ককলিয়ার ইমপ্নান্ট একটি নতুন অপারেশনঃ ইতোপূর্বে এ দেশে সরকারিভাবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি এবং বেসরকারিভাবে দু-একটি অপারেশন হয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে সাড়া জাগাতে পারেনি। পরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি এবং টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা হয় এবং তারই ফলে এবার আমরা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে চারটি ককলিয়ার ইমপ্নান্ট অপারেশন করেছি। একসাথে চারটি ককলিয়ার ইমপ্নান্ট অপারেশন বাংলাদেশে এই প্রথম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
ককলিয়ার ইমপ্নান্ট একটি কৃত্রিম যন্ত্রঃ এটি অপারেশনের মাধ্যমে কানের ভেতরে স্থাপন করে দেয়া হয় এবং এই যন্ত্রের মাধ্যমে বাইরের শব্দ ব্রেইনে পৌঁছে, তখন মানুষ শুনতে পায়। যেসব শিশু জন্ম থেকে বধির, তাদের ব্রেইনে শব্দ পৌঁছে না, যার কারণে তারা শব্দ শোনে না এবং কথা শেখে না যদিও তাদের গলা এবং স্বরযন্ত্র সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এই সব শিশুদের যদি দুই-পাঁচ বছরের মধ্যে যন্ত্র স্থাপন করা হয় তবে তারা কথা শুনতে ও শিখতে পারে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। বিদেশে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি আছেন যাদের ছেলেবেলায় Cochlear implant Operation করা হয়েছে। বয়স বেড়ে গেলে এই যন্ত্র স্থাপন করলে খুব সুফল পাওয়া যায় না। তারা শব্দ শোনে কিন্তু ব্রেইন এই শব্দ বিশে্নষণ করে এর মর্মার্থ বুঝতে পারে না। ফলে তারা ভালোভাবে কথা শিখতে পারে না। তাই বধির শিশুদের যত তাড়াতাড়ি অপারেশন করা যায় ততই ভালো। আরেকটি গ্রুপ আছে যারা জীবনে কোনো সময় হঠাৎ করে সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেছে। তাদের কানে এই যন্ত্রটি স্থাপন করলে তারা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। ইতোপূর্বে আমরা যে রোগীর অপারেশন করেছি তিনি বর্তমানে স্বাভাবিক কাজকর্ম নিজে করতে পারছেন।
বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ লোক বিভিন্ন মাত্রায় বধিরতায় ভুগছেনঃ যাদের একটি বিরাট অংশ এই অপারেশনে উপকৃত হতে পারেন। প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে একটি শিশু জন্মবধির হয়। কেন বধির হয় এপষপয়মধ কারণে শিশুরা জন্মবধির হয় এবং এটি বেশি হয় স্বামী-স্ত্রী যদি আত্মীয় হয় তাদের সন্তানদের মাঝে। তা ছাড়া গর্ভাবস্থায় মা যদি মিজেলস, মামস, রুবেলা ইত্যাদি ক্ষতিকর ঠমড়ৎঢ়-এ আক্রান্ত হয় তখন গর্ভাবস্থায় সন্তানদের কানের সংবেদনশীল ককলিয়া নষ্ট হয়ে যায় এবং এই ককলিয়াই কানের প্রধান শ্রবণযন্ত্র। শিশু অবস্থায় যদি ব্রেইন ইনফেকশন হয় যেমন মেনজাইটিস তখনও ককলিয়া নষ্ট হয়ে যায়। মারাত্মক ডায়রিয়া হলেও এটা হতে পারে। জন্মের পর শিশুর খিঁচুনি বা জন্ডিস হলে, ক্ষতিকর কিছু ওষুধও কানকে নষ্ট করে দেয়। বড়দের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, ঠাণ্ডা-সর্দিসহ বিভিন্ন অজানা কারণে এইগুলো হয়। এই অপারেশন করার এক মাস পর সুইচ অন করা হয় তখন রোগী শুনতে পায় এবং শিশুদের তখন কথা শেখার ব্যবস্থা করতে হয়। তখন থেকে শিশুর বয়স এক দিন ধরতে হবে এবং মাঝে মধ্যে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। বিদেশে চিকিৎসা করলে প্রায় তিন মাস সেখানে একসাথে থাকতে হয়। তা ছাড়া বিদেশে শিশুদের বাংলা শেখানোর টিচার পাওয়া যায় না। এটা একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করে। তা ছাড়া খরচও প্রচুর। ভারতে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা, সিঙ্গাপুরে ১৮-২০ লাখ টাকা, অস্ট্রেলিয়ায় ৪৫-৫০ লাখ টাকা ও আমেরিকাতে ৭০-৮০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। বাংলাদেশে ৬-৭ লাখ টাকায় এই যন্ত্র দেয়া হচ্ছে। অপারেশন, ওষুধ এসবের খরচ সম্পূর্ণ ফ্রি। বিদেশী সার্জনের সহায়তায় এখন এই অপারেশন করা হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে এই চিকিৎসা যাদের প্রয়োজন তা সহজলভ্য করার জন্য সরকার এগিয়ে আসতে পারে। বাজেটে সামান্য বরাদ্দ থাকলে প্রতি বছর অনেক লোককে অপারেশন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এনবিআর কাষ্টম তাদের ট্যাক্স ফ্রি ও অন্যান্য প্রক্রিয়া সহজ করে দিতে পারে। বেসরকারি দাতা সংস্থা, দেশী-বিদেশী দানশীল ব্যক্তিরা এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে। তা ছাড়া বিভিন্ন কল্যাণমুখী ব্যাংক খুব স্বল্পসুদে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ঋণ দিতে পারে যা বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে। এই অপারেশনে তেমন কোনো জটিলতা নেই। আর ১০টা কানের অপারেশনের মতোই এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সফলতা নির্ভর করে Candidate নির্ধারণের ওপর। শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ শিশু যার বয়স দুই-পাঁচ বছর তার সফলতা খুবই ভালো। তা ছাড়া দেশের জন্য যারা শ্রুতিপ্রতিবদ্ধ তারা শব্দের জগতে প্রবেশ করে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালঃ প্রতি বছর দুইবার Temporal bone dissection workshop করা হয়। এ পর্যন্ত তিনটি workshop করা হয়েছে। প্রতি বার ১০ থেকে ১২ জন ইএনটি সার্জনকে মৃত মানুষের মাথার খুলির হাড়ে (যার নাম Temporal bone যেখানে কান থাকে) মাইক্রোস্কোপ ও ইলেট্রিক ড্রিল ম্যাশিন দিয়ে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কানের মাইক্রো সার্জারির জন্য এ প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। এ পর্যন্ত ৩২ জন বিশেষজ্ঞকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ প্রশিক্ষণে ইংল্যান্ড, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত মাইক্রো সার্জনরা প্রশিক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নাক-কান-গলা বিভাগে একটি অধ্যাধুনিক Temporal bone dissection lab রয়েছে এবং এখানে সাতটি Operative microscope আছে। মাইক্রোস্ক্রোপ দিয়ে কাজ করার দৃশ্য মনিটরে পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা আছে। এখানে একটি আধুনিক অডিওলজি সেন্টার আছে যেখানে রোগীদের কানের শরণশক্তি মাপাসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। নাক-কান-গলা বিভাগে গত বছর বিনামূল্যে কানের পর্দা লাগানোসহ ২১০টি কানের সফল মাইক্রো সার্জারি অপারেশন হয়েছে। যা দেশের জন্য একটি বিরাট সাফল্য। এ ছাড়া এখানে কানের সব ধরনের জটিল অপারেশন হচ্ছে।
——————————
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুলাহ
বিভাগীয় প্রধান, নাক-কান-গলা ও হেড-নেক সার্জারি বিভাগ ও অধ্যক্ষ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৯ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply