শিশুদের সাধারণত দুই ধরনের কিডনির রোগ বেশি হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে নেফ্রোটিক সিনড্রোম ও অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস।
নেফ্রোটিক সিনড্রোম লক্ষণ
সাধারণত দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুর হয়ে থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। প্রথম দিকে দুই চোখের পাতা ফুলে যায় ও মুখে ফোলা ভাব দেখা যায়। পরে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে পেটে, হাতে ও পায়ে পানি জমে এবং সারা শরীর ফুলে যায়। শিশুর অণ্ডকোষে পানি জমতে পারে। এর সঙ্গে কখনো বা প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, রং সাধারণত স্বাভাবিক থাকে। শিশুর রক্তচাপ সচরাচর স্বাভাবিক থাকে। প্রস্রাব জ্বাল দিলে প্রোটিনের পুরু স্তর পাওয়া যায়।
রোগ নির্ণয়
* প্রস্রাবে খুব বেশি পরিমাণে প্রোটিন বেরিয়ে যায় (৪০ মিলিগ্রাম)। প্রতি স্কয়ার মিটার সারফেস এরিয়া বা প্রতি ঘণ্টায় প্রস্রাবের বেশি।
* রক্তে অ্যালবুমিনের নি্নমান, ২ গ্রামের কম।
* সিরাম লিপিডে উচ্চ মাত্রা, ২২০ গ্রামের বেশি।
* শিশুর সারা শরীর ফুলে যায়।
প্রথমত দুটি রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয়।
চিকিৎসা
* প্রথম অ্যাটাকে ও বিভিন্ন জটিলতাপূর্ণ নেফ্রোটিক সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করান।
* প্রথম দু-এক সপ্তাহ শিশুর পূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন। এতে কিডনিতে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। শিশু প্রোটিনসমৃদ্ধ স্বাভাবিক খাবার খাবে। তবে খাবারে অতিরিক্ত লবণ মেশাবেন না।
* এসাইটিস, বিভিন্ন ইনফেকশন ইত্যাদি জটিল বিষয়ে বিশেষ চিকিৎসা।
* সুনির্দিষ্ট ওষুধ-শিশুদের নেফ্রোটিক সিনড্রোমে স্টেরয়েড খুব কার্যকর ওষুধ, সঠিক ডোজ ও সিডিউল মেনে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী তা সেবন করান।
পরামর্শ
* আক্রান্ত শিশুর মা-বাবা, অভিভাবককে রোগের পুরো কার্যকারণ ও ভবিষ্যৎ ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।
* বাড়িতে প্রোটিন জ্বাল দেওয়া শেখাতে হবে।
* শিশুকে অপ্রয়োজনীয় বিধিনিষেধে রাখবেন না, স্বাভাবিক খাবার, খেলাধুলায় অংশ নেওয়ায় উৎসাহ দিন।
* শিশু বয়সের নেফ্রোটিক সিনড্রোম মূলত প্রাথমিক ধরনের। ফলে বড়দের তুলনায় বাচ্চাদের সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। ৯৩ শতাংশ শিশুর বারবার ফোলা দেখা দিলেও স্টেরয়েডের সঠিক চিকিৎসায় ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সে প্রায় ক্ষেত্রেই সুস্থ হয়ে ওঠে।
অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস
লক্ষণ
প্রধানত স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের মধ্যে এ রোগ হয়ে থাকে। শিশুর শরীরে খোসপাঁচড়া বা গলা ব্যথা অসুখের ১০ থেকে ২১ দিন পরে সাধারণভাবে এ রোগ প্রকাশ পায়। স্টেপটোকক্কাই নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এ জন্য দায়ী।
উপসর্গ
* হঠাৎ করে চোখ-মুখ, সারা শরীর ফুলে যেতে পারে।
* প্রস্রাব হয় বন্ধ কিংবা পরিমাণে খুব অল্প হতে পারে। বেশির ভাগ সময় প্রস্রাবের রং লাল থাকে।
* কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ থেকে ২১ দিন আগে গলা ব্যথা হয়ে থাকে। কখনো ত্বকে খোসপাঁচড়াজাতীয় চিহ্ন থাকে।
* শিশুর রক্তচাপ বেশি থাকতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
* প্রস্রাব পরীক্ষায় কিছুটা প্রোটিনের সঙ্গে আরবিসি কাস্ট পাওয়া যায়।
* কিডনির কার্যক্ষমতা বোঝার জন্য ব্লাড ইউরিয়া, সিরাম ক্রিয়েটিনিন মাত্রা দেখা যায়। সিরাম পটাশিয়ামের উচ্চমাত্রা ইসিজির সাহায্যেও বোঝা যেতে পারে।
চিকিৎসা
* প্রথম দু-এক সপ্তাহ শিশুকে বিশ্রামে রাখতে হবে। ছোটাছুটি করলে রক্তচাপ বৃদ্ধি ও হার্ট ফেইলিওর হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সামান্য ধরনের অসুখ বাড়িতে সামলানো গেলেও উচ্চ রক্তচাপ ও প্রস্রাব কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করাতে হবে।
* শিশুর খাবারে লবণ বাদ করতে হবে। পটাশিয়ামযুক্ত খাবার ও ওষুধ বাদ দিতে হবে। যেমন-ডাব, কলা, ফলের জুস ইত্যাদি। আমিষজাতীয় খাবার যেমন-ডিম, মাছ, মাংস সাময়িকভাবে খাওয়া বাদ দিতে হবে। তবে খাবারের মধ্যে আলু, ভাত, চিঁড়া, দুধভাত, মুড়ি, মাখন, পাউরুটি ও চিনি খেতে পারবে।
* প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কেবল ৪০০ মিলি বা সারফেস স্কয়ার মিটার বা প্রতিদিন এর সঙ্গে তার আগের দিনের প্রস্রাবের সমপরিমাণ যোগ করে মোট জলীয় পদার্থ শিশুকে পান করানো, এর বেশি নয়।
* শিশুকে বেনজামিন পেনিসিলিন এক ডোজ মাংসপেশিতে (শিশুর ওজন ২৭ কেজির নিচে হলে ছয় লাখ ইউনিট এবং তার বেশি হলে ১২ লাখ ইউনিট) দিতে হবে অথবা বিকল্প হিসেবে সাত থেকে ১০ দিনের জন্য পেনিসিলিন সিরাপ বা ট্যাবলেট ছয় ঘণ্টা অন্তর খাওয়ানো, যদি দেহে পাঁচড়া বা গলা সংক্রমণের অস্তিত্ব থাকে।
* শিশুর যদি স্ক্যাবিস থাকে, তার চিকিৎসা করান।
* উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ পটাশিয়াম মাত্রা, শ্বাসকষ্ট, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথাব্যথা, খিঁচুনি, বমি, খুব কম প্রস্রাব-এসব জটিলতায় দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পরামর্শ
* বাচ্চার খোসপাঁচড়া বা গলাব্যথা অসুখে সময়মতো চিকিৎসা করান।
* ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ অ্যাকিউট নেফ্রাইটিসের শিশু সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তবে সময় নষ্ট না করে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিন।
ডা· প্রণব কুমার চৌধুরী
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৫, ২০০৮
Leave a Reply