শ্যালিকাকে লোকে বলে মধুর শ্যালিকা।
আর শ্যালিকা যদি নিমন্ত্রণ করে মধ্যাহ্ন ভোজনের তাহলে তো কথাই নেই। সে যদি রন্ধন-পটিয়সী হয়, তাহলে সে তৈরি করবে জামাইবাবুর প্রিয় প্রিয় খাবার। চিংড়ির মালাইকারি, সর্ষে ইলিশ অথবা তেল-কই, চিতল মাছের কোপ্তা, খাসির রেজালা, সরু চালের ভাত, চকোলেট পাই, পুডিং, নলেন গুড়ের পায়েসঃ এরকম সব আইটেমঃ
অন্যসব লোকের মত হলে সবগুলোর পদের কিছু কিছু চেষ্টা করবেন জামাইবাবু। কিন্তু কথা আছে। হেলথ ও বিহেভিয়ার বিশেষজ্ঞ থমাস ওয়াডেন বলেন, ‘ যে কোনো আহার পর্বে বিচিত্র সব খাবার থাকলে খাওয়া হয়ে যায় বেশি।’ এর কারণ হলো বিভিন্ন খাদ্যের রয়েছে নিজস্ব আকর্ষণ ও তৃপ্তির সীমারেখা। ক্ষুধার সুইচকে অফ করে দেয়ার কৌশলও আছে, শেখা যায় ইচ্ছে থাকলে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণরাসায়নিক সংকেত। কিছু কিছু খাবার বেশি বেশি খাওয়ার ইচ্ছা জাগ্রত করে, আবার অন্য কিছু খাবার বক্ ক্ষুধাকে দমিয়ে দেয়।
কি করা উচিত তাহলে?
কোনো বেলার খাবার বাদ দেবেন না
মেদস্থূলতা বিশেষজ্ঞ ডাঃ সি ওয়েন ক্যালাওয়ে বলেন, ‘যেসব লোক প্রাতঃরাশ বা মধ্যাহ্ন আহার খান না এরা সন্ধ্যে রাতে খাবার সময় অতিভোজন করেন। ক্রনিক ডায়েটারদের মধ্যে এটি প্রায়ই দেখা যায়।’ সমস্যা যা হয় তাহলো, কোনো বেলা খাবার বাদ দিলে, শরীরের যে গস্নাইকোজেন ভান্ডার, যা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়, এটি হ্রাস পায়। তখন শরীরে খাদ্যের চাহিদা হয় এবং ক্ষুধা লাগে।
ক্ষুধা মরে জলপানেঃ
পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডাঃ জর্জ বস্ন্যাকবার্ন বলেন, ‘ক্ষুধাকে কৃত্রিমভাবে হ্রাস করার একনম্বর রাস্তা হল জল পান করা।’ কারণ হলোঃ তরল জিনিস মুখগহ্বরকে সজীব করে, এর পেটের বেশি কিছু স্থান জুড়ে ফেলে, আর পাকস্থলী ভরাট হলে খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায়।
প্রতিদিন ৬৪ আউন্স তরল গ্রহণ করতে হবে। পানি ছাড়াও অন্য তরল পানীয় হলো সর তোলা দুধ, হার্বাল চা, লো ক্যালোরি ফলের রস। এক গ্লাস ফলের রস বা মাঠা বা ঘোল ঢক ঢক করে পান করা উচিত নয়, ওষুধ নয়তো এটি। দিনে সারাদিনে অল্প করে করে একসঙ্গে তিন/চার আউন্স করে পান করলে ভালো।
স্যুপ খাওয়া ভালো
১৯৮৯ সালে আমেরিকার জন হপকিনস্ বিশ্ববিদ্যালয়ের বারবারা রোলস ও সহকর্মীরা দু’হপ্তা ধরে ১২ জন পুরুষকে মধ্যাহ্নভোজনে আমন্ত্রণ করলেন। বিভিন্ন দিনে তারা পেলেন তিনটি এপিটাইজারে যে কোনো একটি। টমেটো স্যুপ, পনির ও ক্র্যাকারস অথবা তাজা ফল। প্রতিটি এপিটাইজোরে ক্যালোরি ছিলো সমান। এরপর এরা পুরো কোর্স খাবার খেলেন। টমেটো স্যুপ খেয়ে পুরোকোর্সে ক্যালোরি কম খাওয়া হলোঃ পনির বা ক্র্যাকারস এর তুলনায় ২৫% কম ক্যালোরি খেলেন পুরো কোর্সে আর স্যুপ পাকস্থলীর বেশ জায়গাও দখল করলো। ব্যাপার হলোঃ স্যুপ খাওয়াতে পেটের বেশ বড় জায়গা দখল হওয়াতে পুরো কোর্সের খাবার গ্রহণ কম হলো। ফলে মোট ক্যালোরি গ্রহণ করলেন কম।
