পৃথিবীতে প্রতি ছয় সেকেন্ডে একজন স্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন। এসব আক্রান্ত ব্যক্তি কেউ হতে পারেন আপনার মা-বাবা, ভাইবোন, নিকটাত্মীয়—যে কেউ; এমনকি আপনি নিজেও। স্ট্রোক যেমন ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা, একই সঙ্গে অনেক মানুষ হারাচ্ছে তাদের কর্মক্ষমতা, হচ্ছে প্রচুর অর্থ ব্যয়। সুতরাং স্ট্রোক এক জাতীয় ও বিশ্বজনীন সমস্যা।
আসুন, স্ট্রোক সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। স্ট্রোককে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সেরিব্রভাসকুলার অ্যাকসিডেন্ট বলা হয়। সেরিব্রাল অর্থাৎ মস্তিষ্ক ভাসকুলার অর্থ রক্তনালি। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালির দুর্ঘটনাকেই স্ট্রোক বলা যায়। এ দুর্ঘটনায় রক্তনালি বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটেও যেতে পারে। আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে, স্ট্রোক একটি হূৎপিণ্ডের রোগ। বাস্তবে এটি মোটেই সত্য নয়। স্ট্রোক সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের রক্তনালির জটিলতাজনিত রোগ।
৬০ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তিদের ভেতর স্ট্রোক মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ। সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে স্ট্রোকের হার বেড়ে যায়। তরুণেরাও কখনো এর শিকার হয়। অনিয়মিতভাবে উচ্চরক্তচাপের ওষুধ সেবন স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ। এ ছাড়া ধূমপান, অতিরিক্ত টেনশন, হূদেরাগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস, রক্তে বেশি মাত্রায় চর্বি, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ এর আশঙ্কা বাড়ায়। কেউ কেউ জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়িকেও এর কারণ হিসেবে অভিহিত করেন।
স্ট্রোকের এক-তৃতীয়াংশ অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর মধ্যে রোগীর বয়স, স্ট্রোকের আকৃতি, আক্রমণের জায়গা, অন্যান্য রোগের উপস্থিতি, কী ধরনের স্ট্রোক হয়েছে এর ওপর ফলাফল অনেকটা নির্ভর করে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ। মস্তিষ্কের অনেকখানি জায়গাজুড়ে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে রোগী শুরুতেই মারা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলের জন্য বলা যায় যে স্ট্রোকের পাশাপাশি হূৎপিণ্ড বা ঘাড়ের রক্তনালি বন্ধ থাকলে পরবর্তী এক বছরের ভেতর ৫-১৫ শতাংশ রোগীর আবার স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা
সব রোগীর জন্য অবশ্যই সিটি স্ক্যান পরীক্ষা করতে হবে। রক্তক্ষরণ আছে কি না, স্ক্যান থেকে এটি জানা যায়। রক্তক্ষরণ হলে সিটি স্ক্যানে সাদা দেখায়, আর রক্ত সরবরাহ কমে গেলে সিটি স্ক্যানে সেই জায়গা কালো দেখা যায়। রক্তক্ষরণের জায়গার চারপাশে পানি জমা হলে একে ইডিমা বলা হয়। এই ইডিমা চারপাশের মস্তিষ্কের ওপর আরও বেশি চাপ দেয়। সিটি স্ক্যানে এই ইডিমাকে কালো দেখায়। রক্তক্ষরণ হয়ে রক্ত ব্রেনের পানি বা সিএসএফের সঙ্গে মিশে যেতে পারে, ব্রেনের কেন্দ্রে ভেন্ট্রিকলে ঢুকে যেতে পারে। এর ফলে ব্রেনের ভেতর পানির চলাচল বন্ধ হয়ে, পানি জমে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এরপর ঘাড়ের রক্তনালির ডপলার পরীক্ষা করা উচিত। পাশাপাশি রুটিন পরীক্ষাগুলোও করা উচিত। রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
ব্রেনের কোন অংশে স্ট্রোক বেশি হয়
