১৪ নভেম্বর ছিল বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনার এখনই সময়, এই দিবসে এমন আহ্বান জানানো হয়।
২০০৯-১৩ সময়কালে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালনের থিম নির্বাচন করা হয়েছে ‘ডায়াবেটিস শিক্ষা ও প্রতিরোধ’। এই থিমকে অবলম্বন করে এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ‘আসুন, আমরা এখনই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করি।’
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ। যখন অগ্ন্যাশয় যথেষ্ট ইনসুলিন হরমোন উৎপাদন করতে পারে না অথবা ইনসুলিন তৈরি হলেও শরীর একে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না, তখনই ডায়াবেটিস হয়। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস পরিচর্যা, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা তদারক করে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন। এই সংস্থার সাম্প্রতিক অনুমান অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে রয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডায়াবেটিসের রোগী। আরও অনুমান, রোগীর হার এভাবে বাড়তে থাকলে আগামী ২০ বছরে রোগীর সংখ্যা ৫০০ মিলিয়নে পৌঁছাবে। প্রতিবছর আরও সাত মিলিয়ন রোগী যোগ হচ্ছে। আমাদের প্রধান খাদ্য হলো শর্করা। পরিপাক হয়ে ভেঙে তৈরি হয় গ্লুকোজ। গ্লুকোজ ভেঙে আমাদের দেয় কাজ করার শক্তি। গ্লুকোজ বয়ে চলে রক্তে, সেই গ্লুকোজ পেশি ও অন্যান্য টিস্যুতে ঢোকার জন্য প্রয়োজন হয় একটি হরমোনের। সেই হরমোন হলো ইনসুলিন। ইনসুলিন না থাকলে শরীর খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি আহরণ করতে পারে না।
পাকস্থলীর পেছনে রয়েছে বড় এক দেহযন্ত্র অগ্ন্যাশয়, অগ্ন্যাশয়ের বিটাকোষ থেকে নিঃসৃত হয় হরমোন ইনসুলিন। যখন ডায়াবেটিস হয়, তখন ইনসুলিন ক্ষরণ কম হতে পারে বা শরীর নিজস্ব ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহারে অক্ষম হতে পারে। ফলে ডায়াবেটিসের রোগী খাবারের গ্লুকোজের যথাযথ ব্যবহার করতে পারে না। তাই রক্তে বাড়তে থাকে গ্লুকোজের মান। উঁচুমান গ্লুকোজ রক্তে থাকলে পরিণামে নানা রকম জটিলতা হতে পারে।
এখনো পর্যন্ত ডায়াবেটিসের নিরাময় আবিষ্কৃত হয়নি। তবে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনলে, ব্যায়াম করলে, প্রয়োজনে ওষুধ খেলে, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে, ডায়াবেটিস নিয়েও পরিপূর্ণ জীবন যাপন করা যায়। তাই একে নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
টাইপ১ ডায়াবেটিস বা ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিস। অজ্ঞাত কারণে দেহের প্রতিরোধব্যবস্থা নিজস্ব দেহকোষের বিরোধী হয়ে ওঠে, একে বলে অটো ইমিউন প্রতিক্রিয়া। দেহের প্রতিরোধব্যবস্থা আক্রমণ করে ইনসুলিন ক্ষরণকারী কোষগুলোকে। এদের শরীরে ইনসুলিন হরমোন থাকে না বললেই চলে। শিশুদের ও তরুণদের বেশি হয়, তবে এখন বড়দেরও হচ্ছে।
টাইপ২ ডায়াবেটিস ইনসুলিন-নির্ভর নয়। একে বয়স্কদের ডায়াবেটিসও বলা হতো একসময়। এঁদের সাধারণত ইনসুলিন ইনজেকশন লাগে না। যথাযথ খাদ্য গ্রহণ করে, নিয়মিত ব্যায়াম করে, মুখে খাওয়ার ওষুধ খেয়ে এবং কখনো কখনো ইনসুলিন নিয়ে রোগীরা রক্তের গ্লুকোজের মান নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
যাঁদের বয়স ৪৫-এর বেশি, যাঁরা স্থূল, এঁদের বেশি হয় এ ধরনের ডায়াবেটিস। টাইপ২ ডায়াবেটিসের সঙ্গে জিনগত সম্পর্কও থাকে। তবে স্থূলতা, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও ব্যায়ামের অভাব বাড়ায় এর ঝুঁকি।
কোনো কোনো নারীর গর্ভকালে এক ধরনের ডায়াবেটিস হয়—গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দুই থেকে পাঁচ শতাংশ। গর্ভকালে এর উদ্ভব হলেও প্রসবের পর এ সমস্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর থাকে না। তবে এদের পরবর্তীকালে টাইপ২ ডায়াবেটিসের আশঙ্কা বাড়ে।
কাদের হয় ডায়াবেটিস?
যে কেউ, যেকোনো স্থানে, যেকোনো বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। এর স্থান-কাল-পাত্র নেই।
অনেকে লবণ উপসর্গ হওয়ার আগেই এ রোগ শরীরে ধারণ করে এবং দুর্ভাগ্যবশত দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, স্নায়ুক্ষতি, হার্টের রোগ, স্ট্রোক—এমন সব জটিলতা নিয়ে হাজির হলে তখন নির্ণীত হয় ডায়াবেটিস।
তাই ডায়াবেটিস আগাম চিহ্নিত করা মানে এর চিকিৎসা করা যায় এবং জটিলতা এড়ানো যায়।
একজন সুস্থ লোকের রক্তে গ্লুকোজের মান ৭০ থেকে ১১০ মিলিগ্রাম বা ডেসিলিটার বা ৩.৯ থেকে ৬.০ মিলিমোল বা লিটার। রক্তে গ্লুকোজের মান যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, তবে ডায়াবেটিস হওয়ার মতে মানে থাকে না। একে বলে ‘শরীরে গ্লুকোজ সহনীয়তা ঠিক নেই।’ আজকাল একে বলা হচ্ছে প্রি-ডায়াবেটিস। এ পর্যায়ে জীবনচর্চা পরিবর্তন করলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে অনেকটাই।
গর্ভকালে ডায়াবেটিস
কিছু মহিলা গর্ভকালে সাময়িকভাবে ডায়াবেটিসের শিকার হন—একে বলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। দুই থেকে পাঁচ শতাংশ গর্ভাবস্থায় এমন ধরনের ডায়াবেটিস হতে পারে। তবে প্রসবের শেষে আর থাকে না। তবে যেসব মহিলার গর্ভকালে ডায়াবেটিস হয় বা যাঁদের নবজাত শিশুর ওজন চার কেজির বেশি হয়, তাঁদের পরে টাইপ২ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি।
ডায়াবেটিসের কী কী সতর্কসংকেত থাকতে পারে?
নানা রকমের সতর্কসংকেত, কখনো অস্পষ্ট সংকেত, কখনো বা বেশ স্পষ্ট সংকেত জানান দিয়ে যায়। টাইপ১ ডায়াবেটিস: টাইপ১ ডায়াবেটিসের আবির্ভাব হয় হঠাৎ, নাটকীয়ভাবে, এসব উপসর্গ নিচে:
অস্বাভাবিক তৃষ্ণা এবং শুকনো মুখ
বারবার প্রস্রাব
প্রচণ্ড ক্লান্তি বা শরীরে বলশক্তির অভাব
হঠাৎ ওজন হ্রাস
ঘা না শুকানো
বারবার সংক্রমণ
ঝাপসা দৃষ্টি
কী কী জটিলতা হতে পারে এ রোগের?
ডায়াবেটিস হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী জীবনভর রোগ। এর জন্য প্রয়োজন সতর্ক নিয়ন্ত্রণ। যথাযথ ব্যবস্থাপনা না নিলে এ থেকে হতে পারে নানা রকম জটিলতা, যেমন হূদরোগ, কিডনি বিকল হওয়া, অন্ধত্ব ও স্নায়ুর ক্ষতি।
স্বল্পমেয়াদি জটিলতা
রক্তে সুগারের মানস্বল্পতা বা হাইপো গ্লাইসেমিয়া, সংক্ষেপে ‘হাইপো’। যে রোগীরা ইনসুলিন ইনজেকশন নেন, তাঁদের কোনো সময় এমন সমস্যা হতে পারে—হয়তো কখনো ইনসুলিনের মাত্রা ভুলক্রমে বেশি হয়ে যায়, অতিরিক্ত ব্যায়াম করে ফেলেন বা স্বল্পাহার করেন। কিছু চিনি খেলে সমস্যা কেটে যায়। কেটে না গেলে সংজ্ঞালোপ পেতে পারে রোগীর।
জীবাণু বা ছত্রাক সংক্রমণ
ডায়াবেটিসের রোগীদের ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক সংক্রমণের প্রবণতা থাকে বেশি। শরীরে পুঁজের ফোসকা, বিষস্ফোটক বা চোখে হতে পারে অঞ্জনি। ছত্রাক সংক্রমণের মধ্যে এথলিটস ফুট, রিংওয়ার্ম ও জননাঙ্গদেশে ছত্রাক সংক্রমণ।
দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা
চোখের রোগ (রেটিনোপ্যাথি): শিল্পোন্নত দেশগুলোতে চোখের রোগ রেটিনোপ্যাথি হলো পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে অন্ধত্ব ও দৃষ্টিক্ষমতা হ্রাসের প্রধান কারণ। কিডনি রোগের (নেফ্রোপ্যাথি) বড় কারণ হলো ডায়াবেটিস।। স্নায়ুরোগ (নিউরোপ্যাথি) প্রায় অর্ধেক ডায়াবেটিসের রোগীর হতে পারে স্নায়ুরোগ। পায়ে চেতনা লোপ, পায়ে-হাতে ঝিন ঝিন, ব্যথা, দেহযন্ত্রের কার্যকলাপে সমস্যা, হূদযন্ত্র, চোখ, পাকস্থলী, মূত্রাশয় এমনকি শিশ্নদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পায়ে চেতনা না থাকলে রোগী অজান্তে ক্ষত-বিক্ষত বা আহত করতে পারে পাকে। এই ক্ষত হতে পারে এত ভয়ানক যে অঙ্গচ্ছেদ প্রয়োজন হতে পারে। হূদযন্ত্র ও রক্তনালি রোগ অন্যান্য দেশের তুলনায় ডায়াবেটিসের রোগীদের হূদরোগের ঝুঁকি দুই থেকে চার গুণ বেশি। রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখলে ওপরের সব জটিলতা এড়ানো যায়।
কীভাবেই বা একে প্রতিরোধ করা যায়?
ডায়াবেটিসের ঝুঁকিগুলো এবং লক্ষণ-উপসর্গ সম্পর্কে জনসচেতনতা ও পেশাজীবীদের সচেতনতা সৃষ্টি করা হলো একে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রাথমিক প্রতিরোধ
সেকেন্ডারি প্রতিরোধ
প্রাথমিক প্রতিরোধ: ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—এমন ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও এদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। এতে ডায়াবেটিস পরিচর্যা ও জটিলতার চিকিৎসার ওপর চাপ অনেক কমবে।
টাইপ২ ডায়াবেটিসের প্রতিরোধই বেশি প্রযোজ্য।
এ জন্য প্রয়োজন জীবনযাপনে পরিবর্তন। ওজন বেশি থাকলে কমানো ও শরীরচর্চা করা। হূদরোগ ও উচ্চরক্তচাপের রোগীরাও এর সুফল পায়।
সেকেন্ডারি প্রতিরোধ: ডায়াবেটিসের জটিলতা আগেভাগে চিহ্নিত করা এবং প্রতিরোধ করা, এতে চিকিৎসার চাহিদা কমে।
জীবনের মান বিবেচনায় ডায়াবেটিসের প্রথম পর্যায়ে পদক্ষেপ নিলে বেশি সুফল লাভ হয় আর এটি সাশ্রয়ীও বটে।
উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষিত
ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস মহামারির মূল ভার বইতে হবে উন্নয়নশীল বিশ্বকে। তাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষভাবে জরুরি। বাংলাদেশে চিত্রটি একটু ভিন্ন। সৌভাগ্যবশত জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত মো. ইব্রাহিমের আজন্ম লালিত স্বপ্নের ফসল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বারডেম এ দেশের অসংখ্য ডায়াবেটিসের রোগীর পরিচর্যা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এই বৃহৎ ডায়াবেটিক কেন্দ্রটি ক্রমে সেবার পরিধি সম্প্রসারণ করছে, ডায়াবেটিস পরিচর্যা, চিকিৎসা, রোগনির্ণয়, পুষ্টিজ্ঞান, পরামর্শ, রোগীর কল্যাণ, তরুণ ডায়াবেটিক কেয়ার পুনর্বাসন ও পদ পরিচর্যা—সব নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। শেষ পাওয়া তথ্যমতে, এ দেশে এখন রয়েছে ছয় মিলিয়ন ডায়াবেটিসের রোগী। তবে প্রতিষ্ঠানটি দেশের মাত্র ২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে সেবার আওতায় এনেছে। হাসপাতাল ও রোগনির্ণয়-ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটছে, ক্রমেই সব ধরনের জটিলতা চিকিৎসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
রোগীর ক্রমবর্ধমান চাপ এবং বিনা খরচ ও কম মূল্যের সেবা বাড়াতে প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয়ভার বহনের অবলম্বন জরুরি হয়ে পড়েছে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল
সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৪, ২০১০
Leave a Reply