হৃৎপিণ্ডের রক্তনালিতে চর্বি জমে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে যে রোগের উৎপত্তি হয় তাকে ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বলে। হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন এ রোগের একটি বহিঃপ্রকাশ। হৃৎপিণ্ডের রক্তনালিতে চর্বি জমে ও রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে হৃৎপিণ্ডের পেশির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, একে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বলা হয়। মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো এই রোগ। যুক্তরাজ্যে এক সমীক্ষায় দেখা যায়, এক-তৃতীয়াংশ পুরুষ এবং এক-চতুর্থাংশ মহিলা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজে মারা যায়। ইসকেমিক হার্ট ডিজিজে হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন ছাড়াও ক্রনিক স্ট্যাবল এনজিনা ও আনস্ট্যাবল এনজিনা হতে পারে। রক্তনালির গায়ে চর্বি জমার জন্য হার্টের রক্তনালি সরু হয়ে যায়। সরু রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধার জন্য হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। রক্তনালিতে চর্বি জমা অথবা রক্ত জমাট বাঁধার জন্য খাদ্যের কিছু কিছু উপাদানকে দায়ী করা হচ্ছে। এর মধ্যে খাদ্যের চর্বি, বিশেষ করে সম্পৃক্ত চর্বির রক্তে কোলেস্টেরলের প্রভাবে হূদরোগ হওয়া সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। এ ছাড়া খাদ্যের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য উপাদান, যেমন—অসম্পৃক্ত ও ট্রান্স ফ্যাটি এসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং খাদ্যের আঁশের ভূমিকা রয়েছে।
হৃদরোগীদের খাওয়া-দাওয়া
হৃদরোগ বলতে এখানে রক্তপ্রবাহ ব্যাঘাতজনিত হূদরোগ বলা হচ্ছে। এ ধরনের রোগীদের আমরা চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। তার সঙ্গে ধূমপানও বন্ধ করতে বলি। অনেক রোগী কী খাবেন, কী খাবেন না এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। হূদরোগীদের খাদ্যতালিকায় প্রথমেই যোগ করতে হবে উজ্জ্বল রঙের শাকসবজি, যেমন—শসা, গাজর, ঢ্যাঁড়স, টমেটো, ডাঁটা, পালংশাক, লালশাক ইত্যাদি। প্রতিদিন কিছু না কিছু টাটকা মৌসুমি ফল যেমন—আম, জাম, পেয়ারা, কমলা, কলা, আপেল, পেঁপে ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
মাংসের মধ্যে হূদরোগীদের জন্য উপযোগী হচ্ছে বাচ্চা মুরগির মাংস। তবে মুরগির চামড়া, মগজ অবশ্যই বাদ দিতে হবে। কুসুম বাদ দিয়ে ডিমের সাদা অংশ খেতে হবে। নির্দ্বিধায় খাওয়া যাবে ছোট মাছ যেমন—মলা, কাঁচকি, টাকি, বেলে ইত্যাদি। এ ছাড়া বেছে নেওয়া যেতে পারে পাবদা, শিং, কৈ ও মাগুরকে। ইলিশ মাছ বেশি করে খাবেন। এতে উপকারী চর্বি ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড বেশি পরিমাণে থাকে। এ ছাড়া আরও অনেক মাছ আছে যেগুলোতে চর্বি নেই, সেগুলো খাওয়া যাবে। একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখলেই আপনি বুঝতে পারবেন মাছটি চর্বিযুক্ত কি না। মিঠাপানির তৈলাক্ত মাছ না খাওয়াই ভালো। তবে যেকোনো সামুদ্রিক মাছ খাওয়া যাবে। গবেষকেরা মনে করেন, সামুদ্রিক মাছ হূৎপিণ্ডের সুস্থতা রক্ষায় সহায়ক। তবে মিঠাপানির বড় মাছের চর্বি বাদ দিয়ে শুধু মাছটুকু খাওয়া যাবে। আটার রুটি খাওয়া যেতে পারে। ভাত কম খাবেন। ভুঁড়ির প্রতি লক্ষ রাখবেন। প্রতিদিন ভাতের সঙ্গে এক থেকে দুই চামচ ডাল খাওয়া যেতে পারে। রান্নার জন্য সয়াবিন ও ভেষজ তেল ব্যবহার করবেন। সাধারণ মাখনের পরিবর্তে ভেষজ মাখন (মার্জারিন) খাওয়া যেতে পারে।
হৃদরোগীদের খাবারের বিধিনিষেধ
হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে রক্তের কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখার জন্য খাদ্যাভ্যাসে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। এ ক্ষেত্রে রক্তের মোট কোলেস্টেরল ২০০ মি. গ্রাম/ডিএলের কম, এলডিএল ১০০ মি. গ্রাম/ডিএলের কম, এইচডিএল ৪০ মি. গ্রাম/ডিএলের বেশি ও ট্রাইগ্লিসারাইড ১৫০-এর কম রাখতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন দৈনিক মোট ক্যালরির শতকরা সাত ভাগের কম, সম্পৃক্ত চর্বি ও ২০০ মি. গ্রামের কম কোলেস্টেরল খাওয়া। দৈনিক ১০-২৫ গ্রাম আঁশজাতীয় খাবার খেতে হবে। মাখন, ঘি, বাটার অয়েল বর্জন করতে হবে। দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মিষ্টি, পেস্ট্রি, কেক, পায়েস ইত্যাদি খাওয়া যাবে না। গরু, খাসি, হাঁস ও প্রাণিজ চর্বি ও চর্বিযুক্ত মাংস পরিত্যাগ করতে হবে। মগজ, হাড়ের ভেতরের মজ্জা, চামড়া, ভুঁড়ি ইত্যাদি যেকোনো প্রাণীরই হোক না কেন, তা ত্যাগ করতে হবে। ডিমের কুসুমটুকু খাওয়া যাবে না। নারকেল না খাওয়াই ভালো। মিঠাপানির তৈলাক্ত মাছ, যেমন—পাঙাশ, বোয়াল, রুই, কাতলা ইত্যাদি এড়িয়ে চলাই ভালো। খোলসযুক্ত জলজ প্রাণী, যেমন—চিংড়ি খাওয়া উচিত হবে না। কখনো পেট পুরে খাওয়া যাবে না। পেট পুরোপুরি ভরার অনুভূতি হওয়ার আগে খাওয়া বন্ধ করতে হবে। উচ্চরক্তচাপ থাকলে খাওয়ার সময় পাতে কাঁচা লবণ, লবণ দিয়ে সংরক্ষিত খাবার যেমন—চিপস, আচার, চানাচুর, লোনা মাছ এসব একদম খাওয়া যাবে না। তাই টেবিল থেকে লবণদানিটি সরিয়ে ফেলাই ভালো। তা ছাড়া রান্নায়ও অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করা যাবে না।
হৃদরোগীদের অন্যান্য করণীয়
যেকোনো মূল্যে ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। সাদাপাতা, জর্দা, নস্যি, পান ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। পরিমিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম কতটুকু করা যাবে তা ইটিটির মাধ্যমে নির্ধারণ করে নেওয়া প্রয়োজন। তবে রোগী বেশি অসুস্থ থাকলে সে ক্ষেত্রে ব্যায়াম ও পরিশ্রমের ব্যাপারে অনেক বিধিনিষেধ মানতে হবে। তখন হূদরোগ বিশেষজ্ঞের কথামতো চলতে হবে। হূদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে কতটুকু হাঁটাচলা রোগীর জন্য নিরাপদ হবে। রোগী কয়তলা পর্যন্ত নিজে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবেন, আদৌ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবেন কি না—এ বিষয়গুলো চিকিৎসকের কাছ থেকে পরিষ্কারভাবে জেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে কমপক্ষে দৈনিক ৩০ থেকে ৬০ মিনিট করে সপ্তাহে তিন থেকে চারবার হাঁটা, জগিং, সাইকেল চালানো অথবা মুক্ত বাতাসে অন্যান্য ব্যায়াম করা যেতে পারে। উত্তম হলো সপ্তাহে প্রতিদিন এ পরিমাণ ব্যায়াম করা। জন্মনিরোধক বড়ি খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বাড়তি ওজন অবশ্যই কমাতে হবে। ওজন কমানোর জন্য চর্বিযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে। শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখার মাত্রা হলো বিএমআই ১৮ দশমিক ৫ থেকে ২৪ দশমিক ৯ কেজি/মি২ মধ্যে রাখা। আর কোমরের ব্যাস পুরুষের ক্ষেত্রে ৪০ ইঞ্চি বা তার কম এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৩৫ ইঞ্চি বা তার কম রাখতে হবে। উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হূদরোগীদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ ১৪০/৯০-এর কম রাখতে হয়। তবে হার্ট ফেইলিউর অথবা কিডনিজনিত সমস্যা থাকলে ১৩০/৮৫-এর কম এবং ডায়াবেটিস থাকলে ১৩০/৮০-এর কম রাখতে হয়।
মোহাম্মদ শফিকুর রহমান পাটওয়ারী
সহকারী অধ্যাপক
মেডিসিন, বাতজ্বর ও হূদরোগ
জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১০
Leave a Reply