সুমিত পরিমাণে নাস্তা খাবেনঃ
খাবারের বেলা যখন হবে এর আগে কিছু খেতে বারণ করতেন মা দিদারা। ভোজন করলে বিশেষ করে মিষ্টি মন্ডা, চিনি যদি এতে থাকে, তাহলে শরীর থেকে দীর্ঘক্ষণ ইনসুলিন ক্ষরণ হয়, এতে পালাক্রমে রক্তস্রোত থেকে বাড়তি চিনি সরে যায়, এতে মেদ সঞ্চয় এবং উৎপাদন উৎসাহিত হয়। বার বার কম কম করে খাবার খেলে হ্রস্ব সময় ধরে কম ইনসুলিন ক্ষরণ হয়। অনেকে মনে করেন, এতে মেদ উৎপাদন ও সঞ্চয় কমে, ফলে ঝরে শরীরের বাড়তি মেদ।
পুষ্টিবিদরা এই কম কম করে বার বার খাওয়াকে বলেন ‘Grazing’ চারণভূমিতে গবাদিপশু যেমন তৃণ, ঘাস খেয়ে বেড়ায়, সেরকম খাওয়ার ধরন। তবে এরকম তৃণভোজী প্রাণীর মত চরে বেড়িয়ে খেতে হলে বাছাই করতে হবে সঠিক খাবার। পুষ্টিবিদ জেমস, কেনে বলেন, ক্যান্ডি ও আইসক্রিম খাওয়া যায় না এভাবে, কারণ ইনসুলিন মান ও ক্ষুধা দুটোই বেড়ে যাবে। তবে কম চর্বি, আঁশবহুল খাবার যেমন গাজর, নাসপতি, আপেল, কমলা, মরিচ, গমের রুটি, আলু, ওটমিল এসব ‘Grazing’ করে খাওয়া যায়, ক্ষুধা কমে যায়। এভাবে কম কম করে খাওয়াকে বাধাহীন খাওয়া মনে হতে পারে, তাই আগাম খাওয়ার সিডিউল তৈরি করুন। দুই ঘন্টা পর পর স্বাস্থ্যকর ভালো খাবার অল্প করে খেতে পারেন।
জটিল শর্করা বেশি খাবেনঃ কয়েকবছর আগেও ডায়েটিং যারা করতে চাইতেন তাদেরকে বলা হত বেশি প্রোটিন কম শর্করা খাবার খেতে।
এসব খাবারকে পরে বলা হলো অস্বাস্থ্যকর এবং বিপজ্জনকও বটে। জটিল শর্করা সমৃদ্ধ ও কম চর্বি খাবার যেমনচৈাল, গম, শস্য, প্যাস্টা, আলু এগুলো ফিরে এসেছে আবার। আর শ্বেতসার হজম হয় এবং জমা হয় মেদের তুলনায় কম কার্যকরভাবে। কেনে বলেন, ‘এর মানে হলো শরীর মেদ বিপাক যখন করে তখন বিপাকহার যত হয় এর চেয়ে বেশি বিপাকহার হয় শ্বেতসার বিপাকের সময়। বিপাকহার উঁচু হলে তাপ উৎপন্ন হয় বেশি। এজন্য হয়ত ক্ষুধা হ্রাস পায়। পুষ্টিবিদরা বলেন দিনে ৬-১১ সার্ভিং শস্য, রুটি, গম, চাল খেলে ভালো।
প্রচুর আঁশ খাওয়া ভালো এতে মুখভর্তি খাবার চিবিয়ে খাওয়া হয়। ফলে খাওয়ার গতি ধীর হয়ে যায়, আর ধীরে আহার মানে হলো কম খাওয়া। এই বাড়তি সময় লাগাতে শরীর জেনে যায় জ্বালানি শরীরে এসেছে, আর দরকার নেই আহার করার। খাবারে দ্রবণীয় আঁশ যেমন বার্লি, বীনস, আপেল, কমলাজাতীয় ফল, বীট, গাজর ও আলু ইনসুলিনের সাড়া দমিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে আহারের পর ইনসুলিন মান বাড়ে, চিনি ও চর্বির বিপাক সহজ হয়। তবে দ্রবণীয় আঁশ আহারের পর ইনসুলিন মান কমিয়ে রাখে। এছাড়া আশসমৃদ্ধ খাবারে ক্যালোরি থাকে কম প্রতিটি গ্রাসেই, তাই মোট ক্যালোরিও কম খাওয়া হয়।
জানতে হবে কিসে ক্ষুধা উস্কে যায়ঃ
হতে পারে সিজলিং চিকেন বা কুড়মুড় পপকর্ন, পাপড় বা আলু ভাজা -গন্ধ, দর্শন, শব্দ এমনকি খাবারের সংযুতি অবিভোজনে উৎসাহিত করতে পারে। প্রথম, জিজ্ঞাসা করুন নিজেকে, কেন খেতে চান? হয়ত এর সঙ্গে ক্ষুধার কোনো সম্পর্ক নেই। দর্শন, গন্ধ, মনোলোভা খাবারঃদেখে খেতে মন বড় চায় -আবেগেও আহার করে মানুষ। অতিভোজনের পেছনে থাকে মনস্তাত্ত্বিক কারণ -মনের চাপে পড়ে অনেকে বেশি খান। মন খারাপ হলে অনেকের অতি ভোজন হয়।
প্রত্যেকের জীবনেই কোন না কোন সময় খাবারের প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্মায়। এ যেন তরঙ্গের আন্দোলনের মত, ঢেউয়ের ওপর সওয়াব হতে হতে এগিয়ে চলা, এক সময় সেই প্রবল আগ্রহ মিইয়ে যায়। এই ঢেউর সওয়ারী হওয়া সহজ হয়, নিজের মনকে বিক্ষিপ্ত করলে ধরুন গান শুনলেন, হাঁটলেন, ২০ মিনিটে প্রবল আগ্রহ কমে আসবে। চর্চায় জীবন হবে সহজ সরল। অতিক্রম করার চেষ্টা যত করা হবে, লক্ষ্যে পৌঁছানো তত সহজ হবে।
প্রকাশিত হয়েছে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ এম নজরুল ইসলাম-এর দুইটি বই
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বারডেম হাসপাতাল চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ এম নজরুল ইসলাম-এর ‘চোখের সাধারণ সমস্যা ১০০ প্রশ্ন ও উত্তর’ এবং ‘চোখ ও চশমা’ নামের দুইটি বই।
কম্পিউটার ব্যবহার করলে কি চোখের সমস্যা হয়, কাছে বসে টিভি দেখলে কি চোখের অসুবিধা হয়, শিশুদের চোখ কখন পরীক্ষা করানো উচিত, ফ্যাকো সার্জারি কি, অলস চোখ কাকে বলে, ডায়াবেটিসে চোখ অন্ধ হয় কেন, চোখে মাঝে মধ্যে ব্লাক আউট হবার কারণ কি, চোখে চুন পড়লে তার চিকিৎসা কি, উচ্চ রক্তচাপ থেকে চোখে কি কোন জটিলতা হতে পারে, চলিস্নশ বছর বয়সে চশমা লাগে কেন, মদ্যপানে কি চোখ অন্ধ হয়, কি কি ওষুধ চোখের জন্য ক্ষতিকর, চোখের কৃত্রিম লেন্স কোনটি ভালো এরকম ১০০ প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে ‘চোখের সাধারণ সমস্যা ১০০ প্রশ্ন ও উত্তর’ বইটিতে।
অপরদিকে ‘চোখ ও চশমা’ বইটিতে চশমার ইতিহাস, এর প্রয়োজনীয়তা, চোখের রিফ্রাকশন বা প্রতিসরণ-এর নানারকম ত্রটির চিকিৎসায় চশমার ব্যবহার, চোখের ছানি অপারেশন পরবর্তী চশমা, কন্টাক্ট লেন্স বিশেষ ধরনের চশমা যেমন সানগস্নাস বা রোদ চশমা, আয়না চশমা, রাতে গাড়ি চালাবার চশমা, দাগবিহীন মাল্টিফোকাল চশমা, কম্পিউটার ভিশন সিনড্রম এরকম নানা বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। অন্যদিকে যারা চশমা পরতে চান না তাদের জন্য চশমার পরিবর্তে ল্যাসিক সার্জারি সম্পর্কেও বইটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
চমৎকার প্রচ্ছদের এই দুইটি বই প্রকাশ করেছে ‘অন্যপ্রকাশ’। ৮০ পৃষ্ঠার দুইটি বই-এর মূল্য ১২০·০০ টাকা। লেখকের প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘চোখের উচ্চ চাপ গস্নকোমা’ এবং ‘ডায়াবেটিস ও চোখ’।
——————————–
অধ্যাপক ডাঃ শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস
বারডেম, ঢাকা।
দৈনিক ইত্তেফাক, ০৯ মার্চ ২০০৮
Leave a Reply