এ দেশে মানুষের নানা ধর্মানুষ্ঠান পরিণত হয় উৎসবে। ধর্ম-নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করে এ উৎসব। এভাবে তা হয়ে ওঠে প্রাণের উৎসব। শহর থেকে দলে দলে মানুষ যায় গ্রামে, পরিবারের অন্যদের সঙ্গে মেলার জন্য। সবাই একত্রে শামিল হয় উৎসবে। প্রিয়জনকে দেওয়ার জন্য কেনা হয় নতুন পোশাকসহ নানা উপহার। উৎসবের একটি মূল অংশ হলো ভোজ—খাওয়ার আতিশয্যকেও মানুষ প্রশ্রয় দেয় তখন। এত আনন্দ ও উল্লাসের মধ্যে অতিভোজন হয়ে যায় অনেকের, মিষ্টি-মণ্ডা ও চর্বি থেকে এসবের বাহুল্য ঘটে দিন-রাতের ভোজে। এতে শরীরের ওজন বাড়ে। সামনে কোরবানির ঈদ, গোশত খেতে হয়। উৎসবে রয়েসয়ে খেলে বাঁচে শরীর। অন্তত যাদের ডায়াবেটিস, হূদরোগ ও কিডনির রোগ আছে, তারা তো বিশেষ সাবধান হবেই। উৎসবের ছোঁয়া লাগানোর জন্য সামান্য খাবার খাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু বেশি হলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়বেই তো। যাদের এমন অসুখ, তারা তো বিশেষ সাবধান হবেই, তবে সাধারণভাবে শরীর যাতে ভালো থাকে উৎসবের দিনে, সে জন্যও আছে পরামর্শ।
ভোজে যাওয়ার আগে বাড়িতে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস খেয়ে তবে বের হবে। পেটে ক্ষুধা থাকলে বেশি বেশি খাওয়ার আগ্রহ বাড়ে। স্বাস্থ্যকর নয়—এমন সব খাবার প্রশ্রয় দেওয়ার মনের ইচ্ছা তুঙ্গে ওঠে।
সুবুদ্ধিসম্পন্ন আহারকে কী বলব? sensible eating? সংগত আহার, ভোজন? গোশতের রেজালা, ভুনা, পোলাও সামনে আছে, সে সঙ্গে সালাদ ও বোরহানিও আছে। সালাদ, স্যুপ ও বোরহানি বেশি করে খেয়ে দু-একটা টুকরা গোশত, সামান্য পোলাও—তাই তো ভালো। নিয়ম রক্ষা হলো, মান বাঁচল, স্বাস্থ্যও বাঁচল।
আর একটি কথা, উৎসবের দিনগুলোতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ব্যায়াম কিন্তু চালিয়ে যেতেই হবে। বাড়তি ক্যালোরি কিছু হলেও ঝরে পড়ার সুযোগ পাবে।
ভোজে যাওয়ার আগে ফলাহার করে, এক মুঠ বাদাম খেয়ে বেরোলে তেমন অতিভোজন করতেই পারবেন না ভোজের টেবিলে। ব্যায়ামের কর্মসূচিতে বিরতি টানা একেবারেই অনুচিত হবে। নিয়মিত ব্যায়াম, এমনকি ভ্রমণের সময়ও শরীরচর্চা চলবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে। ভোজের সময় হাতের কাছে পানির বোতল থাকতেই হবে।
শরবত, কোমল পানীয়, ড্রিংকস—এসব বর্জন করলে ভালো। এতে অনাবশ্যক ক্যালোরি যোগ হবে শরীরে।
শুনতে কেমন লাগবে জানি না, তবু বলি, মিষ্টি আর চকলেটের প্যাকেট উপহার না দিয়ে ফল ও বাদামের প্যাকেট উপহার দিলে বেশ স্বাস্থ্যকর হয় কিন্তু। এমন চর্চা শুরু করতে পারেন না কেউ?
স্বাস্থ্যকর আহারের চর্চা উৎসাহিত করা উচিত এবং কেবল রোগীকে দেখার সময় ফল হাতে গিয়ে না; উৎসবে, অনুষ্ঠানে গেলেও তো হয়, না? একটি কাজ করলে কেমন হয়? নিজের বাড়িতে ভোজের আয়োজন করে নেমন্তন্ন করুন বন্ধু-স্বজনদের। তাদের ক্যালোরিসমৃদ্ধ খাবার পরিবেশন না করে স্বাস্থ্যকর খাবার দিলে খুবই ভালো হবে। অন্যদের জন্য এটি একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে, ক্যালোরিঘন নয় এমন সব খাবারের নতুন নতুন রেসিপি বানানোর চেষ্টাও করতে হবে।
ভোজ ও অতিভোজন—এমন কালচার তো চলে আসছে। ‘সে ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’— তবে থাক না ট্র্যাডিশন, সুমিত আহার করলেই হলো। ঐতিহ্য রাখা ভালো, এতে মূল্যবোধ ঠিক থাকে সমাজে।
ভোজে যোগদান করলে, খাবারের টেবিলে গেলে খাওয়াতে বিরতি দিতে হবে—গোশত, চর্বি, ঘি ও ভাত কম খেতে হবে। এমন যদি কেউ থাকেন আর তিনি যদি বিবাহিত হন, তাহলে জীবনসঙ্গী সাহায্য করতে পারেন। কী দেখলে লোভ উথলে ওঠে তা তিনি জানবেন, এবং ধরুন, জামার বোতাম টেনে ধরে বা খোঁচা মেরে নিবৃত্ত করতে পারেন। তখন খাওয়া বন্ধ হবে।
আবার এমনও হয়, ভোজে গেছেন শ্বশুরবাড়ি, জামাই বলে কথা! খেতে হবেই তো যা দেবে সব। গলা পর্যন্ত। সে সময় কোনো বন্ধুকে যদি আগে জানান দেওয়া যায় সে তাকে নিয়ে ছলছুঁতো করে এড়াতে পারে অতিভোজন।
উৎসবে-অনুষ্ঠানে যেসব খাবার দেওয়া হয় এর কয়েকটির মধ্যে লুকিয়ে আছে যে পরিমাণ ক্যালোরি তেমন উদাহরণ দিই?
এক কাপ চা, দুই চা-চামচ ঘন দুধ ও দুই চা-চামচ চিনি, ব্যস, ৭০ ক্যালোরি পান করা হয়ে গেল। কোমলপানীয় (৩৫০ মিলিলিটার—১৪৫ ক্যালোরি। টমেটো জুস (১০০ মিলি) ৪০ ক্যালোরি, কমলা জুস (১০০ মিলি)—৬১ ক্যালোরি।
একটি বড় সামেসা ২১০ ক্যালোরি। আইসক্রিম (১০০ গ্রাম ছোট কাপ)—২০০ ক্যালোরি। গোলাপ জাম (দুটো ছোট)—২৮০ ক্যালোরি। দুটি রসগোল্লা—১১০ ক্যালোরি, একটি পরোটা—১৮০ ক্যালোরি। কাবাব চারটি—৩০৮ ক্যালোরি।
বিরিয়ানি, গোশত এসবের ক্যালোরি আর গুনে দেখালাম না। অনেক যে হবে তা বোধগম্য। তাই বলছিলাম, রয়েসয়ে খেলে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করা যাবে।
যা হোক, উৎসব হবেই, ভোজও হবে। ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান এসব ছিল, থাকবেও। প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানো, সবার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আনন্দ, স্মৃতি, উপহার দেওয়া-নেওয়া, মানুষের আত্মিক এই উৎসব, প্রাণের এই উৎসব এই সময়টাকে জাদুর ছোঁয়ায় ভরে দেয়!
তাই ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং অতিভোজন সংবরণ করা। স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হওয়া হবে মুখ্য, খাদ্য সেখানে হবে গৌণ।
নিজে খেতে বসলেই যে সব খেতে হবে তা নয়। আইসক্রিম, কোক, চর্বি এড়ানো ভালো। বিরিয়ানি, রেজালা খেলেও, কম খেতে হবে। এক দিন বেশি খাওয়া হলে পরপর তিন দিন স্লিম আহার করার সংকল্প নিতে হবে।
অনেকে ভোজের সময় বেশি খাওয়ার জন্য আগের বেলা না খেয়ে থাকেন। এটা কিন্তু ঠিক নয়। কোনো বেলার খাবার বাদ দিলে হিতের চেয়ে বিপরীত হবে। এতে ভোজের সময় প্রচুর খাওয়া হবে। হালকা প্রাতরাশ, স্ন্যাকস চলুক।
খেতে হবে সচেতনভাবে, কেবল ক্ষুধা পেলেই খেতে হয়। মন খারাপ হলে বেশি খাওয়া হয়। প্লেটে থাকুক সবজি-সালাদ, ফলের টুকরো ও দধি। অল্প গোশত বিরিয়ানি হবে। এভাবেই চলবে উৎসব। সগৌরবে। স্বাস্থ্যও থাকবে ভালো।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১০, ২০১০
Leave a Reply