গ্লকোমা চোখের এমন একটি মারাত্মক রোগ, যা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অন্ধত্বের দ্বিতীয় কারণ। বাংলাদেশ আই কেয়ার সোসাইটির একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৩৫ বছর বয়স এবং এর ঊর্ধ্বের ৩ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ গ্লকোমা রোগে ভুগছেন। এঁদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ মানুষ গ্লকোমা সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
গ্লকোমা কী?
আমাদের চোখের ভেতর অ্যাকুয়াস হিউমার নামক তরল পদার্থ অবিরাম প্রবাহিত হচ্ছে। চোখের ভেতর স্বাভাবিক চাপ ১০ থেকে ২০ মিলিমিটার মার্কারি পর্যন্ত। গ্লকোমা হলে এই তরল পদার্থের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে চোখের ভেতর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে এই অতিরিক্ত চাপের কারণে চোখের অপটিক নার্ভের ক্ষতিসাধন হয়। এ কারণে চোখে দেখার পরিধি আস্তে আস্তে সংকুচিত হতে থাকে এবং শেষ পর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণভাবে লোপ পেতে পারে। এ অবস্থার নামই গ্লকোমা। তবে চোখের চাপ স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও রোগী গ্লকোমায় আক্রান্ত হতে পারেন।
গ্লকোমার প্রকারভেদ
জন্মগত গ্লকোমা
জোবেনাইল গ্লকোমা (বয়স: ৩—১৬)
প্রাইমারি গ্লকোমা
(ক) ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লকোমা
(খ) অ্যাঙ্গেল ক্লোজার গ্লকোমা
সেকেন্ডারি গ্লকোমা
(ক) ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লকোমা
(খ) অ্যাঙ্গেল ক্লোজার গ্লকোমা
জন্মগত গ্লকোমা
জন্মগত গ্লকোমা শিশুদের মারাত্মক একটি রোগ। সাধারণত শিশুরা এই গ্লকোমা রোগটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
লক্ষণগুলো
চোখের চাপ বাড়ার ফলে কর্নিয়ায় পানি জমে ঘোলা হয়ে যায়। চাপ বাড়ার ফলে শিশুর চোখ বড় হয়ে যায়। এই চোখকে বলা হয় বুফথ্যালমাস। চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং আলোতে চোখ খুলতে পারে না। অপটিক নার্ভ নষ্ট হওয়ার ফলে যে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়, তা রোগী আর ফিরে পায় না।
চিকিৎসা
জন্মগত গ্লকোমায় ওষুধ দিয়ে কোনো লাভ হয় না। শিগগিরই অপারেশনের মাধ্যমে চোখের প্রেশার কমানোর জন্য চিসিৎসা করা হয়।
প্রাইমারি ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লকোমা
গ্লকোমার এই প্রকারটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে কর্নিয়া ও আইরিসের সংযোগ কোণ স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু তরল নির্গমন-ছাঁকনির ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চোখের ভেতরের চাপ বেড়ে যায় এবং আস্তে আস্তে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে থাকে।
সাধারণত কাদের হয়
৪০ বছর বয়স এবং এর ঊর্ধ্বে, অতিরিক্ত চোখের চাপ, বংশগত আফ্রিকান বা স্কেন্ডেনেভিয়ান জাতি, এ ছাড়া যাঁদের ব্লাড প্রেশার ও ডায়াবেটিস আছে, যাঁরা ক্ষীণদৃষ্টি ও মাইগ্রেনে ভুগছেন তাঁদের এই রোগের প্রবণতা বেশি।
উপসর্গ
প্রাথমিক অবস্থায় এই গ্লকোমার কোনো উপসর্গ থাকে না। আস্তে আস্তে অপটিক ডিস্কের ক্ষতি হয়ে দৃষ্টি পরিসীমা কমে যায় এবং একপর্যায়ে রোগী দৃষ্টিশক্তি হারায়।
