ফরিদপুরে গত ৪৮ ঘণ্টায় নতুন করে অজ্ঞাত রোগে আর কারোর আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। রোগটি সত্যিই নিপাহ ভাইরাসজনিত কি না সেটি নিশ্চিত হতে ঢাকা থেকে ছয় সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল গতকাল মঙ্গলবার ফরিদপুরে এসেছে।
পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা এলাকায় ‘অজ্ঞাত’ রোগের আতঙ্ক তীব্রতর হয়েছে। তবে এলাকা ঘুরে এসে পাবনার সিভিল সার্জন, বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলেছেন, চাকলা এলাকায় ‘অজ্ঞাত রোগ’ বলে কিছু নেই। অজ্ঞাত রোগে যাঁরা মারা গেছেন বলা হচ্ছে তাঁদের মধ্যে দুজন বার্ধক্যজনিত জটিলতায় এবং বাকি তিনজন হৃদরোগে মারা গেছেন। তবে মৃত্যুর ঘটনাগুলো খুব কম সময়ের মধ্যে ঘটায় ঘাবড়ে গিয়ে লোকজন অসুস্থ বোধ করছেন।
সিভিল সার্জন ডা· ওয়াদুদ ভঁূইয়া গত সোমবার রাতে চাকলায় যান এবং অসুস্থ বোধ করা ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এলাকায় গতকালও অনেকে অসুস্থ বোধ করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা· এ কে এম খালেকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অমূলক আতঙ্ক থেকেই লোকজন অসুস্থ বোধ করছেন। যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তাঁদের সবাইকে সাধারণ কিছু ওষুধের পাশাপাশি সাহস দেওয়া হয়েছে। এরপর বেশির ভাগ রোগীই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
ফরিদপুরে বিশেষজ্ঞরাঃ ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা· মো· শাহীন জানান, নতুন করে ‘অজ্ঞাত’ রোগে আক্রান্ত কেউ গত দুই দিনে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। তবে আগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন তিনজন রোগীর মধ্যে দুজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। তারা হচ্ছে বোয়ালমারীর কবিতা বিশ্বাস (৩২) ও ফরিদপুর সদরের হারুন মোল্লা (৩)। তবে চিকিৎসাধীন সদরপুর উপজেলার দীপু মাতব্বরের (২৮) অবস্থা উন্নতির দিকে।
ফরিদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) এবং ইনস্টিটিউট অব এপিডেমলজি ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) ছয় সদস্যের একটি দল ডা· জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে ফরিদপুরে এসেছে।
ডা· জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা গতকালই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন রোগীর রক্ত, মেরুদণ্ডের রস ও গলা থেকে লালা সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, তাঁরা বেশি আক্রান্ত রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বড় হিজলা গ্রাম পরিদর্শন এবং সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করবেন।
শিশু রাকিবের মৃত্যু প্রসঙ্গে জেলার বোয়ালমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা· মো· নাজির উদ্দিন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি রাকিবদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পেরেছেন বাড়ির সবাই খেজুরের কাঁচা রস খেয়েছিল। তবে অন্য কারোর সমস্যা হয়নি। আরেক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা· মোহাম্মদ রফিকুল কবীর জানান, তিনি বাওরকান্দির দুর্গম এলাকায় গিয়ে কবিতা বিশ্বাসের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছেন। কবিতা গত ২১ ফেব্রুয়ারি জ্বরে আক্রান্ত হন এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।
ডা· রফিক আরও বলেন, কবিতা এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত। তবে তা নিপাহ ভাইরাসজনিত কি না তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিনি সতর্কতা হিসেবে তাল বা খেজুরের রস, বাদুর ছোঁয়া কলা, পেয়ারা ইত্যাদি ফল খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান থাকার পরামর্শ দেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মর্তা ডা· নারায়ণচন্দ্র সেন বলেন, জ্বরে কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়লে রোগীকে দ্রুত স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পাবনার বেড়ায় আতঙ্কঃ বেড়া উপজেলার চাকলা ইউনিয়নের চাকলা, দমদমা ও পাঁচুরিয়া গ্রামের লোকজন জানায়, গত বৃহস্পতিবার চাকলার করিম মোল্লার (৪৫) হঠাৎ মৃত্যু হয়। এরপর রোববার কুলসুম বেগম (৭৫), এলাহী মোল্লা (৮০) ও আবু বক্কার (৫০) মারা যান। গত সোমবার সকালে চাকলার নাসির উদ্দিনের স্ত্রী রুমা খাতুন (২০) হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেলে গ্রামবাসীর আতঙ্ক চরমে পৌঁছে। সোমবার বিকেল থেকে রাত সাতটা পর্যন্ত গ্রামের ১২ ব্যক্তিকে বেড়া হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এ পরিস্থিতিতে সিভিল সার্জন ডা· ওয়াদুদ ভূঁইয়া রাত আটটার দিকে চাকলা গ্রামে যান। এরপর সিভিল সার্জন ও ডেপুটি সিভিল সার্জনের উপস্থিতিতে চাকলা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে অস্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেরা অসুস্থদের গভীর রাত পর্যন্ত চিকিৎসা দেন।
এদিকে গত সোমবার রাত থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত চাকলা, দমদমা, পাঁচুরিয়া, খাকছাড়া ও নলভাঙা গ্রামের কমপক্ষে ৪০ জন নতুন করে অসুস্থ বোধ করছেন বলে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে ১৩ জনকে গতকাল বেড়া হাসপাতালে এবং ২০ জনকে সোমবার রাতে চাকলা ইউপি কার্যালয়ে স্থাপিত অস্থায়ী স্বাস্থ্যশিবিরে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
পাবনার সিভিল সার্জন প্রথম আলোকে বলেন, চাকলা গ্রামে চারজনের মৃত্যুর খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে জেনেছি দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের একজন বার্ধক্যজনিত ও ক্যান্সার এবং একজন হৃদরোগে ভুগছিলেন। অন্য দুজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। একের পর এক মৃত্যুর ঘটনাটিকে অজ্ঞাত রোগ মনে করে ভয়ে আরও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চাকলা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য কর্মীদের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। চাকলা গ্রামে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কথা হয় জেলার পুষ্টিবিদ আলিউর রেজার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গুজব ও আতঙ্কের কারণে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমি এলাকাতে ঘুরে লোকজনকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
এদিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়ে গতকাল বেলা ১১টায় ‘র্যাপিড রেসপন্স টিমের’ এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আরও ২৪ ঘণ্টা নিপাহ ভাইরাজনিত রোগের বিষয়ে নেওয়া সতর্কতামূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সিভিল সার্জন ডা· মতিয়ার রহমান বলেন, নতুন করে কোনো রাগী আক্রান্ত না হওয়ায় বলা যায় সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৫, ২০০৮
Leave a Reply