প্রথম বিশ্ব এইডস দিবস শুরু হয়েছিল ১ ডিসেম্বর ১৯৮৮ সালে। উদ্দেশ্য ছিল অর্থ সংগ্রহ, সচেতনতা সৃষ্টি—এ ব্যাপারে যেসব কুসংস্কার মানুষের মনে রয়েছে একে দূর করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া ও শিক্ষাদান। সেই থেকে প্রতিবছর ১ ডিসেম্বর পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব এইডস দিবস। এবার ২০১০ সালে বিশ্ব এইডস দিবস পালনের থিম হলো: এইডস চিকিৎসা ও প্রতিরোধকে বিশ্বের সব মানুষের আওতার মধ্যে আনা এবং এই অধিকারকে মানব অধিকার হিসেবে মর্যাদা দেওয়া। এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া যে এইডস রোগের ভাইরাস ‘এইচআইভি’ এখনো রয়ে গেছে পৃথিবীতে এবং একে প্রতিরোধের জন্য অনেক কিছুই আমাদের করার রয়েছে।
ইউএন এইডসের অনুমান অনুযায়ী, এইচআইভি শরীরে ধারণ করে পৃথিবীতে রয়েছে তিন কোটি ৩৪ লাখ মানুষ, এদের মধ্যে ২১ লাখ হলো শিশু। এইচআইভিতে আক্রান্ত হয় যত লোক, তাদের অর্ধেকের বয়স ২৫-এর নিচে এবং এইডস রোগে যারা মারা যায় তাদের বয়স ৩৫-এর নিচে। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এইচআইভি ও এইডস নিয়ে যত লোক আছে তাদের এক বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ রয়েছে নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে।
যে বিষয়ের কথা বলছিলাম, বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ, চিকিৎসা, পরিচর্যাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে সবার কাছে এগুলো যাতে পৌঁছায়, সে লক্ষ্যে কাজ করবেন। ইতিমধ্যে এ ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হলেও একে বিশ্বজনীন আওতায় আনার জন্য আরও দায়বদ্ধতা ও উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। এইচআইভি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এইডসের পেছনে যে ভাইরাস—‘এইচআইভি’—প্রতিবছর, প্রতিদিন, প্রতি মাসে মানুষ এতে সংক্রমিত হচ্ছে। অনেকেই কিন্তু পায় না চিকিৎসা। অথচ একে চিকিৎসা করা যায়। যাদের বেশি দরকার তারা এর আওতায় নেই। এইচআইভি সংক্রমিত প্রত্যেকের চাই পরিচর্যা ও অবলম্বন।
কিন্তু তা তারা পাচ্ছে না। দরিদ্র দেশে এই সংকট প্রবল আকার ধারণ করেছে। এ জন্য এ ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে, যারা সংক্রমিত, তাদের জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ যেন বিশ্বজনীন হয়। এইআইভি সংক্রমণজাত দেহে প্রতিরোধক্ষমতার ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে নানা লক্ষণ, উপসর্গ, সংক্রমণ এমনকি ক্যানসারও প্রকাশ পায়, আমরা এখন একে বলি এইডস। এইচআইভি সংক্রমিত অনেকেই জানতে পারে না যে তাদের সংক্রমণ ঘটেছে। কারণ, অসুস্থ বোধ করে না রোগী প্রথম প্রথম। সংক্রমণের এক থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে ভাইরাসের অ্যান্টিবডির প্রকাশ ঘটে দেহে, এ সময় অনেকের গ্ল্যান্ড ফুলে যায়; জ্বর, র্যাশ, গিঁটেব্যথা হতে পারে।
সংক্রমণের জন্য উপসর্গ না হলেও, তখন থাকে অত্যন্ত সংক্রামক সে অবস্থা, সূচনার এই সময় ভাইরাস ছড়াতে পারে অন্য দেহে। তখন এইচআইভি অ্যান্টিবডির টেস্ট করে জানা যায় সংক্রমণ ঘটেছে কি না। এরপর ক্রমে ক্রমে ধ্বংস হতে থাকে দেহ প্রতিরোধব্যবস্থা। সংক্রমণের নানা ধাপকে সংজ্ঞায়িত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
প্রাথমিক এইচআইভি সংক্রমণ: উপসর্গহীন হতে পারে বা সামান্য উপসর্গ হতে পারে।
ক্লিনিক্যাল ধাপ ১: উপসর্গহীন বা লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
ক্লিনিক্যাল ধাপ ২: সামান্য ওজন হ্রাস, শ্বাসনলের ওপর অংশে সংক্রমণ।
ক্লিনিক্যাল ধাপ ৩: ক্রনিক ডায়রিয়া, অবিরাম জ্বর, মুখের ভেতর ছত্রাক সংক্রমণ, জীবাণু সংক্রমণ, যক্ষ্মা, মুখে সংক্রমণ। এই তৃতীয় ধাপে কেউ কেউ এইডস রোগের পর্যায়ে চলে আসে।
ক্লিনিক্যাল ধাপ ৪: এই ধাপে ২২টি সুবিধাবাদী সংক্রমণ বা এইচআইভি সম্পর্কিত ক্যানসার ঘটতে পারে। এই ধাপে সবাই এইডস রোগের পর্যায়ে পৌঁছায়।
এইচআইভি সংক্রমণের অত্যন্ত অগ্রসর (অ্যাডভান্সড) ধাপে উপনীত হলে এইডস রোগ হয়েছে ধরা যায়। সুবিধাবাদী সংক্রমণ ২০টি বা ক্যানসার এ ধাপে রোগীর শরীরে আবির্ভূত হয়। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এইডসের সংজ্ঞা দিয়েছে। প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে সিডি ৪ পজিটিভ টি সেল গণনা ২০০ বা এর কম হলে এইডস।
এইচআইভি প্রতিরোধ।
এইচআইভি পাওয়া যায় রক্ত, বীর্য ও জননাঙ্গরসের মতো দেহ-তরলে। কীভাবে ছড়ায়? অনিরাপদ শারীরিক মিলন, সংক্রমিত সুচ, সিরিঞ্জ ও অন্যান্য ধারালো যন্ত্র ব্যবহার, সংক্রমিত রক্তক্ষরণ, গর্ভাবস্থা, প্রসবের সময় সংক্রমিত মা থেকে নবজাতকে। তবে সাধারণ মেলামেশায় এই ভাইরাস ছড়ায় না। সামাজিক সম্মেলনে, শিক্ষায়তনে বা কর্মস্থলে সাধারণ মেলামেশায় ছড়ানোর কোনো আশঙ্কা নেই। করমর্দন করে, কোলাকুলি করে, টয়লেট ব্যবহার বা পানির পাত্র থেকে পানি পান করলে, কফ বা কাশি কোনো কিছু থেকেই সংক্রমণ ঘটে না। প্রতিকার করা যায় সহজেই।
কেবল বিবাহিত জীবনসঙ্গীর সঙ্গে মিলন, প্রয়োজনে শারীরিক মিলনের সময় প্রোটেকশন ব্যবহার। শুদ্ধ পবিত্র নির্মল জীবনযাপন এ দেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য হওয়ায় তুলনামূলকভাবে এ দেশে এই সংক্রমণ অন্যান্য দেশ থেকে অনেক কম। ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ যত দূর সম্ভব ব্যবহার না করা, ব্যবহার করতে হলে সব সময় নতুন ও ডিসপোজেবল সুচ, সিরিঞ্জ ব্যবহার করা। রক্তদান ও গ্রহণের সময় ডিসপোজেবল সুচ, সিরিঞ্জ ব্যবহার ও রক্তভরণের সময় স্ক্রিন করা রক্ত গ্রহণ নিশ্চিতকরণ।
শারীরিক মিলনের সময় প্রোটেকশন ব্যবহার করবেন, যথেষ্ট নিরাপদ থাকা সম্ভব। অপরিশোধিত যন্ত্রপাতি দিয়ে চামড়ায় উল্কি আঁকা বা রেজার দিয়ে দাড়ি কামানো ঝুঁকিপূর্ণ। একে পরিহার করা উচিত।
নতুন রেজার, ব্লেড ও উল্কির যন্ত্র ব্যবহার করা উচিত
এইচআইভি সংক্রমিত মা থেকে নবজাতকের মধ্যে সংক্রমণ ঘটতে পারে; গর্ভাবস্থায় প্রসবের সময় বা প্রসবের পর দুগ্ধ পানের সময়ও ঘটতে পারে।
এই সময় ঝুঁকি হ্রাস করা যায়—
এটি রেক্ট্রোভাইরাল ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা
সিজারিয়ান অপারেশন
দুগ্ধপান পরিহার। তবে নিরাপদ দুধ না পাওয়া গেলে ছয় মাস পর্যন্ত কেবল স্তন পান চলতে পারে।
স্বাস্থ্যপরিচর্যাকর্মী ও চিকিৎসকদের এই সংক্রমণ প্রতিরোধের বা এড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বিশ্বজনীন সুরক্ষা গাইডলাইন/স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য
ধারালো যন্ত্রপাতি সতর্ক হয়ে ধরা, নাড়াচাড়া করা এবং সেসব বর্জ্য সতর্কভাবে অপসারণ সব পদ্ধতির আগে ও পরে সাবানজল দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া। সুরক্ষা-আবরক যেমন গ্লাভস, গাউন, অ্যাপ্রোন, মাস্ক ও গগলস ব্যবহার। বিশেষ করে যখন রক্ত, দেহাঙ্গ ও রক্তজাত দ্রব্যের সরাসরি সংস্পর্শে আসা হয়। রক্ত ও রক্তজাত দ্রব্যের সংস্পর্শে আসা বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশন। সব সংক্রমিত যন্ত্রপাতির পরিশোধন। রক্ত, তরল মল ও অন্যান্য দেহতরলে সংক্রমিত শয্যা, বেডকভার, বালিশ, লেপ, চাদর যথাযথভাবে নড়াচড়া করা, সতর্কভাবে অপসারণ করা।
এইডস বিশ্বব্যাপী ঘাতক
১৯৮১ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে এর আবির্ভাব ঘোষণার পর থেকে প্রতিদিন এ রোগে সংক্রমিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ।
এ বছর জুলাই মাসে ভিয়েনায় ১৯৩টি দেশের ১৯ হাজার অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইতিবাচক অনেক কথা এসেছে। বিশ্বজুড়ে মহামারি সুস্থিত, ২০০২ সালে এইডসে মৃত্যু ২২ লাখ হলেও ২০০৮ সালে তা ২০ লাখে নেমে এসেছে। সংক্রমণের হার এখনো উঁচু, তবে অবনতির দিকে যাচ্ছে না। মৃত্যু কমেছে, তবে অনেক বেশি লোক এইচআইভি/এইডস নিয়ে বেঁচে থাকছে। এখন অনেক বেশি লোক অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপির আওতায় এসেছে। গত ১০ বছরে এ জন্য কমেছে এইডসে মৃত্যুর হার। তবে সন্তুষ্টির অবকাশ নেই। লড়াই থামেনি। এখনো প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে ২৭ লাখ মানুষ।
প্রতিরোধের উপায়গুলো থাকছেই, এ জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা ও সার্বিক চিকিৎসা। অনেকে এর আওতায় এলে প্রতিরোধ কার্যক্রম এক অর্থে বেশি শক্তিশালী হবে। এ জন্য বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাহলে দুঃখী পীড়িত দরিদ্র বিশ্বের মানুষ পাবে অগ্রাধিকার। চিকিৎসা বিশ্বের সব এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হলে এ মহামারি আমাদের পুরো নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল
সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০১, ২০১০
joynal
hotela aids as ta ki vabe janbo
Bangla Health
যারা প্রফেশনাল *যৌ*ন*কর্মী, তাদের উচিত ২ সপ্তাহ পরপর এটা পরীক্ষা করে দেখা। আমাদের দেশে খুব উঁচু লেভেল ছাড়া এমন ব্যবস্থা খুব একটা নেই।