মায়ের দুধ যে শিশুর জীবনের শ্রেষ্ঠ সুচনা, একথা আজ আর কোনো নতুন কথা নয়। আমরা মায়েরা জেনে গেছি মায়ের দুধে রয়েছে শিশুর জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে মা ও শিশুর মাঝে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক। অতএব শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে মা তার মাতৃত্ব পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন।
কিন্তু বুকের দুধ খাওয়াতে চাইলেই যে সব মা সহজেই সফলভাবে তা করতে পারবেন সেটা নাও হতে পারে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে মায়ের যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস, বুকের দুধ খাওয়ানোর ইচ্ছা, কখন কী করতে হবে তা জানা। বাংলাদেশে এখন ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মা’ই চাইছেন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে। তাদের বুকের দুধ খাওয়াতে সহায়ক হবে এরকম কয়েকটি বিষয় এখানে আলোচনা করা হলো।
কখন প্রথম বুকে ধরবেনঃ শিশুর জন্মের পরে প্রথম আধাঘণ্টা তার মায়ের দুধ টেনে খাবার ক্ষমতা খুব বেশি থাকে। তাই জন্মের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করা দরকার। কোনো অবস্হাতেই পানি, মিশ্রির পানি, মধু বা অন্য দুধ দেয়া উচিত নয়। বাচ্চা বাড়িতে হোক বা হাসপাতালে হোক, নরমাল হোক বা সিজারিয়ান হোক, জন্মের পরপরই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে মায়ের দুধ টানানো উচিত।
কীভাবে ধরবেনঃ মা যদি চিত হয়ে শুয়ে থাকেন তবে শিশুকে মায়ের বুকের উপরে উপুড় করে ধরা সহজ হবে।
কতবার খাওয়াবেনঃ প্রথমদিকে মায়ের বুকে যে শালদুধ থাকে, সেটা পরিমাণে কম হলেও গুণে অনেক সমৃদ্ধ। তাই শালদুধ অবশ্যই শিশুকে খাওয়াতে হবে। এ সময় যত ঘনঘন মায়ের বুকে ধরা যায়, ততই ভালো। কারণ এতে শিশুর দুধ টানার অভ্যাসটা চালু হয়। তাছাড়া বার বার টানার ফলে মায়ের দুধও বেশি করে নামতে শুরু করে। এখানে মনে রাখতে হবে, শিশু বোঁটা চুষলে মায়ের শরীরে এক ধরনের সাড়া পড়ে। ফলে দুধ তৈরি হতে শুরু করে। কাজেই দুধ নেই বলে বুকে টানাবো না এটা কিন্তু সঠিক চিন্তা নয়। নতুন শিশু সাধারণত একটু বেশি ঘুমিয়ে থাকে। তাই কিছুক্ষণ পর পর তাকে একটু নাড়াচাড়া দিয়ে জাগিয়ে বুকে ধরতে হবে। ঘুমিয়ে থাকলেও একটানা দু’ঘণ্টার বেশি যাতে না খেয়ে না থাকে, সেদিকে একটু খেয়াল রাখতে হবে। দিনে এবং রাতে উভয় সময়ে বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
একবারে কতক্ষণ খাওয়াবেনঃ শিশুকে একবারে একদিকের দুধ খাওয়াতে হবে। প্রতিবারে দুদিকেরই খাওয়াতে হবে-এ ধারণা সঠিক নয়। তবে একদিকের দুধ শেষ করে যদি তার পেট না ভরে, তাহলে অন্য দিকেরটাও খাওয়ানো যেতে পারে। এভাবে অদল-বদল করে দিনরাতে একবার ডান একবার বাম আবার ডান আবার বাম-এই নিয়মে খাইয়ে যেতে হবে। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর কোনো সময় নেই। যখন খুশি তখন মা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন এবং যখন খুশি তখন শিশুও তার মায়ের দুধ খেতে পারে। তবে শিশু যদি সারাক্ষণই মায়ের দুধ টানতে চায়, তখন খেয়াল করতে হবে সে বুকে ঠিকমত লেগেছে কিনা। অনেক সময় সে শুধু বোঁটা টানে এবং বোঁটায় কোনো দুধ থাকে না, দুধ থাকে কালো অংশের নিচে। শুধু বোঁটা টানার ফলে পরিমাণমত দুধ পায় না, অন্যদিকে বোঁটাও ফেটে বা ছিলে যেতে পারে। তাই তাকে আস্তে করে ছাড়িয়ে নিয়ে আবারো সঠিকভাবে ধরতে হবে। ঠিকমত দুধ পাওয়ার জন্য ঠিকমত বুকে ধরা অত্যন্ত জরুরি।
