একবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছি। ট্রেনে বসে আছি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। এক ভদ্রলোক হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রেনে উঠলেন। তাঁর ভারী ব্যাগটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুললেন ট্রেনের তাকে রাখবেন বলে। হঠাৎ চিৎকার করে কোমরে দুই হাত চেপে বসে পড়লেন সিটে। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তাঁর কাছে গেলাম। জানতে চাইলাম, কোথায় ব্যথা হচ্ছে? তিনি বললেন, কোমরের নিচের দিকে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে, যা পা পর্যন্ত ছড়াচ্ছে আর ঝিনঝিন করছে। বুঝলাম, এটা স্লিপ ডিস্ক না হয়ে যায় না। ইতিমধ্যে ট্রেনও ছেড়ে দিয়েছে। অ্যাটেনডেন্ট ও গার্ডকে ডেকে বললাম, ট্রেন থামিয়ে দুটো ইনজেকশন আনার ব্যবস্থা করতে। তাঁরা পাহাড়তলী স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে ইনজেকশন দুটো আনিয়ে নিলে ভদ্রলোককে তা পুশ করে দিলাম।
আরও কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করে ঢাকায় গিয়ে কোমরের একটা এক্স-রে করার পরামর্শ দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগে দেখা করতে বললাম। বাসায় গিয়ে সপ্তাহ খানেক পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলে দিলাম। স্লিপ ডিস্ক হচ্ছে এমন একটা দুর্ঘটনা, যা হঠাৎ ভারী বস্তু অসাবধানে ওঠাতে গিয়ে যে কেউ যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন। আজকে স্লিপ ডিস্ক নিয়ে একটু দরকারি আলোচনা করব।
স্লিপ ডিস্ক কীভাবে বুঝবেন
ভারী জিনিস তোলার ইতিহাস থাকবে। এমনকি জোরে হাঁচি-কাশি দিলেও ডিস্ক প্রানাশের আশঙ্কা থাকবে।
কোমরে অসহ্য ব্যথা হবে, যা ঝিনঝিন করবে। হাঁটতে, দাঁড়িয়ে কাজ করতে মারাত্মক কষ্ট হবে।
ব্যথা এতই প্রবল হতে পারে যে রোগী বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যেতে পারেন। এমনকি শুয়ে পাশ ফিরতেও কষ্ট হবে।
ব্যথার কারণে রাতে ঘুমাতে পারবেন না।
কেন হয়?
মেরুদণ্ডের কশেরুকার অন্তর্বর্তী অংশে চাকতির মতো অংশ থাকে বলে ইন্টার ভার্টিব্রাল ডিস্ক। এই ডিস্কের আবার দুটি অংশ থাকে। বাইরে ইলাস্টিকের মতো অংশকে বলা হয় অ্যানুলাস ফাইব্রোসাস। ভেতরের জেলির মতো অংশকে বলে নিউক্লিয়াস পালপোসাস। যদি মেরুদণ্ডে খুব বেশি চাপ পড়ে, তবে ভেতরের জেলির মতো অংশটি বাইরের আবরণী ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। ফলে মেরুদণ্ডের স্নায়ুরজ্জুতে চাপ পড়ে। তাই প্রচণ্ড ব্যথা হয়। কোমরে এমআরআই করা হলে খুব স্পষ্টভাবে ছবিটা দেখা যায়।
চিকিৎসা
পূর্ণ বিশ্রাম। চলাফেরা করলেই ব্যথা বাড়বে। তাই কমপক্ষে সপ্তাহ খানেক বিশ্রামে থাকতে হবে।
ব্যথার ওষুধ বা পেইন কিলার।
কোমরের বিশেষ কিছু ব্যায়াম করলে কোনো উপকার পাওয়া যায়।
কোমরে বেল্ট বা স্পাইনাল ব্রেস দিতে হবে, যা খুব বেশি আঁটসাঁট করে বাঁধা যাবে না। মাঝেমধ্যে খুলে রাখবেন।
হিট থেরাপি খুব কাজ দেয়। যেমন, হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানির সেক, আন্ট্রমনিক থেরাপি, ইন্টারফেরেনশিয়ান থেরাপি, শর্ট ওয়েব ও মিডিয়াম ওয়েব ডায়াথার্মি ইত্যাদি নিলে আরাম লাগবে।
খুব বেশি তিংক প্রলাজম হলে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে।
ল্যামিনেকটমি বা ডিসকোটমি করলে এ ধরনের অস্ত্রোপচারে রোগী ভালো হয়ে উঠতে পারে।
যা করা বারণ
ঝুঁকে কোনো কাজ করা যাবে না।
মেঝেতে বসবেন না।
সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যাবে না।
পায়খানা নরম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রচুর পানি ও সবজি খাবেন। কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে ইসবগুলের ভুসির শরবত কিংবা ল্যাকটুলোজ জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন।
শক্ত চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা করে বসবেন।
ভারী জিনিস তোলা নিষেধ।
দৌড়ঝাঁপ করতে হয় এমন খেলা নিষেধ।
বেশি ব্যথা নিয়ে ব্যায়াম করতে যাবেন না।
এস এম নওশের
ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০১, ২০১০
Leave a Reply