অটিজম কি?
অটিজম কোন সাধারণ রোগ নয়। এটি শিশুদের একটি মনোবিকাশগত জটিলতা যার ফলে সাধারণত ৩টি সমস্যা দেখা দেয়া। যেগুলো হচ্ছে- প্রথমতঃ মৌখিক কিংবা অন্য কোনো প্রকার যোগাযোগ সমস্যা, দ্বিতীয়তঃ সমাজিক বিকাশগত সমস্যা, তৃতীয়তঃ খুব সীমাবদ্ধ ও গণ্ডিবদ্ধ জীবন-যাপন ও চিন্তা-ভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ এছাড়া অতি চাঞ্চল্য (Hiper Activity), জেদী ও আক্রমণাত্মক আচরণ (Aggressiveness), অহেতুক ভয়ভীতি, খিচুনী ইত্যাদি ও থাকতে পারে।
অটিজম রোগটি কবে অবিষ্কৃত হয়েছে ?
১৯৪৩ সালে জন হপকিনস হাসপাতালের ডাঃ লিও কান্নের এবং প্রায় একই সময়ে জার্মান বিজ্ঞানী ডাঃ হ্যান্স এসপারজার রোগটি সম্বন্ধে বিস্তারিত জনসমক্ষে উপস্থাপন করেন। তার আগে রোগটি থাকলেও এসম্বন্ধে তেমন কোন ধারণা ছিল না। বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে এই রোগটি নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে।
রোগটি কোন্ বয়সে এবং
কিভাবে সনাক্ত করা যায়?
সাধারণত শিশুর বয়স ১৮ মাস থেকে ৩ বছর এবং মধ্যে এই রোগ দ্ব্যর্থহীনভাবে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। এখানে উল্লেখ্য যে যত দ্রুত রোগটি সনাক্ত করা যায়, শিশুর জন্য ততই মঙ্গল। সাধারণত নিন্মলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর মাধ্যমে অটিষ্টিক রোগটি সনাক্তকরণ সম্ভবঃ এদের ভাষার বিকাশ হতে বিলম্ব হয়। (এক বছর বয়সে অর্থবহ অঙ্গভঙ্গি, ১৬ মাস বয়সে একটি শব্দ এবং ২ বছর বয়সে ২ শব্দের বাক্য বলতে পারে না)। এই রোগে আক্রান্ত শিশু সমবয়সী কিংবা অন্যান্যদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। এরা নাম ধরে ডাকলে ও সাড়া দেয় না এবং আপন মনে থাকতে পছন্দ করে। এরা অন্যদের চোখের দিকে তাকায় না। অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না। একই কথা পুনঃরাবৃত্তি করে এবং একই কাজ বার বার করতে পছন্দ করে। এদের কাজ-কর্ম এবং সক্রিয়তা সীমিত ও গণ্ডিবদ্ধ। পরিবেশ এবং আশেপাশের কোন পরিবর্তন খুব অপছন্দ করে। এরা কখনো কখনো অতি সক্রিয় আবার কখনো কখনো খুব কম সক্রিয় হয়। অতিসক্রিয়তা থেকে কখনো কখনো খিচুনী হতে পারে।
সাধারণত দোলনা/রকিং চেয়ার বা এই জাতীয় পুনঃরাবৃত্তিমূলক খেলা পছন্দ করে। সাধারণত খেলনা দিয়ে কোন গঠনমূলক খেলা খেলতে পারে না অথবা কোন বিশেষ খেলনার প্রতি অত্যধিক মোহ দেখা যায়। কখনো মনে হতে পারে যে এরা কানে শুনতে পায় না। এরা মাকে বা অন্য কোন প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরে না এবং তাদের কেউ ধরলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না অথবা অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এরা কখনো আত্মপীড়ন করে এবং মনে হয় তাতে সে তেমন কষ্ট পায় না। কোন বিশেষ কিছুর প্রতি অত্যাধিক আকর্ষণ থাকে যেমন- কাগজ ছেঁড়া, পানি, তরল পদার্থ দিয়ে খেলা, চাল, ডাল দানাদার কিছু দিয়ে খেলা ইত্যাদি। সাধারণত কল্পনাপ্রসূত খেলা খেলতে পারে না। কোন বিশেষ সংবেদন-এর প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ করে যেমন আলোতে চোখ বন্ধ করা, শব্দ শুনলে কানে হাত দেয়া, দুর্গন্ধে কোন প্রতিক্রিয়া না করা, স্বাদ ও স্পর্শে তেমন কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ না করা ইত্যাদি।
কি কারণে অটিজম রাগটি হতে পারে?
এখনো পর্যন্ত অটিজম কেন হয় তার সঠিক কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। মনেবিকাশের প্রতিবন্ধকতার কারণ হিসাবে মস্তিস্কের অস্বাভাবিক জৈব রাসায়নিক কার্যকলাপ, মস্তিস্কের অস্বাভাবিক গঠন, বংশগতির অস্বাভাবিকতা, এমন কি বিভিন্ন টিকা প্রয়োগ থেকে এই রোগ হতে পারে বলা হলেও নির্দিষ্ট করে কিছু এখনো জানা সম্ভব হয়নি। জন্ম পরবর্তীêকালের কোন জটিলতা কিংবা শিশুর প্রতি অমনোযোগিতার ফলে এই রোগের সৃষ্টি হয় না। কাজেই কোন বাবা মা ও আত্মীয়-স্বজন নিজেদের দোষী ভাবা অথবা বাবা-মাকে দায়ী করার কোন যৌক্তিকতা নেই।
অটিজম রোগটির প্রাদুর্ভাব কেমন?
