ডায়াবেটিস ও যক্ষ্মা
আমাদের দেশে স্বাস্থ্য-সমস্যা হিসেবে ডায়াবেটিস ও যক্ষ্মা অন্যতম। বিভিন্ন কারণে যেমন কায়িক পরিশ্রম কম করা, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, বংশগত এবং অন্যান্য কারণে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে যক্ষ্মা, যা একটি জীবাণুঘটিত রোগ। এটি আমাদের সমাজে সব সময় বিদ্যমান এবং এতে প্রধানত দরিদ্র শ্রেণী বেশি আক্রান্ত। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ লোক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং তার মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার মৃত্যুবরণ করে। যথেষ্ট চেষ্টা সত্ত্বেও যক্ষ্মা রোগ এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি; বরং ইদানীং বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা রোগ বিস্তারের অন্যতম কারণ হলো এইচআইভি এবং এইডস রোগের ব্যাপকতা।
যেহেতু যক্ষ্মা একটি জীবাণুঘটিত রোগ, তাই যেসব রোগে বা কারণে শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, ওই সব রোগীর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আমাদের দেশে এখনো এইডস রোগের ব্যাপকতা এত বেশি নয়। কিন্তু বিশাল একটি জনগোষ্ঠী ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। আর শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ। ডায়াবেটিস রোগী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে অনেক ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় করতে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। কারণ, ডায়াবেটিস রোগীদের যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ সাধারণ যক্ষ্মা রোগীদের মতো না-ও হতে পারে। যদিও যক্ষ্মা রোগে প্রধানত ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে থাকে, কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে ফুসফুস-বহির্ভূত যক্ষ্মায় আক্রান্তের হার অনেক বেশি। যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের অন্যতম পদ্ধতি হলো কফ পরীক্ষা এবং বুকের এক্স-রে করা। এই দুই ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক সময় এক্স-রেতে যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ সঠিকভাবে প্রকাশ পায় না এবং কফের মধ্যে জীবাণু পাওয়ার হার অনেক কম। যদি কোনো ডায়াবেটিস রোগী জ্বর-কাশিতে ভোগেন এবং বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরও অবস্থার উন্নতি না হয়, তখন যক্ষ্মা রোগের বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কফে জীবাণু পাওয়া না গেলে কালচার করা এবং এক্স-রেতে সন্দেহজনক লক্ষণ দেখা গেলে এফএনএসি করা যেতে পারে।
যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীদের বেলায় অতিরিক্ত সাবধানতার দরকার হয়। সঠিক নিয়মে পূর্ণমাত্রায় ওষুধ সেবন করলে ডায়াবেটিস রোগীদের বেলায়ও যক্ষ্মা রোগের ওষুধ সমানভাবে কার্যকর। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। কারণ, রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি হলে যক্ষ্মা বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং যক্ষ্মা রোগের ওষুধ সঠিকভাবে কাজ না-ও করতে পারে। সাধারণত বেশির ভাগ যক্ষ্মা রোগীর ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিন প্রয়োজন হয়। তবে যাঁদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা এত বেশি নয় এবং অন্য কোনো ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ইনসুলিনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এনে পরবর্তী সময়ে ইনসুলিনের পরিবর্তে ডায়াবেটিসের জন্য মুখে খাওয়ার ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যক্ষ্মা ও ডায়াবেটিসের ওষুধ একই সঙ্গে প্রয়োগ করার ফলে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না, তার প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে।
ডায়াবেটিস একটি এমন রোগ, যার দ্বারা শরীরের বেশির ভাগ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার যক্ষ্মা রোগও অনেক সময় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসার সময় অতিরিক্ত সাবধানতা প্রয়োজন। যেমন—যদি কোনো ডায়াবেটিস ও যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর বুকে বা পেটে পানি জমে, সে ক্ষেত্রে রোগীকে যক্ষ্মা রোগের ওষুধের সঙ্গে স্টেরয়ড-জাতীয় ওষুধ দিতে হয়, যা কিনা রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাভাবিক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ইনসুলিন নেওয়া লাগতে পারে। আবার যেসব ডায়াবেটিস রোগী দীর্ঘদিন থেকে ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাঁদের বেলায় কিডনির কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে যেসব যক্ষ্মার ওষুধ কিডনি দ্বারা শরীর থেকে নির্গমন হয়, সেগুলোর মাত্রা কমিয়ে দিতে হতে পারে, যেমন—ইথামবিউটস এবং স্ট্রেপটোমাইসিন। কোনো ডায়াবেটিস রোগীর যক্ষ্মা হলে রোগের ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং কার্যকর চিকিৎসা প্রয়োজন। ডটসের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগের কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রেও ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যকর যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার পূর্বশর্ত। তাই ডায়াবেটিস এবং যক্ষ্মা রোগের ক্ষেত্রে কার্যকর চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা একান্ত কাম্য।
এ কে এম মোস্তফা হোসেন
পরিচালক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৩, ২০১১
Leave a Reply