্বিক সমন্বয় সাধনে করা সম্ভব হবে। স্বেচ্ছা-রক্তদাতা সংগঠন আয়োজিত যেকোনো ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে অনুমোদিত নিকটস্থ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র রক্ত সংগ্রহের জন্য সব টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রদান করবে এবং রক্ত সংরক্ষণ, স্ক্রিনিং ও ক্রসম্যাচিং পরীক্ষা সম্পাদন করবে। যেহেতু আমাদের দেশে প্রতিটি কেন্দ্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার গুণগত মান যাচাই করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তাই ভবিষ্যতে সারা দেশে বিভাগ অনুযায়ী সাতটি রিজিওনাল সেন্টার স্থাপন করা যেতে পারে।
পাশাপাশি সম্পূর্ণ রক্তের (হোল ব্লাড) পরিবর্তে ব্লাড কম্পোনেন্টের ব্যবহার বাড়াতে হবে। হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জাতীয় গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের উদ্যোগে রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণের কার্যক্রম জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণ করতে হবে। মোটিভেশনের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। রক্তই রক্তের বিকল্প, অন্য কিছু নয়। অনেক চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম রক্ত আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। রক্ত একটি অমূল্য সম্পদ। সময়মতো রক্ত পাওয়ায় অধিকার নিশ্চিত করলে, আমরা মনে করি, বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের যথাযথ মূল্যায়ন হবে। তাই বলা হয়, রক্তদান শুরু হোক আপনার থেকে। রক্ত মানুষের জীবন রক্ষা করে—এই মূল্যবোধ জাগ্রত থাকুক সব সময়ের জন্য।
মুরাদ সুলতান, বিশেষজ্ঞ, ব্লাড সেফটি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৫, ২০১১
Leave a Reply