শিশুকে পানি বা অন্য দুধ দিলে কী ক্ষতিঃ শিশুর বয়স ছয় মাস পুর্ণ হওয়া পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধই তার জন্য যথেষ্ট। বুকের দুধে যে পরিমাণ পানি আছে তা তার পানির চাহিদা মেটায়। তাই প্রথম ছয় মাস তাকে কোনো বাড়তি দুধ বা পানি দেয়ার প্রয়োজন হয় না; বরং এসব দিলে তার ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা মিটে যাবে। সে মায়ের দুধ কম টানবে। কম টানলে দুধও কম তৈরি হবে। এছাড়া যে পাত্রে এই পানি বা বাইরের দুধ খাওয়ানো হবে তার থেকে অসুখ হতে পারে।
কীভাবে বুঝবেন শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছেঃ শিশু যদি চব্বিশ ঘণ্টায় ছয়বার প্রস্রাব করে তবে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে আপনার বাচ্চা পর্যাপ্ত বুকের দুধ পাচ্ছে। এছাড়া শিশু পরিতৃপ্ত থাকবে এবং ধীরে ধীরে তার ওজন বাড়তে থাকবে। তবে জন্মের পরে প্রথম ১৫/২০ দিন শিশুর ওজন সাধারণত একটু কমে তারপর বাড়তে শুরু করে। শিশু কাঁদলেই যে সে দুধ পাচ্ছে না এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। অনেক সময় মায়ের বুকে আদর করে জড়িয়ে ধরলে বাচ্চা কান্না বন্ধ করে। একটা জিনিস অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে সেটা হলো, দুধ খাওয়ার সময় সে ঠিকমত বোঁটা এবং কালো অংশসহ বড় হা করে ধরেছে কিনা।
মায়ের কয়েকটি সমস্যা ও তার সমাধান
* বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়ে আপনার কিছু কিছু সমস্যা হতে পারে। যেমন, আপনি অসুস্হঃ হতে পারেন, আপনার বোঁটায় ঘা হতে পারে, বোঁটার গোড়া ফেটে যেতে পারে, স্তন ভারী হয়ে ব্যথা হতে পারে, ফোঁড়া বা অন্য অসুবিধাও হতে পারে। অনেক মা মনে করেন তার দুধে বাচ্চার পেট ভরছে না এটাও একটা সমস্যা।
* মায়ের যে কোনো অসুস্হতার সময়ে শিশুকে তার কাছাকাছি রাখতে হবে এবং বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। এতে করে শিশুটির ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
* বোঁটায় ঘা হলে শিশু মায়ের দুধ ঠিকমত চুষছে কিনা সেটা লক্ষ্য করতে হবে। যদি সে বড় হা করে বেশ খানিকটা কালো অংশ মুখে নিয়ে দুধ খায় তাহলে বোঁটায় ঘষা লাগবে না এবং ঘা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে। যদি সে শুধু বোঁটা চোষে তাহলে একদিকে যেমন দুধ পাবে না অন্যদিকে মাও ব্যথা পাবেন। দুধ খাওয়ানো শেষ হলে মা একটু দুধ তার ঘায়ে লাগিয়ে বাতাসে শুকাবেন। তাহলে ঘা শুকিয়ে যাবে।
* মায়ের বুকে বেশি দুধ আসার ফলে বা শিশু দুধ কম খাওয়ার ফলে স্তন ভারী হয়ে শক্ত হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে দুধ চেপে বের করতে হবে এবং একটু নরম হলে শিশুকে বার বার দুধ টানাতে হবে। ঠান্ডা বা গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে শেক নিলেও উপকার পাওয়া যাবে এবং ফোঁড়া হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। আপনার বুকে দুধ নেই এই ধরনের ধারণা করা একেবারেই ঠিক নয়। সৃষ্টির নিয়ম হচ্ছে, শিশু টানলে মায়ের বুকে দুধ তৈরি হবে। অতএব মাতৃত্বের গৌরব নিয়ে, মমতার সাথে নিজের ওপর আস্হা রেখে, শিশুকে বার বার বুক টানান। দেখবেন আস্তে আস্তে দুধ বাড়তে শুরু করবে।
