বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা আবার জোরালো করে বলার সময় এল। পৃথিবী জুড়ে নানা দেশে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আয়োজন চলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ নানা সংস্থা নানা দেশে এ আয়োজনে শামিল হয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ, আনুমানিক ৬৫ কোটি লোক, যাদের মধ্যে ২০০ মিলিয়ন হলো শিশু, এরা কোনো না কোনোভাবে পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী। এসব অসহায় মানুষের ৮০ শতাংশের বাস দরিদ্র দেশগুলোতে, যারা স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত বলা চলে।
শরীর ও মনের এই অক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ক্রনিক সব রোগ। যেমন হৃদরোগ ও ক্রনিক শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস; আঘাতজনিত ক্ষত-যেমন সড়ক দুর্ঘটনা, পতন, স্থলমাইন বিস্কোরণ ও ভায়োলেন্সের কারণে পঙ্গুত্ব, মানসিক ব্যাধি, অপুষ্টি, এইচআইভি/এইডস এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগ ও পরিবেশগত বিপর্যয়।
শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম এসব মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কারণ বাড়ছে পৃথিবীর জনসংখ্যা, বৃদ্ধ লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। এ ছাড়া আয়ু বাড়ানোর জন্য চিকিৎসা কৌশলও অনেক সফল হয়েছে।
এসব কারণে স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসনব্যবস্থার ওপর ক্রমেই বাড়ছে চাপ। উপরন্তু পঙ্গু মানুষের প্রতি সমাজের দৃষ্টি ও বিবেচনা তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছে। এ জন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। অনেক দেশে পঙ্গুত্ব ও প্রতিবন্ধী সমস্যা স্বাস্থ্য ও সামাজিক নীতি গ্রহণ-প্রক্রিয়া থেকে বাইরে; তাই এসব মানুষ সমাজে থেকে যায় অরক্ষিত। কুসংস্কার ও সামাজিক বৈষম্য একে করে তোলে আরও জটিল।
দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্য
পঙ্গুত্ব হতে পারে দারিদ্র্যের কারণ ও পরিণতি, দুটোই। বিশ্বের ৮০ শতাংশ পঙ্গু মানুষ থাকে দরিদ্র দেশগুলোতে। তাই তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব ধরনের অসুবিধার হয় মুখোমুখি, অধিকার থেকে হয় বঞ্চিত।
দারিদ্র্যের কারণেই তারা স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসনব্যবস্থার আওতার বাইরেই থেকে গেছে। উন্নয়নমুখী উদ্যোগগুলোও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব মানুষের কথা বিবেচনায় আনে না। পঙ্গু এসব মানুষের অধিকার সম্পর্কে তাই জাতিসংঘ কনভেনশন দেশের ক্রম-অগ্রসরমাণ উন্নতির জন্য পঙ্গুত্বের ইস্যুকে কেন্দ্রে রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছে। স্বাস্থ্য ও সামাজিক নির্ণায়কগুলোর দিকে নজর দিতে গেলে পঙ্গু মানুষের অধিকার ও স্বাস্থ্য রক্ষা প্রয়োজন, তাহলে মানবাধিকারও পরিপূর্ণ সফল রূপ পেতে পারে।
প্রয়োজন প্রমাণভিত্তিক তথ্য
এই ইস্যুর ব্যাপকতা স্বীকার করলেও পঙ্গুত্ব ইস্যুর ব্যাপারে সচেতনতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের ঘাটতি কিন্তু রয়ে গেছে। পঙ্গুত্বের সংজ্ঞা, এর গতিপ্রকৃতি ও ব্যাপকতার মধ্যে ঐকমত্য নেই।
দুই দশক ধরে এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন-পরিচর্যা হলেও প্রামাণিক তথ্য ও দলিল এসব ব্যাপারে তেমন নেই। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের বিশ্ব অধিবেশনে জোরালো কথা হয়েছে।
অতীতের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠুক কার্যক্রম
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক অন্য অংশীদারদের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা সঠিক হবে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও হত হওয়া এবং এর প্রতিরোধ সম্পর্কে বিশ্ব প্রতিবেদন, ভায়োলেন্স ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রতিবেদন অনেক কর্মসূচির সূচনা ঘটিয়েছে- যেমন অ্যাডভোকেসি জোরালো হওয়া, গণমাধ্যমের নজর এদিকে নিবদ্ধ হওয়া, রাজনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, এসব বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া অনেক প্রতিরোধক কর্মসূচি গ্রহণ করার মতো উদ্যোগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ব্যাপারে যে ভূমিকা নিয়েছে, তা হলো স্থানীয়, দেশীয় ও বৈশ্বিক উদ্যোগের মাধ্যমে এসব পঙ্গু অসহায় মানুষের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখা, রক্ষা করা এবং এদের জীবনের মান বাড়ানো।
এ জন্য ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ব্যাপক কর্মসূচি এ সংস্থা হাতে নিয়েছে। যেসব প্রস্তাব তারা বিবেচনায় এনেছে তা হলোঃ
- পঙ্গুত্ব, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে, আগাম চিহ্নিত করা ও প্রতিরোধ করা
- স্বাস্থ্যব্যবস্থায়, লোকসমাজভিত্তিক পুনর্বাসন কর্মসূচি সংহত করার প্রচেষ্টায় সহযোগিতা প্রদান
- পঙ্গুদের জন্য সহায়ক সব প্রযুক্তি, যেমন হুইল চেয়ার, হিয়ারিং এইড, অর্থোসেস, প্রসথেসিস-এসবের উৎপাদন এবং এদের আওতায় মানুষকে আনা
- জাতিসংঘের সঙ্গে সদস্য-দেশ, একাডেমিয়া, বেসরকারি খাত ও সংস্থার একত্রে কাজ করাকে উৎসাহিত করা
- এ ব্যাপারে সঠিক বিশ্ব প্রতিবেদন প্রস্তুত করা
- আমাদের দেশে এ ব্যাপারে উদ্যোগ রয়েছে, সরকারও সহানুভূতিশীল ও উদ্যোগী। এখন দরকার সবার সহযোগিতা।
————————
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
প্রথম আলো, ১২ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply