নাকের অ্যালার্জি রোগটি হলো অ্যালার্জিজনিত নাকের প্রদাহ। উপসর্গগুলো হচ্ছে অনবরত হাঁচি, নাক চুলকানো, নাক দিয়ে পানি পড়া এবং নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, কারো কারো চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং চোখ লাল হয়ে যায়।
যদিও বছর ধরেই এ রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। বিশেষ করে পুরান ধুলাবালি (যাতে মাইট থাকে), ছত্রাক বা পোষা প্রাণীর লোম সংস্পর্শে এলেই এর লক্ষণ শুরু হয়। তবে বসন্ত ঋতুতে ফুলের রেণু আধিক্য থাকে এবং ওই রেণুর সংস্পর্শ এলেই রোগের লক্ষণগুলো দেখা দেয়।
বারবার রোগাক্রান্ত হওয়ার মাত্রাঃ যদিও বাংলাদেশে কতজন এ রোগে ভুগে থাকেন তার সঠিক তথ্য নেই, তবে মোট জনগণের ১০-১৫ শতাংশ ভুগে থাকেন বলে অনেকেরই ধারণা। বিশ্বের কোনো কোনো দেশ বিশেষত অস্ট্রেলিয়ায় ৩০ শতাংশ লোক এ রোগে ভুগে থাকেন।
যদিও এ রোগের লক্ষণ যেকোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে, তবে শিশুদেরই এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায় বেশি। যদিও এ রোগটি বংশানুক্রমিক, তথাপি বারবার একই অ্যালারজেনের সংস্পর্শে এলেই রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া নতুন পোষা প্রাণী অথবা বাসস্থান পরিবর্তন নতুন পরিবেশে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস রোগের লক্ষণ প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
কিভাবে অ্যালার্জি নাকের উপসর্গগুলো ঘটায়ঃ যেসব রোগীর বংশানুক্রমিকভাবে অ্যালার্জি হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু কিছু অ্যালারজেনের সংস্পর্শে এলে রক্তের আইজিই-এর মাত্রা অনেক বেড়ে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে নাকে অবস্থিত মাস্ট সেল নামক এক ধরনের কোষের সাথে লেগে থাকে।
কোনোভাবে শরীর আবার এই অ্যালারজেনের সংস্পর্শে এলে মাস্ট সেলগুলো ভেঙে যায় এবং এর থেকে ভাসো একটিভএমাইনো নির্গত হয় এবং এই রাসায়নিক পদার্থগুলো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং উপসর্গগুলো ঘটায়।
এ রোগের সম্ভাব্য কারণগুলোঃ মাইট (যা পুরাতন ধুলাবালিতে থাকে) ঘরের ধুলা ময়লা, ফুলের রেণু, প্রাণীর পশম বা চুল প্রসাধনী সামগ্রী।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা কী? রক্ত পরীক্ষা, বিশেষ করে ইয়োসিনোফিলের মাত্রা বেশি আছে কি না, তা দেখা।
সিরাম আইজিইর মাত্রাঃ সাধারণত অ্যালার্জি রোগীদের ক্ষেত্রে আইজিইর মাত্রা বেশি থাকে।
স্কিন প্রিক টেস্টঃ এ পরীক্ষায় রোগীর চামড়ার উপর বিভিন্ন অ্যালারজেন দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং এ পরীক্ষায় কোন কোন জিনিসে রোগীর অ্যালার্জি আছে তা ধরা পড়ে।
সাইনাসের এক্স-রে
সমন্বিতভাবে এ রোগের চিকিৎসা
অ্যালারজেন পরিহারঃ যখন অ্যালার্জির সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় তখন তা পরিহার করে চললেই সহজ উপায়ে অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ওষুধ প্রয়োগঃ ওষুধ প্রয়োগ করে সাময়িকভাবে অ্যালার্জির উপশম অনেকটা পাওয়া যায়। এ রোগের প্রধান ওষুধ হলো এন্টিহিস্টামিন ও নেসাল স্টেরয়েড। এন্টিহিস্টামিন, নেসাল স্টেরয়েড ব্যবহারে রোগের লক্ষণ তাৎক্ষণিকভাবে উপশম হয়। যেহেতু স্টেরয়েডের বহুল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, তাই এ ওষুধ একনাগাড়ে বেশি দিন ব্যবহার করা যায় না। যত দিন ব্যবহার করা যায় তত দিনই ভালো থাকে এবং ওষুধ বন্ধ করলেই আবার রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়।
অ্যালার্জি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপিঃ অ্যালার্জি দ্রব্যাদি থেকে এড়িয়ে চলা ও ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপি অ্যালার্জিক রাইনাইটিস রোগীদের সুস্থ থাকার অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি। অ্যালার্জি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপির মূল উদ্দেশ্য হলো যে মাইট দ্বারা অ্যালার্জিক রাইনাইটিস সমস্যা হচ্ছে সেই মাইট অ্যালারজেন স্বল্পমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। ক্রমান্বয়ে সহনীয় বেশি মাত্রায় দেয়া হয় যাতে শরীরের অ্যালার্জির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না দেয় কিন্তু শরীরের ইমিউন সিস্টেমের পরিবর্তন ঘটায় বা শরীরের অ্যালার্জির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলে অর্থাৎ আইজিইকে আইজিজিতে পরিণত করে, যাতে দীর্ঘমেয়াদি অ্যালার্জি ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যদিও ওষুধ উপসর্গের কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসে কিন্তু অ্যালার্জির কোনো পরিবর্তন করতে পারে না, বিশেষত স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ অ্যালার্জির জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক। যেহেতু এই ওষুধ বেশি দিন ধরে ব্যবহার করতে হয়, তাই এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ ধরনের অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের ক্ষেত্রে ইমুনোথেরাপি বা ভ্যাকসিন বেশি কার্যকর।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বিশেষত উন্নত দেশগুলোতে এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই ভ্যাকসিন পদ্ধতির চিকিৎসাকে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস রোগের অন্যতম চিকিৎসা বলে অভিহিত করে। এটাই অ্যালার্জিক রাইনাইটিস রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থ থাকার একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি।
অনেকের ধারণা, অ্যালার্জিজনিত রোগ একবার হলে আর সারে না। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসাব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। প্রথম দিকে ধরা পড়লে অ্যালার্জিজনিত রোগ একেবারে সারিয়ে তোলা সম্ভব। অবহেলা করলে এবং রোগ অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে নিরাময় করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং অ্যালার্জিজনিত রোগের কোন চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। তাই গরিব রোগীরা তাবিজ-কবজের দিকে ঝুঁকে পড়েন আর সচ্ছল রোগীরা পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ও সময় দু’টোই অপচয় করছেন।
এ জন্য রোগীদের জানা দরকার, সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা গ্রহণ করলে এ রোগ থেকে পরে হাঁপানি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, উন্নত দেশের সব প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা বর্তমানে বাংলাদেশেই রয়েছে। অপচিকিৎসা নিয়ে মৃত্যুবরণ কিংবা বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় করে বিদেশে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।
————————————
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
অ্যালার্জি ও অ্যাজমা রোগ বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান, অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইমুনোলোজি বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা।
চেম্বারঃ দি অ্যালার্জি অ্যান্ড অ্যাজমা সেন্টার, ৫৭/১৫ পশ্চিম পান্থপথ, ঢাকা।
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৯ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply