আরমান আহমেদ (ছদ্মনাম) স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন বরাবরই। প্রতিদিন নিয়ম করে এক ঘণ্টা হাঁটতেন, খাবারেও অতিরিক্ত তেল, চর্বি এড়িয়ে চলতেন সব সময়। উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল—কিছুই তাঁর ছিল না। ওজনও ছিল শতভাগ নিয়ন্ত্রণে। হঠাৎ একদিন শোনা গেল, তাঁর হার্ট অ্যাটাক, সিসিউতে ভর্তি করা হয়েছে।
আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব কারোরই বিশ্বাস হতে চাইল না খবরটা। এমন নিয়মানুবর্তী জীবনযাপন যাঁর, তিনি কীভাবে হার্ট অ্যাটাক হলেন? দিন কয়েক বাদে ধীরে ধীরে একটু সুস্থ হতে শুরু করলে ডাক্তার তাঁর কেস হিস্ট্রি নিতে গিয়ে বুঝলেন, আরমান সাহেবের হার্ট অ্যাটাকের কারণ মূলত তাঁর মানসিক চাপ। পারিবারিক অশান্তিতে মাস কয়েক ধরে অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, যার পরিণতি এই হার্ট অ্যাটাক।
ধূমপান, মেদস্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হূদরোগের পারিবারিক ইতিহাস, অতিরিক্ত কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার ইত্যাদির পাশাপাশি মানসিক চাপ বা স্ট্রেস হূদরোগের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। গত শতকের শেষ ভাগে বিশ্বজুড়ে নানা গবেষণার ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ বিশেষত হূদরোগের সঙ্গে স্ট্রেসের সংযোগের বিষয়টি এখন স্পষ্ট।
মার্কিন হূদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিসটন দীর্ঘ গবেষণার পর দেখিয়েছেন, হূদরোগের কারণ প্রধানত মানসিক। তিনি বলেছেন, কোলেস্টেরল বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমে করোনারি আর্টারিক বন্ধ করে ফেললেই যে হার্ট অ্যাটাক হবে, এমন কোনো কথা নেই। দেখা গেছে, করোনারি আর্টারির ৮৫ শতাংশ বন্ধ অবস্থা নিয়েও একজন ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছেন। আবার শুধু স্ট্রেস, টেনশন বা মানসিক চাপের কারণে একেবারে পরিষ্কার আর্টারি নিয়ে অন্য একজন হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান ও ডা. রে রোজেনম্যান গবেষণার পর দেখান, হূদরোগের সঙ্গে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা নেতিবাচক জীবনপদ্ধতির সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। তাই সুস্থ হূদযন্ত্রের জন্য চাই মানসিক প্রশান্তি ও সঠিক জীবনদৃষ্টি। আর মানসিক প্রশান্তি ও চাপমুক্ত জীবনের জন্য মেডিটেশনের ভূমিকা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
আমাদের দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য নিয়মিত প্রার্থনা ও মেডিটেশন করা উচিত। চাপমুক্ত জীবনযাপন, মানসিক সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ হূদযন্ত্রের জন্য রিলাক্সেশন বা শিথিলায়নের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি এখন প্রমাণিত সত্য যে মেডিটেশন হূদরোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়—দুই ক্ষেত্রেই কার্যকর ভূমিকা রাখে। রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ। মেডিটেশন অস্বাভাবিক বেশি কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমিয়ে আনতে পারে। মেডিকেল কলেজ অব জর্জিয়ার ফিজিওলজিস্ট বার্নেস ১১১ জন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এক গবেষণা চালান। গবেষণার পর তিনি বলেন, কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ ব্যবহার করে আগে যে ফল পাওয়া যেত, তা-ই পাওয়া সম্ভব মেডিটেশনে।
শুধু তা-ই নয়, হূদরোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে মেডিটেশনের ভূমিকার সত্যতা এখন স্থান পেয়েছে কার্ডিওলজির প্রধান প্রধান পাঠ্যবইয়ের সাম্প্রতিক সংস্করণগুলোতেও। Braunwald’s Heart Disease বইটির অষ্টম সংস্করণে ১১৫৭ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ‘মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যথা-বেদনা ও দুশ্চিন্তা দূর করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এ পদ্ধতিতে মানসিক চাপ কমে এবং রোগ নিরাময় সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া মেডিটেশন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতাও বাড়িয়ে দেয়।’
তাই হূদযন্ত্রের সুস্থতার জন্য মানসিক চাপমুক্ত জীবন যাপন করুন। আর তা সম্ভব নিয়মিত মেডিটেশন বা ধ্যানমগ্নতায়। দিনে অন্তত ৩০ মিনিট মেডিটেশন আপনাকে বেঁধে রাখবে সুস্থ জীবনে—প্রশান্তি হবে আপনার নিত্যসঙ্গী। অযাচিত সব দুঃখ-কষ্ট সরে যাবে দূরে। আপনি হয়ে উঠবেন সুস্থ, প্রাণবন্ত এক নতুন মানুষ।
ডা. মেহেদী আল মাসুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৫, ২০১১
Leave a Reply