সাধারণত ব্রেনের নিচের দিকে ব্যাজাল গ্যাংলিয়া নামক জায়গায় সবচেয়ে বেশি রক্তপাত দেখা যায়। মস্তিষ্কের বাকি অংশের বিভিন্ন জায়গায় এ রক্তপাত হতে পারে। এ ছাড়া কখনো ব্রেনের নিচের দিকে ব্রেনস্টেমে রক্তপাত ঘটে থাকে, এটি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। এই রক্ত ব্রেনের পানির সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা অত্যন্ত খারাপ ফল বহন করে। জমাটবাঁধা রক্ত পার্শ্ববর্তী ব্রেনে চাপ প্রয়োগ করে থাকে। প্রথম ৪৮ ঘণ্টা ধরে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। পরে বন্ধ হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব রক্ত এক ও দুই মাসের ভেতর কমে যায়।
রক্তপাত বা রক্ত সরবরাহ কম—যেটাই ঘটুক না কেন, এর ফলে রোগীর কিছু কিছু দৈনন্দিন কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গা বিভিন্ন কাজের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকে।
ভালো থাকার জন্য
স্ট্রোক থেকে ভালো থাকার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমেই দেখতে হবে রক্তনালি কেন সরু ও শক্ত হয়ে যায়? রক্তে অতিমাত্রায় চর্বি জমাই এর কারণ। সুতরাং স্ট্রোক থেকে ভালো থাকতে গেলে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে (কমপক্ষে ৪৫ মিনিট হাঁটবেন), ব্যায়াম করে কয়েক কেজি বাড়তি ওজন ঝেড়ে ফেলা যায়।
ধূমপানকে ‘না’ বলুন। যেকোনো পরিবেশে হাসিখুশি থাকুন। আসুন, স্ট্রোককে দূরে সরিয়ে রাখি। চর্বি ও শর্করাযুক্ত খাবার অপছন্দ করুন।
ফাস্টফুড, বাদাম, সন্দেশ, রসগোল্লা, দুধ-ঘি-পোলাও-বিরিয়ানি, পাঙাশ, চিংড়ি, কাঁকড়া, গরু বা খাসির মাংস, নারকেল বা নারকেলযুক্ত খাবার, ডিমের কুসুম প্রভৃতি রসনাযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত নয়। অনেকেই বলে থাকেন, তাহলে খাব কী? ইচ্ছামতো শাকসবজি, অল্প ভাত, পাঙাশ, চিংড়ি ও কাঁকড়া বাদে যেকোনো মাছ, বাচ্চা মুরগি, ডিমের সাদা অংশও খেতে পারেন।
স্ট্রোক হলে কী করতে হবে
সাধারণত লোকের তো আর বোঝা সম্ভব নয় কোনটা স্ট্রোক, কোনটা হার্টের সমস্যা। সুতরাং প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক, স্ট্রোক কী কী লক্ষণ নিয়ে প্রকাশ পায়।
অনেক রোগী শুরুতেই অজ্ঞান হয়ে যান, আবার (রোগীর আত্মীয়ের ভাষায়) শাশুড়ি বিকেলে ঘুম থেকে উঠে পান মুখে দিয়েছেন। হঠাৎ দেখি, তাঁর মুখ এক দিকে বেঁকে গেল। তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন। আমরা ধরে ফেলেছি, পড়তে দিইনি। মুখ দিয়ে গেঁজলা বের হচ্ছে, তার পরই অজ্ঞান। আবার কেউ এমনটাও বলে থাকেন, ভালো মানুষ ঘুমাতে গেলেন, সকালে উঠে দেখি এক পাশ অচল।
এমনটা হলে রোগীকে কাত করে শুইয়ে দেবেন। এ অবস্থায় কোনো খাবার বা ওষুধ মুখে দেবেন না। কারণ, এগুলো শ্বাসনালিতে ঢুকে আরও ক্ষতি করে; বরং মুখে জমে লালা, বমি ভালোভাবে পরিষ্কার করে দিতে হবে। টাইট জামা-কাপড় ঢিলে করে দিন।
কোথায় চিকিৎসা করানো যায়
প্রথমে কাছের কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে হবে। দয়া করে অযথা ভিড় বা হইচই করলে চিকিৎসা ব্যাহত হতে পারে। আবেগ নয়, যুক্তি-ব্যবহারের চেষ্টা করুন। অবশ্য মানুষ যখন কাম-ক্রোধ, ভীতি, দুঃখ প্রভৃতি চূড়ান্ত আবেগ দ্বারা আপ্লুত হয়, তখন কিছুটা হলেও বুদ্ধি-বিবেচনা লোপ পায়।
অনেক রোগীর সঙ্গের লোকেরা ইমার্জেন্সিতে বিশৃঙ্খলা করেন। পরে এসে বলেন, ভাই, কথাটা মনে নিয়েন না, মাথা ঠিক ছিল না। কিন্তু মনে রাখবেন, মাথা ঠিক না থাকলে আপনারই লোকসান।
এরপর রোগীকে নিয়ে কাছের কোনো স্নায়ু চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে হবে। আশার কথা, এখন প্রতিটি বিভাগীয় শহরে স্নায়ু চিকিৎসাকেন্দ্র আছে। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই সব জেলায় এ সুবিধা ছড়িয়ে পড়বে।
সুদিপ্ত কুমার মুখার্জি
নিউরোসার্জন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৭, ২০১১
Leave a Reply