ডায়াবেটিস খুব ‘কমন’ একটা রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বে এ রোগটি এখন মহামারি আকারে বিদ্যমান। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশেরও বেশি লোকের ডায়াবেটিস আছে। সেই হিসাবে এখন প্রায় ৮০ লাখ লোকের ডায়াবেটিস আছে আমাদের দেশে। এর প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-২ ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রচলিত কিছু বিশ্বাস ও ভ্রান্তি নিয়ে কিছু কথা:
১. বেশি বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়
ধারণাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য কিছু ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ আছে। এগুলোর মধ্যে আছে বয়স ৪৫ বছরের বেশি হওয়া, শরীর বেশি মোটা হওয়া (বিএমআই কিংবা কোমর ও নিতম্ব অনুপাত বেশি), পরিবারে বাবা, মা, ভাই কিংবা বোনের কারও ডায়াবেটিস থাকা, শারীরিক পরিশ্রম, হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম কম করা, রক্তে এইচডিএলের মাত্রা ৩৫-এর কম আর ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা ২৫০-এর বেশি থাকা, রক্তচাপ ১৪০/৯০ মিমি পারদের বেশি থাকা, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়া, বেশি ওজনের (চার কেজির মতো) বাচ্চা প্রসবের ইতিহাস থাকা, খালি পেটে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ১১০-১২৫ মিলিগ্রাম (৬.১ মিলিমোল থেকে ৬.৯ মিলিমোল/লিটার) এবং ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ১৪০-১৯৯ মিলিগ্রাম (৭.৮ মিলিমোল থেকে ১১ মিলিমোল/লিটার) হওয়া অর্থাৎ ‘প্রি-ডায়াবেটিক’ হওয়া। তবে একসঙ্গে বেশি মিষ্টি খেলে হঠাৎ করেই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি হয়ে যায়। এটা একটা সমস্যা। তা ছাড়া মিষ্টি খেয়ে খেয়ে বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করে ঠিকমতো হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম না করলে সে ক্যালোরি শরীরে জমা হবে; শরীর মোটা হবে। বেশি ক্যালোরির খাবার, তা সে ভাত-চিনি-মিষ্টি থেকেই হোক আর তেল-চর্বি থেকেই হোক, শরীরের ওজন বাড়াতে সহায়ক হবেই। তাতে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।
২. ডায়াবেটিস হলে মিষ্টি খাওয়া যায় না
এ ধারণাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। মিষ্টি শর্করাজাতীয় খাবার; শরীরে ক্যালোরির চাহিদা হিসাব করে; বেশি নয়, সামান্য কিছু তো খাওয়া যাবে। ডায়াবেটিস হলে শুধু মিষ্টি কেন, সব খাবারই হতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিমিত। স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকার অংশ হিসেবে সামান্য পরিমাণে মিষ্টি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়া যেতেই পারে।
৩. মোটা না হলে ডায়াবেটিস হয় না
শরীর বেশি মোটা হওয়া ডায়াবেটিসের একটি রিস্ক ফ্যাক্টর। তবে মোটা না হলেই যে ডায়াবেটিস হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। শরীর মোটা না হলেও অন্য কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর থাকলে ডায়াবেটিস হতে পারে।
৪. ডায়াবেটিস হলে কেবল বিশেষ খাবার অর্থাৎ ‘ডায়াবেটিস খাবার’ খেতে হয়
আসলে একবারে বিশেষ খাবার বা ‘ডায়াবেটিস’ খাবারই খেতে হয় না। খাবারটা অন্যদের খাবারের মতো স্বাভাবিকই। তবে তা হতে হয় শরীরে ক্যালোরির প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী পরিমিত এবং সুষম। তাতে যেসব শর্করাজাতীয় খাবার খেলে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ে এমন পূর্ণ দানাশস্যের শর্করা ও আঁশ থাকবে বেশি আর তেল-চর্বি থাকবে কম। যেসব ফলে শর্করার পরিমাণ বেশি, সেসবও খেতে হবে পরিমিত।
৫. ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক
ডায়াবেটিস মোটেও ছোঁয়াচে বা সংক্রামক নয়। স্ত্রীর ডায়াবেটিস থাকলে স্বামীর বা স্বামীর থাকলে স্ত্রীর হবে এমন কথা সঠিক নয়। তবে বাবা, মা, ভাই কিংবা বোনের কারও ডায়াবেটিস থাকলে ডায়াবেটিস হতে পারে। তা তাদের সঙ্গে সংস্পর্শে থাকার কারণে নয়; পারিবারিকভাবে শারীরিক গঠনে থাকার কারণে।
৬. পরিবারে কারও ডায়াবেটিস না থাকলে ডায়াবেটিস হবে না
এ ধারণা সঠিক নয়। পরিবারে কারও ডায়াবেটিস না থাকলেও অন্য কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর উপস্থিত থাকলে ডায়াবেটিস হতে পারে।
৭. ডায়াবেটিস হলে জীবনটা একেবারে বরবাদ
মোটেও না। বরং জীবনটা হয় আরও বেশি সুশৃঙ্খল। আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুস্থ কর্মমুখর জীবন যাপন করা যায় বছরের পর বছর। এরূপ উদাহরণ অনেকেই।
৮. ডায়াবেটিস হয়েছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখতে এখনো ওষুধ লাগে না, তাই রোগটা মারাত্মক নয়
কারও ডায়াবেটিস হয়েছে, কিন্তু এখনো কোনো ওষুধ লাগে না, ব্যায়াম আর খাবার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ আছে, এরূপ অবস্থায় রোগটা মারাত্মক নয়, এমন ভাবা ঠিক নয়। ডায়াবেটিস ডায়াবেটিসই। নিয়ন্ত্রণে না রাখলে, তা সে শারীরিক পরিশ্রম, ব্যায়াম আর খাবার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই হোক বা ওষুধের মাধ্যমেই হোক, অনেক জটিলতা এমনকি মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে ডায়াবেটিস। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন খুবই জরুরি।
৯. ইনসুলিন ইনজেকশন লাগে, তাই ডায়াবেটিস খুব মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে
বাস্তবিক পক্ষে ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ যা সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে এমন পর্যায়ে উপনীত হয়। এর মানে ডায়াবেটিস মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাওয়া নয়। ডায়াবেটিস শুরুর এমন দিকে শরীরে যে পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি হতো, পরে সে পরিমাণ হয় না, কমে যায়। ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। তাই সময়ের ব্যবধানে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য একসময় ইনসুলিন ইনজেকশন ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। এটা মূলত অন্য উপায়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার মতোই।
১০. ওষুধ খেলে বা ইনজেকশন নিলে সব খাবারই বেশি বেশি খাওয়া যাবে
ধারণাটি মোটেও ঠিক নয়। ওষুধ নিলেও খাবার হতে হবে পরিমিত এবং সুষম। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খাবারে থাকতে হবে নিয়ন্ত্রণ, জীবনে থাকতে হবে শৃঙ্খলা আর প্রয়োজনে গ্রহণ করতে হবে ওষুধ।
মো. শহীদুল্লাহ
বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ
কমিউনিটি বেজড্ মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ
ছবি: সৈকত ভদ্র
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৯, ২০১০
তাজুল ইসলাম
অনেক সুন্দর হয়েছে।