রোগ নির্ণয়
মেডিকেল হিস্ট্রি নেওয়া, চোখের প্রেশার পরিমাপ করা, অপটিক নার্ভ পরীক্ষা করা, গণিওস্কপির মাধ্যমে চোখের অ্যাঙ্গেল পরিমাপ করা, দৃষ্টির পরিসীমা পরিমাপ করা, কর্নিয়ার থিকনেস মাপা, অপটিক্যাল কোহোরেন্ট টমোগ্রাফি করা এবং ২৪ ঘণ্টা চোখের চাপ পরীক্ষা করা।
চিকিৎসা
চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বর্তমানে বিভিন্ন চোখের ড্রপ আছে, যা নিয়মিত ব্যবহার করা, নিয়মিত চোখের চাপ পরীক্ষা করা, প্রতি ছয় মাস পরপর ভিজুয়্যাল ফিল্ড পরীক্ষা করা, সিসিটি পরীক্ষা করা। ওষুধ দিয়ে চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এবং গ্লকোম্যাটাস ভিজুয়্যাল ফিল্ড ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকলে, সে ক্ষেত্রে ট্র্যাবেকুলেক্টমি অপারেশনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
প্রাইমারি অ্যাঙ্গেল ক্লোজার গ্লকোমা
এ জাতীয় গ্লকোমা রোগে ভুক্তভোগীর সংখ্যা কম। বিশেষ করে, মহিলা ও উপজাতিদের এই রোগ বেশি দেখা যায়।
এ ক্ষেত্রে আইরিস কর্নিয়ার ওপরে উঠে আসে এবং অ্যাকুয়াস হিউমার নামের তরল পদার্থ নির্গমনপথ বন্ধ করে দেয়। ফলে চোখে উচ্চচাপ সৃষ্টি হয়।
উপসর্গ
এ জাতীয় গ্লকোমায় চোখের উচ্চচাপের কারণে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে চোখের সামনে আলোর চারদিকে মাঝেমধ্যে রংধনুর মতো দেখা যায়। হঠাৎ করে চোখের চাপ বেড়ে যাওয়ায় চোখ ও মাথায় তীব্র ব্যথা অনুভব হয়। চোখ লাল হয়ে যায় ও পানি পড়ে। চোখের কর্নিয়া ঘোলাটে হয়ে যায়। ফলে রোগী হঠাৎ করে চোখে কম দেখে।
চিকিৎসা
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ দিয়ে চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণের পর শিগগিরই অপারেশন করা শ্রেয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে লেজার দিয়ে আইরিডোটমি করে চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
সেকেন্ডারি গ্লকোমা
এই রোগটি বিভিন্ন কারণে যেকোনো বয়সেই হতে পারে।
কারণগুলো
দীর্ঘদিন চোখে (এলার্জি চোখে) স্টেরয়েড ড্রপ ব্যবহার করলে চোখে আঘাত লাগলে
ছানিজনিত কারণে চোখে প্রদাহ হলে
চোখের ভেতরে টিউমার থাকলে
চিকিৎসা
রোগের কারণ নির্ণয় করে সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া।
সচেতনতা
বিশেষ করে, গ্লকোমা পরীক্ষার জন্য ৩৫ বছর বয়সের পর থেকে বছরে একবার চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে চোখ পরীক্ষা করা উচিত। একবার গ্লকোমা নির্ণয় হলে নিয়মিত ওষুধ ব্যবহার করবেন এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ নেবেন। গ্লকোমা রোগী তাঁর রোগ ও চিকিৎসার অভিজ্ঞতা আশপাশের লোকজনকে জানালে অন্যরাও অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। মনে রাখতে হবে, গ্লকোমা রোগ থেকে চোখের যে দৃষ্টিশক্তি হারায়, এই দৃষ্টিশক্তি আর ফিরে পাওয়া যায় না। অতএব গ্লকোমা রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতাই পারবে অন্ধত্বের হাত থেকে বাঁচাতে।
এম মোস্তাফিজুর রহমান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১০
Leave a Reply