আমাদের শরীরের কোনো অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ যতক্ষণ না স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটায়, সে পর্যন্ত সাধারণত আমরা সেটির কার্যক্রম জানতে পারি না। সেই প্রত্যঙ্গের কার্যকরতা বিঘ্নিত হলে কারণটি অপসারণের চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থা নিতে হয়। এ রকম একটি প্রত্যঙ্গ হচ্ছে কিডনি। শরীরের নিম্নাঙ্গের অভ্যন্তরে পিঠের দিকে বাঁ ও ডান পাশে কিডনি দুটির অবস্থান। এই কিডনির কার্যকরতা নানা কারণে বিঘ্নিত হতে পারে। কার্যকরতা অবাধ রাখার জন্য যে চিকিৎসাভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাকে বলা হয় ডায়ালাইসিস।
কার্যকরতা
প্রথমে সবাইকে জানতে হবে দুই কিডনির প্রয়োজনীয়তা বা শরীর যন্ত্র চালু রাখতে ডায়ালাইসিসের কী ভূমিকা রয়েছে। কিডনির কাজ হচ্ছে: ১. আমাদের শরীরে খাবার গ্রহণের পর যেসব বর্জ্য পদার্থ জমা হয় সেগুলোকে রক্তপ্রবাহ থেকে আলাদা করে বা ছেঁকে মূত্রথলিতে পাঠানো, ২. পরিষ্কার করার পর বিশুদ্ধ রক্তকে পুনরায় শরীরে সঞ্চালনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রত্যঙ্গে পাঠানো, ৩. শরীরে রক্তস্বল্পতার কারণ দূর করা, ৪. শরীরে প্রয়োজনীয় উপাদান এসিডের ভারসাম্য রক্ষা করা। এই এসিড শরীরে রক্তের সব উপাদানের কার্যকরতা বজায় রাখে।
কিডনি অকার্যকর হওয়ার কারণ
১. রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হলে, ২. বহুমূত্র রোগ নিয়ন্ত্রণ করা না হলে, ৩. ত্রুটি, ৪. কিছু ওষুধের বিশেষ করে যন্ত্রণানাশক ওষুধের অবারিত ব্যবহার, (৫) মূত্রনালির প্রদাহজনিত সংক্রমণ।
অকার্যকরতার লক্ষণ
১. উচ্চ রক্তচাপের অনুভূতি, যেমন মাথা ধরা, ঘাড়ব্যথা, মাথা ঘোরানো, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি; ২. বমির ভাব ও বমনোদ্রেক; ৩. তলপেট ও কোমরে ব্যথা; ৪. মাথা ঝিমঝিম করা; ৫. সাধারণভাবে শারীরিক দুর্বলতার অনুভূতি; ৬. নিঃশ্বাস গ্রহণে অসুবিধা; ৭. পায়ে ও মুখে পানি জমা হয়ে ফুলে যাওয়া; ৮. বারবার প্রস্রাবের বেগ।
চিকিৎসা
লক্ষণগুলো দেখা গেলে অবিলম্বে একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ বা নেফ্রোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সুষম খাদ্যাভ্যাস করতে হবে। বিশেষ করে আমিষযুক্ত ও তৈলাক্ত খাবার কম খেতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কিডনির কার্যকরতা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন সময় রক্ত ও প্রস্রাব অন্তত বছরে একবার নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে।
চিকিৎসা পদ্ধতি
কিডনির কার্যকরতা বিনষ্ট বা বিঘ্নিত হলে ডায়ালাইসিস করতেই হবে। ডায়ালাইসিস হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে রক্ত বিশুদ্ধ করা। ডায়ালাইসিস করা একবার শুরু হলে জীবনভর চালু রাখতে হবে। এই ডায়ালাইসিস পদ্ধতি ব্যয়বহুল এবং আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। একটি সমীক্ষায় জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ ব্যক্তি কিডনির নানা পর্যায়ের অকার্যকরতার কারণে অসুস্থ। অথচ তাদের প্রধান চিকিৎসা ডায়ালাইসিস সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ৪১টি ডায়ালাইসিস সেবাদানকারী কেন্দ্রে। এসব কেন্দ্রে সর্বাধিক বছরে মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাজার রোগী ডায়ালাইসিস চিকিৎসা নিতে পারে। তাও আবার ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে সবার পক্ষে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া দেশে কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ যাঁরা যথাযথ চিকিৎসা ও সময়মতো ডায়ালাইসিসের পরামর্শ দিতে পারেন, তাঁদের সংখ্যাও নগণ্য। বস্তুত প্রয়োজনের এক-দশমাংশ।
ডায়ালাইসিস একটি বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা। যা শুধু যথার্থ ও সঠিকভাবেই করতে হবে। এ জন্য একটি ডায়ালাইসিস কেন্দ্রে আধুনিক ও সঠিক চিকিৎসার যন্ত্রাদি থাকতে হবে। শিক্ষিত ও ডিপ্লোমাধারী নার্সের মাধ্যমে ডায়ালাইসিস দিতে হবে। চিকিৎসাকেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের জন্য ডায়ালাইসিস ও কিডনি রোগ চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক থাকতে হবে। কেন্দ্র হতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ডায়ালাইসিসের জন্য দেশে বেশ কিছু সেবাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তবে যে কেন্দ্রে রোগীর ডায়ালাইসিস করানো হবে, সে কেন্দ্র সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিতে হবে।
সবশেষে বলা প্রয়োজন, ডায়ালাইসিস গ্রহণকারী ও তার পরিসেবাকর্মীদেরও চিকিৎসাকালে ও পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে, ডায়ালাইসিস গ্রহণ সঠিক না হলে, অপচিকিৎসা হলে শেষ পর্যন্ত কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। আমাদের দেশে এখনো প্রতিস্থাপন ব্যবস্থা সঠিক ও পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। তা ছাড়া দু-একটি প্রতিষ্ঠানে এ ব্যবস্থা থাকলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
নাসিম মূসা
মেডিকেল ডিরেক্টর
আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন ডায়ালাইসিস সেন্টার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৯, ২০১০
Leave a Reply