বেশ কিছুদিন ধরেই মানুষ পশুবাহিত রোগের শিকার হচ্ছে—এভিয়ান ফ্লু, সোয়াইন ফ্লুর পর সম্প্রতি অ্যানথ্রাক্স দেখা দিয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যেসব রোগ অন্য পশু-প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় সেসব রোগকে পশুবাহিত রোগ বা জুনুটিক (Zoonotic) রোগ বলে। অ্যানথ্রাক্স তেমনই একটি প্রাণীবাহিত রোগ, যা মানুষকে আক্রান্ত করে।
অ্যানথ্রাক্স কী
অ্যানথ্রাক্স মূলত তৃণভোজী পশুর রোগ। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়া দিয়ে এটি হয়। এই ব্যাকটেরিয়াটি স্পোর বা শক্ত আবরণী তৈরি করে অনেক দিন পর্যন্ত মাটিতে বেঁচে থাকতে পারে। ঘাস খাওয়ার সময় গবাদিপশু এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত গবাদিপশুর সংস্পর্শে এলেই কেবল মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। অসুস্থ গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদির সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়।
অ্যানথ্রাক্স: মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না
এই ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর সুপ্তিকাল বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড দুই থেকে সাত দিন। এটি পশু থেকে মানুষে ছড়ায়; কিন্তু মানুষ থেকে মানুষে সরাসরি ছড়ায় না। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে একজন মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে এলে অন্য আরেকজন মানুষ আক্রান্ত হবে না। তিন ধরনের অ্যানথ্রাক্স মানুষের মধ্যে হয়। ত্বকে, পরিপাকতন্ত্রে এবং ফুসফুসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটি হয় সেটি হচ্ছে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। শতকরা ৯৫ ভাগ। অন্য দুটিতে রোগতাত্ত্বিকভাবে খুব কম মানুষই আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব হরহামেশা দেখা গেলেও বাংলাদেশে এই রোগটি নিয়ে এত দিন কোনো তথ্য-উপাত্ত ছিল না বললেই চলে। যেহেতু এটি পশু রোগ, তাই পশুসম্পদ অধিদপ্তরই বেশির ভাগ সময় পশুর টিকা-সংক্রান্ত কার্যাবলি সম্পন্ন করেছে এবং এখনো করছে। ২০০৯ সাল থেকে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট—আইইডিসিআর পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে মানুষের ত্বকের অ্যানথ্রাক্সের ১৪টি রোগ-প্রাদুর্ভাবের তত্ত্ব-তালাশ করেছে। এ বছরও সম্প্রতি এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে এবং মিডিয়ার কল্যাণে বেশ হইচই হচ্ছে। আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী ১৮ আগস্ট থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ পর্যন্ত দেশের ১০টি জেলার ১৭টি উপজেলায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে, যাতে প্রায় ৫২০ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন এবং চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ আছেন সবাই। স্থানীয়ভাবে অ্যানথ্রাক্স পশুর ‘তড়কা’ রোগ নামে পরিচিত।
রোগের লক্ষণ
আগেই বলেছি, এ রোগটি মূলত ত্বকের। ত্বকে ঘার মতো হয়। প্রথমে চামড়ায় ফোসকা পড়ার মতো শুরু হয়—ধীরে ধীরে ঘা হয়ে যায়। গোলাকার ঘার মাঝখানে কালচে হয় আর চারদিকের চামড়া লালচে হয়ে পানির ফুসকুরি জমে। রোগীর ইতিহাস নিলে দেখা যাবে, তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি গবাদিপশুর সংস্পর্শে এসেছিলেন।
চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়
এই রোগের কারণে জীবনহানি ঘটে না। সময়মতো ও সঠিকভাবে চিকিৎসা নিলে রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আটলান্টার রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের গাইড লাইন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসায় রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। সিপ্রোফ্লোক্সাসিন অথবা ডক্সিসাইক্লিন অথবা পেনিসিলিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
প্রতিরোধ
অ্যানথ্রাক্সের প্রতিরোধ নির্ভর করে গবাদিপশুর রোগ নিয়ন্ত্রণের ওপর। যেসব এলাকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, সেসব এলাকায় সব গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্সের টিকা দিতে হবে—যাতে নতুন করে গবাদিপশু আক্রান্ত না হয়।
আর আক্রান্ত গবাদিপশুরও চিকিৎসা করতে হবে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গবাদিপশু অল্প সময়েই মারা যায়।
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত কোনো গবাদিপশু মারা গেলে সেটি চামড়াসহ মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে।
মৃত গবাদিপশু এমনভাবে পুঁততে হবে, যাতে শেয়াল বা অন্য কোনো পশুপাখি মাটি খুঁড়ে এর নাগাল না পায়।
গবাদিপশু পালন
গবাদিপশুতে রোগের লক্ষণ দেখা দিলে নিকটস্থ প্রাণিসম্পদ অফিস বা পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার এলাকায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকলে গবাদিপশুর টিকার ব্যবস্থা করুন। সরকারিভাবে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে।
খালি হাতে অসুস্থ ও মৃত গবাদিপশু ধরবেন না, দুই হাতে গ্লাভস বা মোটা পলিথিনের আবরণ ব্যবহার করুন।
এই রোগে আক্রান্ত গবাদিপশু জবাই করবেন না। মনে রাখবেন, আক্রান্ত পশু থেকেই এই রোগটি মানুষের মধ্যে ছড়ায়। অসুস্থ গবাদিপশুর মাংস নিরাপদ নয়।
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গবাদিপশুর তীব্র জ্বর হবে, বমি করবে, নাক দিয়ে রক্ত বেরোবে, ডায়রিয়া হবে, খিঁচুনি হয়ে সাধারণত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়।
ভয়ের কিছু নেই, দুধ-মাংস খেতে পারেন
অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। কারণ, গবাদিপশু এই রোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত মারা যায়—ফলে এটি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে বিক্রি করা বা জবাই করার মতো পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। যেমন ধরুন, পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চল থেকে গবাদিপশু এনে ঢাকার গাবতলীতে বিক্রি হয়—সেখান থেকে যায় কাঁচাবাজারে-কসাইখানায়। সুস্থ গবাদিপশু পরিবহন করে জবাইখানা পর্যন্ত আনতে যে সময় লাগে, অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলে সে সময়ের মধ্যে পশুর মৃত্যু হওয়ার কথা। আবার যে পশু বিশেষ করে গরু আক্রান্ত হবে সেটি দুধেল হলেও তার দুধ বন্ধ হয়ে যাবে—অর্থাৎ যে গরু দুধ দেবে সেটি অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত নয় এমনটি ধরেই নেওয়া যায়। সুতরাং গরু-ছাগল-ভেড়া-মহিষের মাংস কিংবা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণে কোনোরূপ ভয়ের কারণ নেই।
শুধু খেয়াল রাখতে হবে—আক্রান্ত গরু-ছাগল কেউ যেন জবাই করে মাংস বিক্রি না করে, এমনকি বিনা মূল্যেও যদি মাংস পাওয়া যায় তবুও তা গ্রহণে বিরত থাকতে হবে।
অ্যানথ্রাক্স শুরু হয় পশু থেকে। কাজেই পশু জবাইয়ের কাজে যারা নিয়োজিত, তাদের সচেতন থাকতে হবে—লক্ষণ দেখা দিলে আক্রান্ত পশু জবাই করা যাবে না।
শেষ কথা
আক্রান্ত পশু মারা গেলে ছয়-সাত ফুট গভীর মাটিতে পুঁতে দিন, অক্সিজেনের অভাবে ব্যাকটেরিয়া মারা যাবে। বন্ধ হবে জীবাণুর উৎস। মৃত পশু পানিতে ভাসাবেন না এবং ফেলে রাখবেন না।
আসুন, সুস্থ থাকি সবাই মিলে। লড়াই করে ভাইরাস তাড়িয়েছি এর আগে। এবার ব্যাকটেরিয়া তাড়াব জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য।
ইকবাল কবীর
সহকারী অধ্যাপক,
রোগতত্ত্ব বিভাগ জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান,
নিপসম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১০
Leave a Reply