শিমের বিচির মতো দেখতে আমাদের দুটি কিডনি। হাতের মুঠি যে পরিমাণ, সে পরিমাণ আয়তন এর। পিঠের মধ্যস্থলের কাছাকাছি এর অবস্থান, পাঁজরের খাঁচার ঠিক নিচে।
কিডনি দুটি রক্ত পরিস্রবণ করে। কিডনি কাজ করে ছাঁকনি বা পরিস্রাবকের মতো। এই পরিস্রবণের কাজ চলে কিডনির খুব সূক্ষ্ম অসংখ্য এককের মধ্যে। এই এককগুলোর নাম হলো নেফ্রোন। একটি কিডনির মধ্যে রয়েছে ১০ লাখ নেফ্রোন।
দেহের বর্জ্য ও বাড়তি পানি এরা সরিয়ে ফেলে, যা মূত্র হিসেবে নির্গত হয়। মূত্র প্রবাহিত হয় মূত্রনালি দিয়ে, জমা হয় মূত্রথলিতে।
কিডনি দুটিতে রক্ত চলাচল হয় অনেক। প্রতি মিনিটে প্রায় এক হাজার ২০০ মিলিলিটার রক্ত কিডনি দুটি দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ থেকে ১২০-১২৫ মিলিলিটার প্রতি মিনিটে পরিস্রুত হয় কিডনি দিয়ে, এই হারকে বলে গ্লুমেরুলার ফিলট্রেশন রেট বা জিএফআর।
নেফ্রোনের মধ্যে সূক্ষ্ম রক্তনালি বা কৈশিকার জাল হলো গ্লুমেরুলাস। এই অসংখ্য সূক্ষ্ম কৈশিকার জাল দিয়ে পরিশ্রুত তরল হলো গ্লমেরুলার ফিলট্রেট।
স্বাভাবিক জিএফআর (১২০ থেকে ১২৫ মিলিলিটার/মিনিট) থাকলে পূর্ণবয়স্ক লোকের গ্লুমেরুলার ফিলট্রেট প্রতিদিন তৈরি হয় ১৭৫ থেকে ১৮০ লিটার, এর মধ্য থেকে এক দশমিক পাঁচ লিটার বেরিয়ে যায় মূত্র হিসেবে।
দেহের কোষকলার ভাঙন এবং খাদ্য বিপাকের ফলে যে বর্জ্য তৈরি হয়, তা আসে রক্তে।
খাদ্য থেকে যা প্রয়োজন তা শরীর গ্রহণ করার পর বর্জ্য চলে আসে রক্তে। কিডনি এই বর্জ্য সরিয়ে নিতে না পারলে তা জমা হতে থাকে শরীরে, ক্ষতি হয় শরীরের।
কিডনির ভেতরে সূক্ষ্ম যে এককগুলো, রক্তকে পরিশোধন করা যাদের কাজ, এগুলোর ক্ষতি হলে কিডনির রোগ শুরু হয়ে থাকে। দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে আস্তে আস্তে এই ক্ষতি হতে থাকে।
দুটি কিডনিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় কখনো। অনেক সময় উপসর্গও থাকে না, তাই রোগী বুঝতেও পারেন না যে কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তিনি।
কিডনি নিষ্ত্র্নিয় হয়ে যাওয়া বা ‘কিডনি ফেইলিওর’ ব্যাপারটি ঘটে কেন? বলা হয়েছিল নেফ্রোনের কথা, এর ওপরই আঘাত আসে। নেফ্রোনের ক্ষতি হঠাৎই হতে পারে, হয়তো আঘাতের জন্য বা বিষক্রিয়ার জন্য।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেফ্রোনগুলো নষ্ট হতে থাকে ধীরে ও নীরবে। হয়তো বেশ কয়েক বছর পর ক্ষতিটি বুঝতে পারেন রোগী, এর মধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
কিডনি রোগের পেছনে প্রধান দুটি কারণ হলো ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। আর পরিবারে কারও যদি কিডনির রোগ থাকে, তাহলে এটিও বড় ঝুঁকি।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস হলে শরীর গ্লুকোজকে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে না। গ্লুকোজ বিপাক হওয়ার বদলে থেকে যায় রক্তে, আর জমতে থাকে। এ রকম চলতে থাকলে একসময় নেফ্রোনগুলো নষ্ট হতে থাকে। একে বলা হয় ‘ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি’। তাই ডায়াবেটিস থাকলে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রেখে ঠেকানো যায় কিডনির রোগ।
উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ হলে কিডনির ছোট ছোট রক্তনালির ক্ষতি হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত রক্তনালি রক্ত থেকে বর্জ্য ছেঁকে ফেলতে পারে না। চিকিৎসক রক্তচাপ কমানোর ওষুধ দিতে পারেন। হতে পারে তা এসিই ইনহিবিটার বা এআরবি-এ রকম ওষুধ।
রক্তচাপ কমায় আবার কিডনিকে সুরক্ষা দেয়-এ রকম ওষুধই পছন্দ করেন চিকিৎসকেরা। যুক্তরাষ্ট্রের এইএইচবিএলের মত হলোঃ যাদের ডায়াবেটিস আছে বা কিডনির কাজকর্ম হ্রাস পেয়েছে, তাদের রক্তচাপ থাকা উচিত ১৩০/৮০-এর নিচে।
বংশগতি
কিডনির কিছু রোগ হয় উত্তরাধিকার সূত্রে, হতে পারে পরিবার-পরম্পরায়ও। পরিবারের কারও যদি যেকোনো ধরনের কিডনির সমস্যার থেকে থাকে, তাহলে কিডনি রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
সুস্থ কিডনি অপরিহার্য কেন
* কিডনি দুটি রক্ত থেকে ছেঁকে নেয় বর্জ্য ও বাড়তি পানি এবং মূত্র হিসেবে সেগুলো বেরিয়ে যায়।
* রক্তের ইলেকট্রোলাহা ও পানি এগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করে।
* রক্তের পিএইচ বজায় রাখে।
* উৎপন্ন করে ইরিথ্রোপয়টিন নামে একটি হরমোন, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো রক্তমজ্জাকে উদ্দীপ্ত করে লোহিত কণিকা তৈরি করা।
* তৈরি করে রেনিন; এই হরমোনের কাজ হলো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
* উৎপন্ন করে ক্যালসিট্রাজোল; এই হরমোনের কাজ হলো রক্তের ক্যালসিয়াম নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা।
কিডনি রোগের ঝুঁকি কীভাবে জানা যাবে
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, মা-বাবা, ভাইবোন কারও কখনো কিডনি নিষ্ত্র্নিয় হয়ে থাকলে আপনিও চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কিডনির রোগ আগাম প্রতিরোধের চেষ্টা করলে তা জীবন বাঁচাতে ভুমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।
কিডনির রোগ আছে তা চিকিৎসক কীভাবে বুঝবেন
কিডনির রোগের প্রাক-অবস্থা থাকে সুপ্ত। উচ্চ রক্তচাপ যেমন থাকে নীরবে, কোনো উপসর্গ নেই। রোগ থাকতে পারে, কিন্তু জানা গেল না-কারণ শরীর অসুস্থও মনে হয় না।
কিছু টেস্ট করুন
* রক্তের ক্রিয়েটিনিন মান পরীক্ষা করিয়ে নিন। এ থেকে গ্লুমেরুলার ফিলট্রেশনের হার বের করা যায়।
* মূত্রে প্রোটিনের উপস্থিতি ও পরিমাণ নির্ণয় করান। প্রোটিন বেশি থাকলে বুঝতে হবে, কিডনি ভালো কাজ করছে না।
* সঠিকভাবে রক্তচাপ পরীক্ষা করান।
প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসার
কিডনির রোগ অনেক সময় সম্পূর্ণ ভালো হয় না। তবে কিডনির রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে এবং তখন ুকিছু পদক্ষেপ নিলে কিডনি দুটি দীর্ঘদিন সজীব রাখাও সম্ভব। এটিও নিশ্চিত হতে হবে যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো গেছে, কারণ কিডনির রোগীর এ ধরনের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
* ডায়াবেটিস থাকলে রক্তের গ্লুকোজ মেপে দেখতে হবে বারবার, যাতে এটি নিয়ন্ত্রণে থাকে। চিকিৎসার সর্বশেষ অগ্রগতি জানবেন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে। তারপর প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিন।
* যাদের কিডনির কাজকর্ম দুর্বল, তাদের রক্তচাপ থাকা দরকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এসিই ইনহিবিটার বা এআরবি হতে পারে অন্যতম ওষুধ। রক্তচাপ ১৩০/১৮০-এর নিচে অবশ্যই রাখতে হবে।
কিডনি যদি নিষ্ত্র্নিয় হয়ে যায়
কিডনি যদি পুরোপুরি নিষ্ত্র্নিয় হয়ে যায়, একে যদি খণ্ডন না করা যায় তাকে বলে এন্ড-স্টেজ রেনাল ডিজিজ (ইএসআরডি)। কিডনির কাজকর্ম যদি প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, শরীরে তখন জমবে বাড়তি পানি ও বর্জ্য। একে বলা হয় ‘ইউরিমিয়া’, বর্জ্য ইউরিয়া অনেক বেড়ে যাবে রক্তে। হাত-পা ফুলে যাবে। রক্ত দূষণমুক্ত হতে চায়; কিন্তু এ সময় তা পারে না। রোগীর শরীর-মন হয় দুর্বল, অবসন্ন। রক্তের ইউরিয়া মান খুব বেড়ে গেলে এর চিকিৎসা যদি না হয়, তাহলে সংজ্ঞা লোপ পাবে, মৃত্যুও হতে পারে। কিডনি নিষ্ত্র্নিয় হলে প্রয়োজন হয় ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপনের।
ডায়ালাইসিস
দুই ধরনের ডায়ালাইসিস আছে।
* হেমোডায়ালাইসিস
এ ধরনের ডায়ালাইসিসে রক্ত পাঠানো হয় এমন এক মেশিনের মধ্য দিয়ে, যা ছেঁকে নেয় বর্জø। পরিষ্কার রক্ত ফিরে আসে শরীরে। হেমোডায়ালাইসিস করা হয় ডায়ালাইসিস সেন্টারে সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন, তিন-চার ঘণ্টা করে।
* পেরিটনিয়াল ডায়ালাইসিস
উদরে পাঠানো হয় তরল পদার্থ। এই তরল পদার্থ হলো ‘ডায়ালাইসেট’, রক্ত থেকে ধরে আনে বর্জ্য পদার্থ। কয়েক ঘণ্টা পর শরীরের বর্জ্যপূর্ণ ডায়ালাইসেট নিষ্কাশিত হয়ে যায়। তখন ডায়ালাইসেটের একটি নতুন ব্যাগ উদরের ভেতরে স্থাপন করতে হবে। শিখে নিলে রোগী নিজেই পেরিটনিয়াল ডায়ালাইসিস (ঈঅচউ) ব্যবহার করতে পারেন। ডায়ালাইসেট দিনে বদলাতে হয় চারবার।
কিডনি প্রতিস্থাপন করা
দান করা কিডনি আসতে পারে বেনামি দাতার কাছ থেকে বা সম্প্রতি মৃত্যু হয়েছে এমন কারও কাছ থেকে। এমনকি জীবিত ব্যক্তি, কোনো আত্মীয়র কাছ থেকেও। যে কিডনি নেওয়া হবে তার গ্রহীতার শরীরে লাগসই হতে হবে।
নতুন দান করা কিডনিটি গ্রহীতার শরীরের সঙ্গে যত বেশি খাপ খেয়ে যাবে, শরীর থেকে তা প্রত্যাখ্যানের আশঙ্কা তত কমে যাবে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সামাল দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধও প্রয়োজন হতে পারে।
জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, ডায়ালাইসিস ইউনিট ও নেফ্রোলজি ইউনিট বারডেম, নেফ্রোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে কিডনির বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করা হয়।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৫, ২০০৮
Leave a Reply