বর্তমানে পৃথিবীতে অটিজম রোগটি প্রায় মহামারীর পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ একে এইচআইভি এইডস এর সাথে তুলনা করেছেন। আমাদের দেশে সঠিক তথ্য না থাকলেও গড়ে প্রতি হাজারে ১০ থেকে ২০টি শিশু এই রোগে আক্রান্ত বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। উন্নত দেশগুলোতে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে জানা গেছে।
অটিজম রোগটির কি কোন চিকিৎসা আছে?
অটিজম সারিয়ে তোলার জন্য কোন প্রকার জাদুকরী চিকিৎসা এখনও পর্যন্ত অবিষ্কৃত হয়নি। এরূপ পরামর্শে বিভ্রান্ত হওয়া বোকামী। তবে নিজেদের সম্পূর্ণ অসহায় মনে করাও সঠিক নয়। কেননা বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, পিতা-মাতা ও আপনজনদের শ্রম ও যত্ন এবং এই রোগের সাথে সংশিস্নষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহায়ক দলের একত্রে কার্যক্রমে শিশুর বিকাশ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলেও একটি শিশুকে স্বাধীন জীবন-যাপন করার মত পর্যায় আনা সম্ভব হয়। আর এজন্য যা করণীয় তা হচ্ছেঃ এ ধরনের শিশুর বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুটিকে সার্বক্ষনিক সহায়তা প্রদান। কিছু ঔষধপত্র প্রয়োগ যা তার অন্যান্য শারীরিক অসুবিধা দূরীকরণে সহায়তা করে। দ্রুততার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া যা শিশুটির ভাষা বিকাশ, সামাজিক বিকাশ, স্বাবলম্বিতার বিকাশ, বিশেষ দক্ষতার বিকাশ এবং অন্যান্য স্বকীয়তা অর্জনে সহায়তা করবে। সামাজিক স্বীকৃতি এবং সকলের সহযোগিতা এই ধরনের শিশুর বিকাশের জন্য খুবই জরুরী। সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষ এখনো এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানে না। কাজেই সহযোগিতার বিষয়টি একান্তই অবান্তর।
অটিষ্টিক শিশুরা কি প্রতিবন্ধী?
অটিষ্টিক শিশুরা কখনো কখনো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হয়। এই ধরনের শিশুদের তাই বিশেষ প্রয়োজন সম্পন্ন শিশু বা বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদাসম্পন্ন বলা হয়। যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে বিধায় এদের প্রতিবন্ধী আখ্যায়িত করা সঠিক নয়।
অটিষ্টিক শিশুদের বিভিন্ন পর্যায় কি কি ?
সাধারণত অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ৪টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। বয়সের সাথে নয় বরং প্রতিটি শিশুর সামর্থেøর উপর তার পর্যায় নির্ভর করে।
পর্যায়গুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
প্রথম পর্যায়ঃ আত্মকেন্দ্রিক স্তরঃ এই পর্যায়ে শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক থেকে এবং আপন মনে একাকী খেলতে পছন্দ করে। এরা সাধারণত কোন আদেশ-নিষেধ অথবা নির্দেশ বুঝতে পারে না ও পালন করে না।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ অনুরোধকারী স্তরঃ এই পর্যায়ের শিশুরা শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে খুব কাছের লোকদের সাথে অল্প সময়ের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করে এবং তাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য অনুরোধ করে।
তৃতীয় পর্যায়ঃ যোগাযোগ শুরুকারী স্তরঃ এই পর্যায়ের শিশুরা কিছু প্রচলিত শব্দ বুঝতে পারে এবং অতি পরিচিত মানুষের সাথে অল্প সময়ের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। তারা ছোটখাট আদেশ-নির্দেশ পালন করতে পারে।
চতুর্থ পর্যায়ঃ সহযোগী স্তরঃ এই পর্যায়ের শিশুরা পরিচিত সমবয়সী শিশুদের সাথে অল্প সময়ের জন্য খেলা করে। ভাষায় দক্ষতা একটু ভালো এবং অন্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
অটিষ্টিক শিশুদের প্রশিক্ষণ প্রদানের উপায় কি?
উন্নত এবং উন্নয়নশীল অনেক দেশে অটিষ্টিক শিশুদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে আমাদের দেশেও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এই ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তবে মানসম্পন্ন তেমন কোন প্রতিষ্ঠান এখনও পর্যন্ত গড়ে উঠেনি একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। পৃথিবীর অনেক দেশে এই শিশুদের জন্য পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো সাধারণত এই ধরনের শিশুদের বাবা-মায়েরা পরিচালনা করে থাকেন। কাজেই এই ধরনের শিশুদের সময়ক্ষেপণ না করে সনাক্ত হবার সাথে সাথে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো অত্যন্ত জরুরী। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর উচিত কত দ্রুত শিশুটিকে এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উন্নত করা যায় সেজন্য সচেষ্ট হওয়া। এছাড়া বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং পরিচর্যাকারীদের শিশুটিকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রশিক্ষণ দিতে হবেঃ (চলবে)
—————–
ডাঃ মারুফা আহমেদ
লেঃ কর্ণেল মোঃ তোফায়েল আহমেদ, পিএসসি
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply