‘ক্যানসার হয়েছে’ এ কথা শোনা মাত্রই বেশির ভাগ রোগীর জীবনযাপন আর স্বাভাবিক থাকে না। ক্যানসার রোগ যতটা না দুর্বল করে, তার চেয়ে শত শত গুণ ক্লান্ত শ্রান্ত করে দেয় দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা। ক্যানসার চিকিৎসার সফলতা নির্ভর করে সঠিকভাবে এবং সময়মতো চিকিৎসার প্রয়োগ করার ওপর। প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতিরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। ক্যানসার রোগের নানা ধরনের উপসর্গ থাকতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণীত হলে অবশ্য তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না।
এর ফলে মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার দেখা দিতে পারে। ক্যানসার রোগীর একই সঙ্গে অন্যান্য রোগও থাকতে পারে। এ ছাড়া রোগীর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পারিবারিক অবস্থা এবং যথেষ্ট চিকিৎসাব্যবস্থা প্রচলিত থাকা, না থাকাও কার্যকর চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই চিকিৎসার আগে, চিকিৎসাকালীন এবং চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে রোগীর শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি থাকা একান্ত প্রয়োজন।
মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখায় সহায়তা
মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা ক্যানসার চিকিৎসা প্রদানের পূর্বশর্ত। যত্নসেবাকারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো রোগী যাতে তার নির্ণীত রোগ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারে এর ব্যবস্থা করা। অনেক সময় আপনজন এসব বিষয় রোগীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে সক্ষম নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের মুরব্বিরা এ দায়িত্ব নিতে পারেন। রোগী তার রোগ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারলে, চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে আশা পেলে, মনে শক্তি পাবে।
রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা-সংক্রান্ত সহায়তা
রোগ নির্ণয়ের লক্ষ্যে এবং রোগের পর্যায়ভুক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। সহায়তা ছাড়া সময়মতো ও সুষ্ঠুভাবে এসব পরীক্ষা সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। এমন কিছু পরীক্ষা আছে, যা সম্পন্ন করতে অনেকে ভয় পায়। এক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় অহেতুক ভয় পেয়ে পরীক্ষা করানো হয় না। তাই অনেক সময় রোগ নির্ণয়ও সম্ভব হয় না।
এ ক্ষেত্রে সেবাযত্নকারীর দায়িত্ব হলো এসব পরীক্ষা সম্পর্কে তথ্য নেওয়া।
খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সহায়তা
নানা কারণে ক্যানসার রোগীর পুষ্টিহীনতা এবং খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ক্যানসার রোগের কারণে না হলেও চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশেষ করে রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপি চিকিৎসা পেলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। খাওয়ার রুচি কমে যায়। বমি বা বমির ভাব হয়। কখনো কখনো খাবারের স্বাদের পরিবর্তন হয়ে যায়। আশার কথা, ক্যানসার চিকিৎসার ফলে যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়, চিকিৎসা শেষ হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই তা সেরে যায়। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না নিলে রোগ নিরাময় করা বা দমন করা সম্ভব নয়।
বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সেবাযত্ন
রোগীর বিভিন্ন উপসর্গ থাকতে পারে, যেমন ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, বমি অথবা বমির ভাব, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, পাতলা পায়খানা, রক্তক্ষরণ, শরীর জ্বালাপোড়া, দুর্বলতা ইত্যাদি সমস্যা। এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সে অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে। চিকিৎসার পাশাপাশি কীভাবে সেবাযত্ন করলে এসব উপসর্গ লাঘব হবে, তাও জেনে নিতে হবে। শিখে নিতে হবে কীভাবে নলে খাবার দিতে হবে এবং কতক্ষণ পরপর কী কী খাবার দিতে হবে। মূত্রথলিতে প্রস্রাব জমে গেলে, প্রস্রাব করতে অপারগ হলে মূত্রথলি ক্যাথিটার দিয়ে প্রস্রাব করাতে হয়। শরীরে কোনো ক্ষত থাকলে এবং তা থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হলে, কীভাবে ক্ষত সারাতে হবে, দুর্গন্ধ কমাতে হবে, তা জেনে নিতে হবে।
আর্থিক সহায়তা
ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। শুধু যে চিকিৎসা (যেমন অপারেশন, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি) প্রয়োগে অর্থ ব্যয় হয়, তা নয়। রোগ নির্ণয় এবং পর্যায়ভুক্তির জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও কম খরচ হয় না। চিকিৎসাকালীন ও চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেশির ভাগ রোগীরই আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন।
পারভীন শাহিদা আখতার
অধ্যাপক, ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৫, ২০১০
Leave a Reply