মধ্যবয়স সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, মধ্যবয়স একজন মানুষের জীবনে কয়েকটি বছর মাত্র নয়, বরং সমস্ত বয়সের মধ্যে ওইটুকুই তার আসল জীবন। মধ্যবয়সের গণনা ঠিক কবে থেকে শুরু করতে হবে তা নিয়ে কঠিন-কঠোর কোনো আইন করা নেই, তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত আটত্রিশ বা চল্লিশের পর থেকেই মধ্যবয়স ধরা হয়।
কর্মজীবনে মধ্যবয়স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার বয়স-সবচেয়ে দায়িত্বশীল হওয়ার বয়স-স্থিতধী থাকার বয়স। আব্রাহাম লিংকনের মত অনুযায়ী, অন্তত কর্মক্ষেত্রে মধ্যবয়স প্রকৃত অর্থেই আসল জীবন। আসল জীবনের ঘোড়দৌড়ে এগিয়ে থাকার তাড়না সবার। তাড়না থেকেই যাপিত জীবনের প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য মানুষের দেহ ও মনে যে পরিবর্তন ঘটে, তাকে বলা হয় মানসিক চাপ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, কোনো হুমকি বা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সময় আমাদের মন ও শরীরের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হওয়াটাই চাপ বা স্ট্রেস। এটা যখন আমাদের প্রতিকূল পরিবেশকে মোকাবিলা করে তুলতে সাহায্য করে, তখন তাকে বলা হয় ইউস্ট্রেস; আর যখন তা নেতিবাচকভাবে আমাদের শরীর ও মনে প্রভাব ফেলে, তখন তাকে বলা হয় ডিস্ট্রেস। তবে সাধারণত খারাপ ধরনের মানসিক চাপকে স্ট্রেস বলা হয়।
স্ট্রেস হলে আমাদের দেহের বিভিন্ন হরমোনের (এড্রিনালিন, নরএড্রিনালিন) পরিমাণগত তারতম্য দেখা দেয়। পরিবর্তন ঘটে নিউরোট্রান্সমিটারে-যার প্রভাব পড়ে দেহ ও মনে।
স্ট্রেসের সময় আমাদের হৃৎপিণ্ডের গতি ও রক্তচাপ বেড়ে যায় (প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য মাংসপেশি, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডে বেশি রক্ত সরবরাহ করার জন্য), শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়ে (শরীরে বেশি অক্সিজেন নেওয়ার জন্য), মাংসপেশি দৃঢ় হয়ে ওঠে (প্রতি-আক্রমণ ঠেকানো বা আক্রমণ করার জন্য), মানসিক সতর্কাবস্থা বেড়ে যায়, এমনকি আসন্ন বিপদে রক্তক্ষরণ হতে পারে এ আশঙ্কায় রক্তে প্লেটলেটসহ রক্ত জমাট বাঁধার উপাদানগুলো বাড়ে। এক কথায় স্ট্রেস অবস্থাকে বলা হয় ‘ফাইট অর ফ্লাইট রিঅ্যাকশন’। স্ট্রেস সব বয়সেই হতে পারে। নানা কারণে হতে পারে। মধ্যবয়সে যেসব কারণে স্ট্রেস হয় তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে অতিরিক্ত কাজের চাপ ও প্রতিকূল কাজের পরিবেশ। এ ছাড়া শব্দদূষণ, ভিড়, একাকিত্ব, ক্ষুধা, প্রিয়জনের মৃত্যু, নিরাপত্তাহীনতা, পারিবারিক সমস্যা, বিচ্ছেদ, ঘুমের সমস্যা, ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় গ্রহণ বা নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতার জন্য স্ট্রেস হতে পারে।
এ ছাড়া পারসোনালিটি ট্রেইট ‘এ’-সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব-অর্থাৎ যারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বেশি মাত্রায় ক্যারিয়ার-সচেতন, কাজপাগল, সহজেই যাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, যারা সব সময় অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে, তাদের মানসিক সমস্যা চাপ হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। দীর্ঘদিন ধরে স্ট্রেস বহন করলে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের সমস্যাই হতে পারে-বিশেষত মধ্যবয়সে এ ধরনের সমস্যা বেশি হয়।
মাথাব্যথা, ঘুমের ব্যাঘাত, বমি ভাব, অতিরিক্ত ঘাম, নির্জীবতা থেকে শুরু করে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। মানসিক সমস্যার মধ্যে দেখা যায়-কাজে অমনোযোগিতা; সহকর্মী, অধস্তন বা ঊর্ধ্বতন সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, সিদ্ধান্তহীনতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, বিষণ্নতা, উৎকণ্ঠা, অসহনশীলতা, হতাশা, দাঁত দিয়ে নখ কাটা, পা নাচানো ইত্যাদি।
স্ট্রেসের কারণে কর্মদক্ষতা কমে যায়-সৃষ্টিশীলতা ব্যাহত হয় এবং এর প্রভাব পড়ে ব্যক্তিজীবনে, পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে; আর সমষ্টিগত স্ট্রেস বেশি হলে রাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে মধ্যবয়সীদের ভূমিকা ফুটবল খেলার মাঠের মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের মতোই গুরুত্বপূর্ণ-তাই সবল অর্থনীতির জন্য কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজন চাপমুক্ত মধ্যবয়সী কর্মী, যাঁরা তরুণদের পেছনে থেকে মূল্যবান
দিকনির্দেশনা দেবেন; স্ট্রেসের কবলে পড়ে হাঁপিয়ে যাবেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা ৪০ শতাংশ কর্মী জানিয়েছেন, তাঁদের কাজ ও কর্মক্ষেত্র চাপযুক্ত। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ হার আরও বেশি হবে নিঃসন্দেহে। কর্মক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর কারণে বেশি স্ট্রেস হতে পারে, তা হচ্ছে-
- চাকরির নিরাপত্তা কম হলে
- ব্যবস্থাপনা কতৃêপক্ষ অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিলে
- কাজে সন্তুষ্টি না থাকলে
- চাহিদার তুলনায় কম পারিশ্রমিক পেলে
- নিয়োগকর্তা ও সহকর্মীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকলে
- রাত জেগে কাজ করলে
- অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য হলে
- কর্মক্ষেত্র পরিবার থেকে দূরে হলে
- অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকলে
- কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে
- মাদকাসক্তিতে বা কোনো মানসিক বা শারীরিক রোগে আক্রান্ত হলে
- কর্মক্ষেত্রে কোনো ধরনের আবেগজনিত সম্পর্ক তৈরি হলে। জাপানে কারুশি (Karoushi) বলে একটি প্রচলিত শব্দ রয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত কাজের চাপে হঠাৎ মৃত্যু। আমাদের দেশে কাজের চাপে কর্মীর মৃত্যু না হলেও উৎপাদনশীলতা কমতে পারে। তাই স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
কর্মক্ষেত্রে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন করার পাশাপাশি স্ট্রেস হওয়ার কারণ চিহ্নিত করতে হবে, আর পরিবর্তন করতে হবে দৃষ্টিভঙ্গির। এ জন্য সুনির্দিষ্ট যে কাজগুলো করতে হবে তা হলো-
- ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (চা, কফি, কোমল পানীয়), ধূমপান ও মদ্যপান (অভ্যাস থাকলে) বর্জন করার চেষ্টা করুন
- খাবারের তালিকায় অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, রাখবেন না-সহজপাচ্য কম চর্বিযুক্ত খাবার, ফল ও আঁশযুক্ত খাবার রাখুন
- নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খান, কাজের তাড়ায় সকালের নাশতা যেন বেলা ১১টায় আর মধ্যাহ্নভোজ যেন বিকেল পাঁচটায় না খেতে হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন
- অফিসে দেরি হবে এ ভয়ে পানি দিয়ে গিলে খাবার খাবেন না। সময় নিয়ে উপভোগ করে খাবার খান
- প্রতিদিন নিয়মিত কিছু হালকা ব্যায়াম বা হাঁটার অভ্যাস বজায় রাখুন
- প্রয়োজনমতো নিয়মিত ঘুমান
- সপ্তাহে নিয়ম করে কিছুটা সময় নিজের ও পরিবারের জন্য রাখুন। বছরে অন্তত একবার প্রিয়জনকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন।
- আয়ের সুষম বণ্টন ও ব্যয়ের বাহুল্য খাতকে সংকুচিত করে আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করুন।
- সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবেন না, হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না। প্রয়োজনে নির্ভরযোগ্য কারও সঙ্গে পরামর্শ করুন
- জীবনে চলতে গেলে যে সমস্যা আসবে তার দিকে অযথা আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখাবেন না। হতাশ হবেন না। সমস্যার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ করুন-বিকল্প সমাধানের পথ খুঁজে নিন
- চাকরি নেওয়া বা ছাড়ার আগে, নতুন কোনো সম্পর্ক তৈরি বা ভাঙার আগে বাস্তব ও যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নিন-সব সময় আবেগ দিয়ে চালিত হবেন না
- সবকিছুর মধ্যে যেটুকু ভালো তার দিকে মনোযোগ দিন-ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলুন
- একটি কাজে সফল হতে পারলেন না-ভেঙে পড়বেন না-ভাবুন, সামনে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। সেখানে সফল হওয়ার চেষ্টা করুন।
- নিজের ভেতর রসবোধ তৈরি করুন, কর্মক্ষেত্রে সব সময় গম্ভীর থাকবেন না-নিজে উৎফুল্ল থাকুন, মাঝেমধ্যে অন্যকেও উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করুন
- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখুন, প্রয়োজন হলে চিকিৎসা নিন
- মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম বা রিলাক্সেশন পদ্ধতির চর্চা করতে পারেন
- কর্মক্ষেত্রে অহেতুক মুরব্বিয়ানা দেখাতে যাবেন না। সহনশীল থাকার চেষ্টা করুন
- অফিসে ভালো বন্ধু গড়ে তুলুন-তাদের সঙ্গে অফিসের বিষয়াদি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন। ‘অফিস পলিটিক্স’ এড়িয়ে চলুন
- অপ্রয়োজনীয় কাজে অফিসে সময় নষ্ট করবেন না
- কাজের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিণতির দিকে নজর দিন এবং অন্যদের সেদিকে নজর দিতে উৎসাহিত করুন
- কর্মক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় আপনার মধ্যে স্ট্রেস সৃষ্টি করছে সেগুলো চিহ্নিত করুন-সমাধানের জন্য প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নিন। প্রয়োজনে পরিবার ও সহকর্মীর সাহায্য নিন
- গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পুনর্বিন্যাস করুন-দেখবেন পুনর্বিন্যাসের আগে যা আপনার কাছে ১ নম্বর গুরুত্বপূর্ণ বোধ হচ্ছিল, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় বের হয়ে এসেছে; আর যা আপনাকে স্ট্রেস দিচ্ছিল, তা অনেকাংশে কমে গেছে।
আমাদের দেশে করপোরেট বাণিজ্যের জায়গা প্রশস্ত হচ্ছে-মুক্তবাজারে দ্রুতগতিতে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।
প্রতিযোগিতার পরিবেশে সব প্রতিষ্ঠানই তাই বাড়িয়ে দিচ্ছে চলার গতি, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এখনো পেশাদারির পর্যায়ে আসতে পারেনি।
উন্নত বিশ্বের কথা বাদ দিলেও পাশের দেশ ভারতের অন্তত দুটি শহর বেঙ্গালুরু ও মুম্বাইয়ে কর্মক্ষেত্রে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে বিশেষ কাউন্সেলিং সেশন।
গড়ে উঠেছে মানসম্মত স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার। এসব সেন্টারে ২৪ ঘণ্টাই স্ট্রেস নিরাময়ের জন্য পরামর্শসেবা দেওয়া হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
সে কারণে যাঁরা অফিস-ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন, বিশেষ করে মানবসম্পদ বিভাগে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরই বাড়তি দায়িত্ব থেকে যায় কর্মীদের অহেতুক মানসিক চাপমুক্ত রেখে স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র তৈরি করার। প্রয়োজনে ব্যক্তিপর্যায়ে বা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের একত্র করে বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসকের পরামর্শও গ্রহণ করা যেতে পারে।
————————————-
ডা. আহমেদ হেলাল
সহকারী রেজিস্ট্রার
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
প্রথম আলো, ১২ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply