শাহীনা চৌধুরী কাজ করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নেওয়া তাঁর পুরোনো অভ্যাস। কিন্তু কয়েক দিন ধরে তাঁর কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে। যখনই তিনি বিছানায় বিশ্রাম নিতে যান, তখনই দুই পায়ে একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। মনে হয়, পা বেয়ে কী যেন উঠে আসছে। পা দুটো যেন খুবই অস্থির। যতই পায়ে স্থিরতা আনতে চান, ততই পা নাড়ানোর ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। পা নাড়ালে কিছুটা আরাম বোধ হয়। রাতে ঘুমানোর সময়ও একই ঘটনা ঘটে। ঘুমের মধ্যেও তিনি পা নাড়ান। আর থাকতে না পেরে শাহীনা গেলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক তাঁকে নানাভাবে পরীক্ষা করে জানালেন, তাঁর এই সমস্যাটির নাম ‘রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম’। কিছু পরীক্ষা করালেন, উপদেশ দিলেন। ব্যবস্থাপত্রও দিলেন। সমস্যাটি পুরোপুরি দূর না হলেও শাহীনা এখন খানিকটা ভালো আছেন।
‘রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম’ এমন এক ধরনের সমস্যা, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তির সংবেদী স্নায়ু, মোটর স্নায়ু এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। তাই এটিকে কেউ কেউ বলেন ‘সেন্সরি-মোটর সমস্যা’ আবার কোনো বিশেষজ্ঞ একে ‘ঘুমের সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ রোগে পায়ে এমন এক ধরনের অনুভূতি হয় যে পা না নাড়িয়ে উপায় থাকে না। ফলে নিজের ও শয্যাসঙ্গীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। দিনের যেকোনো সময় এ সমস্যাটি দেখা দিতে পারে। তবে বিশ্রাম বা ঘুমের সময় (সন্ধ্যায় ও রাতে) বেশি দেখা যায়। তরুণ বয়সে এ রোগটি শুরু হলে তা প্রথমে মৃদু থাকে, তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্রতা বেড়ে যায়। গবেষণার তথ্যানুযায়ী, সারা পৃথিবীতে ৭-১২ শতাংশ মানুষ এ সমস্যায় ভুগছেন। তবে মাত্র ১-২ শতাংশের চিকিৎসার দরকার হয়, বাকিদের লক্ষণগুলো মৃদু। পুরুষের তুলনায় নারীদের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কেবল পায়ে নয়, কোনো কোনো সময় হাতেও একই ধরনের অনুভূতি হতে পারে। ঝিনঝিনে, অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পায়ে বা হাতে ব্যথা হতে পারে। তবে পা বা হাত নাড়ালে আরাম বোধ হয়। অনেক সময় মনে হয়, পায়ের মাংসপেশির মধ্যে কোনো পোকা হাঁটাচলা করছে। অনেক সময় মনে হয়, পা দুটো যেন গরম হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো অনুভূতি হতে পারে, আবার কখনো মনে হয়, পায়ের হাড়ের মধ্যে কী যেন চুলকাচ্ছে। সব ধরনের অনুভূতির শেষ লক্ষ্য যেনতেন প্রকারে পা দুটোকে নড়ানো।
১৬৭২ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসাবিজ্ঞানী থমাস উইলি সর্বপ্রথম এ রোগটির বর্ণনা দেন। এরপর ১৮৬১ সালে জার্মান বিজ্ঞানী উইটম্যাক ‘অ্যাংটাস টিবিয়ারাম’ বা উদ্বিগ্ন পা হিসেবে এ রোগটিকে শনাক্ত করেন এবং এরপর ১৯৪৫ সালে সুইডিশ স্নায়ুবিজ্ঞানী কার্ল এক্সল একবম আরও গবেষণালব্ধ তথ্য প্রকাশ করে এর সংবেদী ও ব্যথাযুক্ত লক্ষণগুলো ব্যাখা করেন। সে সময় থেকে এ রোগের আরেক নাম ‘উইটম্যাক-একবম সিনড্রোম’। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগের কোনো সুস্পষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে খুঁজে পাওয়া কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শরীরে আয়রনের (লৌহ) ঘাটতি, কিডনির রোগ, গর্ভবতী হওয়া ইত্যাদি। গর্ভাবস্থায় এ সমস্যা দেখা দিলে সন্তান জন্মানোর পর তা আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগটি বংশগত। মস্তিষ্কে ‘ডোপামিনার্জিক’ ধরনের নিউরোট্রানসমিটারের তারতম্যের কারণে রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আবার অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, ফেনোথায়াজিন জাতীয় ওষুধ সেবন, বারবিচুরেট জাতীয় ওষুধ হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসের রোগ, স্ট্রোক, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি থেকেও ‘রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম’ হতে পারে। অনেক সময় ডায়াবেটিসজনিত নিউরোপ্যাথির সঙ্গে এ রোগের লক্ষণের কিছুটা মিল থাকে, তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও ভালোভাবে রোগীর রোগ বর্ণনা শুনতে হবে। অনেক সময় রোগের লক্ষণ এত তীব্র হয় যে রোগী দীর্ঘ সময় ধরে বাসে-গাড়িতে বা উড়োজাহাজে ভ্রমণ করতে পারে না।
সাধারণত রোগের বর্ণনা শুনেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগটিকে শনাক্ত করতে পারেন। তবে রক্তে আয়রন, শর্করা, অন্যান্য খনিজ, থায়রয়েড হরমোন ইত্যাদি দেখার প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া কিডনির পরীক্ষা, মস্তিষ্কের এমআরআই, ইএমজি ও পলিসমনোগ্রাফি করা লাগতে পারে। অনেক সময় নিউরোপ্যাথিক পেইন, আর্থ্রাইটিস, রক্তনালির সমস্যার লক্ষণের সঙ্গে রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমের লক্ষণের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাই প্রকৃত রোগ নির্ণয়ের জন্য উপযুক্ত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এ ধরনের রোগীদের বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতার মতো মানসিক সমস্যার প্রকোপও সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি।
চিকিৎসার শুরুতে প্রয়োজন কী কারণে এ সমস্যা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা। কোনো ওষুধের কারণে এমনটা হয়ে থাকলে সে ওষুধটি পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ঘুমের সাধারণ নিয়মকানুন বা স্লিপ হাইজিন মেনে চলতে হবে, যেমন—ঘুম ছাড়া অন্য কাজে (বসা, বিশ্রাম, টিভি দেখা) বিছানা ব্যবহার না করা, অতিরিক্ত চা, কফি পান না করা, ঘুমের আগে ভারী ব্যায়াম না করা, রাতে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার না খাওয়া, আলো ও শব্দযুক্ত শোয়ার কক্ষ পরিহার করা, ঘুমের আগে ভয়ের বা উত্তেজনাপূর্ণ টিভি অনুষ্ঠান না দেখা ইত্যাদি। এ ছাড়া ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ঘুমের আগে হালকা হাঁটাহাঁটি করা, এ রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষ সহায়ক। এ ছাড়া কেবল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের (নিদ্রা বিশেষজ্ঞ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ) পরামর্শে ও তত্ত্বাবধানে ডোপামিন এগোনিস্ট, গাবাপেন্টিন ও মৃদু ঘুমের ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে আয়রন ট্যাবলেট অথবা ইনজেকশনও লাগতে পারে। অনেক সময় পুরোদস্তুর চিকিৎসা পাওয়ার পরও রোগের লক্ষণ অনেকটাই থেকে যেতে পারে, তখন রোগীর জন্য প্রয়োজন হয় লাইফ স্টাইল মডিফিকেশন, সাইকোথেরাপি ও বিহেভিয়ার থেরাপি।
এ রোগটি জীবনসংহারী না হলেও যাপিত জীবনের মানকে কমিয়ে দেয় বহু গুণ, মন আর আবেগের ওপর ফেলে নানা কুপ্রভাব। তাই যত দ্রুত এ রোগের উপশমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।
আহমেদ হেলাল
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১২, ২০১০
নুরি
আমার বয়স ২৪ বছর। সমস্যা আমার বাম পায়ে রাত্রে হাটু থেকে গোড়ালির মাঝের হাড়ে খুব ব্যাথা হয়,যন্ত্রনা হয়, মাঝে মাঝে টান ধরে, টাটায়। যে কোন একদিকে শুয়ে থাকলে ঐ দিকটায় ঝি ঝি ধরে ।এখন আমি কি করতে পারি ?
Bangla Health
ঝি ঝি ধরার মূল কারণ খুব সম্ভবত ওখানে কোন কারণে রক্ত সঞ্চালনে বাঁধার সৃষ্টি হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা এই একই কারণেও হতে পারে।
হাঁড়ে কি কখনো আঘাতজনিত কারণে ব্যথা পেয়েছিলেন? যন্ত্রণা কখন কখন হয়?