মেডিকেল কলেজের সার্জারি ইউনিটগুলোর অপারেশনের সাপ্তাহিক নির্দিষ্ট দিন থাকে। রোগীর অপারেশনের পূর্বশর্ত হলো অ্যানেসথেসিয়া নিশ্চিতকরণ। সাধারণত অপারেশনের আগের দিন ওয়ার্ডের নার্স রোগীদের একত্র করে অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে পাঠান। বড় হাসপাতালে তা একটা ছোটখাটো মিছিল।
রোগীরা তাঁদের সব কাগজপত্র, এক্স-রে, ইসিজি অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ ওয়ার্ডের রোগীরা প্রস্রাবের ক্যাথেটারসহ দুরু দুরু বুকে অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে হাজির হন। সঙ্গে আসেন আত্মীয়স্বজন। তাঁরা জানেন, এই বাধা অতিক্রম করলেই তাঁদের অপারেশন নিশ্চিত হবে এবং তাঁরা আরোগ্য লাভ করে বাড়ি ফিরে যাবেন। অ্যানেসথেটিস্ট তাঁকে দেখেশুনে ‘ফিট ফর অ্যানেসথেসিয়া’ অর্থাৎ অ্যানেসথেসিয়ার বিশেষ ঝুঁকি নেই—এই ছাড়পত্র দিয়ে দেবেন।
বিদেশে অ্যানেসথেটিস্টরা রোগীর বিছানায় গিয়ে তাঁর অবস্থা পর্যালোচনা করেন। আমাদের দেশে লোকবলের অভাবে বড় হাসপাতালে তা করা সম্ভব হয় না। তবে দেশের বেসরকারি হাসপাতালে তা সম্ভব।
প্রাক-অ্যানেসথেসিয়া পরীক্ষার প্রয়োজন কী
অ্যানেসথেসিয়া এক বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এই অ্যানেসথেসিয়া প্রক্রিয়ার কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়াও দেখা যায় কখনো কখনো। প্রক্রিয়াটি এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে প্রয়োগকারীকে অবশ্যই এমবিবিএস ডিগ্রিধারী হতে হবে এবং অ্যানেসথেসিয়ায় হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। পাশ্চাত্যে এর সময়সীমা চার-পাঁচ বছর। আমাদের দেশে বিশেষ ক্ষেত্রে ছয় মাস পরই মাঠে ঠেলে দেওয়া হয় লোকবলের অভাবে এবং প্রয়োজনের তাগিদে। তাঁরাই অপারেশনের আগে রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে প্রস্তুত করে দেন।
ওষুধ প্রয়োগে রোগী সম্পূর্ণ অচেতন অথবা আংশিক অসাড় হয়। এ অবস্থায় তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ সম্পূর্ণভাবে অ্যানেসথেটিস্টের ওপর নির্ভরশীল। অচেতনের ওষুধগুলো মূলত ‘বিষ’। স্বল্প মাত্রা বা আধিক্যে চিরস্থায়ী চেতনা বিলোপের আশঙ্কাও থাকে কখনো কখনো। দুর্ঘটনাও ঘটে। মাঝেমধ্যেই এ ধরনের সংবাদ কাগজে আসে।
কোন রোগীর কী ধরনের অ্যানেসথেসিয়া যুক্তিসংগত এবং চেতনানাশক ওষুধ কার কতটা সহ্য হবে, তা নিরূপণ করাই প্রাক-অ্যানেসথেসিয়া পরীক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য। রোগীর শারীরিক অবস্থা নিরূপণ প্রাক-পরীক্ষার প্রধান কাজ। অপারেশন যে কারণে হবে, তা ছাড়া রোগীর আরও কোনো রোগ আছে কি না, তা খুঁজে দেখতে হয়। সে কারণেই প্রাক-পরীক্ষা ছাড়া অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
কীভাবে পরীক্ষা করা হয়
চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যান্য বিভাগের মতো এখানেও শারীরিক পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি পরীক্ষার দ্বারা রোগীর অবস্থা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ প্রথম কাজ শারীরিক পরীক্ষা করা। এর মধ্যে আছে রোগীর পালস, রক্তচাপ, হূৎপিণ্ডের শব্দ, ফুসফুসে বাতাস আদান-প্রদানের শব্দ, মুখ হাঁ করার ক্ষমতা ইত্যাদি।
এর মাধ্যমে কোনো ত্রুটি পাওয়া গেলে অথবা রোগীর কোনো উপসর্গ থাকলে সে অনুযায়ী রক্তের পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে, ইসিজি ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে।
শারীরিক পরীক্ষায় কোনো ত্রুটি না পাওয়া গেলে অথবা রোগীর কোনো উপসর্গ না থাকলে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত এক ‘রক্তের শর্করা’ ছাড়া আর কোনো ল্যাবরেটরি পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না।
গড়পড়তা পরীক্ষায় রোগীর বিড়ম্বনা ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয় না। আমেরিকার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপসর্গ ছাড়া গড়পড়তা বুকের এক্স-রে করে হাজারে একজন রোগীর কিছু মামুলি দোষ পাওয়া যায়, যা অ্যানেসথেসিয়ার কোনো অন্তরায় নয়।
হার্টের পরীক্ষার এক বহুল প্রচলিত পরীক্ষা ইসিজি। বস্তুত উপসর্গ ব্যতীত ৪৫ বছরের নিচে বয়সের ইসিজিতে পালসের গতি আর তাল ছাড়া অন্য কোনো খবর পাওয়ার কথা নয়, যা মন দিয়ে পালস দেখলেই বোঝা সম্ভব। তবে যাঁদের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বুকে ব্যথার উপসর্গ আছে, তাঁদের ইসিজি অনেক নতুন তথ্য দিতে পারে। তেমনি যাঁদের শ্বাসকষ্ট, পুরোনো কাশি আছে, তাঁদের বুকের এক্স-রে যুক্তিসংগত।
পাশ্চাত্যে অপ্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি পরীক্ষার বিপক্ষে জোর মত উঠেছে।
প্রাক-অ্যানেসথেসিয়া পরীক্ষায় কোনো রোগ ধরা পড়লে রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তুলে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া নিরাপদ।
বর্তমান অ্যানেসথেসিয়ার সুযোগ-সুবিধায় যেকোনো অবস্থায় সার্জারির প্রয়োজনে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ সম্ভব। তাতে প্রাক-অ্যানেসথেসিয়া পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে হবে, রোগীর অবস্থা কী এবং সে মোতাবেক অ্যানেসথেসিয়া দিতে হবে।
প্রাক-অ্যানেসথেসিয়া পরীক্ষার সময় অ্যানেসথেটিস্টের অপর অন্যতম কাজ হলো রোগীর অপারেশন-সংক্রান্ত ভীতি দূর করা। অপারেশনের সময় কীভাবে তাঁকে বেদনাবিহীন এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ রাখা হবে, সে সম্পর্কে অবহিত করা। রোগীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং মোটামুটিভাবে তাঁর উৎকণ্ঠার পরিসমাপ্তি ঘটানো।
পরিশেষ
প্রাক-অ্যানেসথেসিয়ার পরীক্ষা ছাড়া অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া কর্তব্যে অবহেলা ও ঝুঁকিপূর্ণ। জরুরি ক্ষেত্রে অপারেশনের টেবিলেই প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা করা যেতে পারে।
রোগীর শারীরিক পরীক্ষা ব্যতিরেকে গড়পড়তা ল্যাবরেটরি পরীক্ষা রোগীর জন্য অহেতুক বিড়ম্বনা ও অর্থের অপচয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অনৈতিক কমিশন-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি।
খলিলুর রহমান
সাম্মানিক সিনিয়র কনসালট্যান্ট, অ্যানেসথেসিয়া
বারডেম হাসপাতাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৩, ২০১০
Leave a Reply