শিশুর কয়েকটি সমস্যা ও তার সমাধান
* মায়ের দুধ খাওয়ানোর সময় শিশুর কিছু সমস্যা হতে পারে। যেমন-শিশুর অসুখ হতে পারে, বার বার পাতলা পায়খানা হতে পারে, বমি হতে পারে, পেটে গ্যাস হতে পারে, সে কান্নাকাটি করতে পারে অথবা মায়ের দুধ না খেতে চাইতে পারে।
* শিশুর যে কোনো অসুস্হতার সময় মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতে মাত্র দু-একটি অসুস্হতায় বুকের দুধ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা দরকার হতে পারে।
* মায়ের দুধ খেলে সাধারণত শিশুর বার বার একটু পাতলা পায়খানা হতে পারে (এই পাতলা পায়খানা ১০-২০ বারও হতে পারে)। এটা কোনো অসুস্হতা নয়। তাই বেশি বেশি করে দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। অনেক সময় বমি বা পেট ফাঁপা দেখা দিতে পারে। শিশু যদি মায়ের দুধ ঠিকভাবে মুখে পুরে না খায় তবে দুধ খাওয়ার সময় সে কিছুটা বাতাস খেয়ে ফেলে। এই বাতাসই তার বমি বা পেট ফাঁপার কারণ হতে পারে। তাই দুধ খাওয়ানোর সময় ঠিকমত দুধ মুখে নিয়ে খাচ্ছে কিনা সেটা লক্ষ্য করা অত্যন্ত জরুরি। পেট ফেঁপে গেলে কোলের ওপর বা বালিশের ওপর একটু উপুড় করে শোয়ালে আস্তে আস্তে বাতাস বেরিয়ে যাবে। এজন্য একটি কাজ করা যেতে পারে। সেটা হলো প্রতিবার বাচ্চাকে খাওয়ানোর আগে মা তার বুকের প্রথম দুধ খানিকটা চেপে ফেলে তারপর খাওয়াবেন। শেষের দুধটা প্রথম দুধের চেয়ে ঘন হওয়ার ফলে সমস্যাগুলো কমে যাবে।
* শিশু যদি মায়ের বুক না টানতে চায় তবে জোরাজুরি করা উচিত নয়। বরং নিরিবিলি ঘরে বসে মা আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে কথা বলে ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করবেন। যখন সে মুখ হা করবে তখন শিশুকে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরতে হবে। মায়ের শিশুর দিকে ঝুঁকে যাওয়ার দরকার নেই।
* শুধু মায়ের দুধ খেলে কোনো কোনো শিশু সপ্তাহে একবার বা দু’বার পায়খানা করতে পারে। এর জন্যে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। একদিকে বার বার পাতলা পায়খানা হওয়া, অন্যদিকে সপ্তাহে একবার পায়খানা হওয়া-এ দুটোই মায়ের দুধ খাওয়া শিশুর জন্য স্বাভাবিক।
* সম্পুর্ণ ভিন্ন পরিবেশ থেকে একটা শিশু পৃথিবীতে আসে। তার ঘুম, খাওয়া, পায়খানা, প্রস্রাব এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে কিছুটা সময় লাগা স্বাভাবিক। এই প্রথম সময়টা যদি একটু ধৈর্যের সাথে পার করে দেয়া যায়। তখন উভয়েই তাদের নিজস্ব নিয়মে বুকের দুধ খাওয়া চালিয়ে যেতে পারে।
* মা যদি চাকরিজীবী হন তবে তিনি চেপে বাটিতে দুধ রেখে যেতে পারেন। গালানো দুধ ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ভালো থাকে। ফ্রিজে রাখলে ২৪ ঘণ্টা রাখা যায়। সামান্য গরম পানিতে দুধের বাটিটা বসিয়ে চামুচ দিয়ে তা শিশুকে খাওয়ানো যেতে পারে। যদি বেশি দুধের দরকার হয় তবে মা আগের দিন থেকে তার দুধ চেপে সংগ্রহ করতে পারেন। প্রয়োজনে কর্মক্ষেত্রে শিশুকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন।
* সামনে খোলা জামা পরলে দুধ খাওয়াতে মায়ের সুবিধা হয়। সংসারের কাজ করতে করতে, যাতায়াতের সময়, লেখাপড়ার সময়, টিভি দেখা বা মেহমানদের সঙ্গে কথা বলা এবং সেই সাথে বুকের দুধ খাওয়ানো কোনো অসুবিধা হয় না যদি জামার বোতাম সামনে থাকে এবং বড় ওড়না, শাড়ির আঁচল বা চাদর দিয়ে গা ঢাকা থাকে।
* কোনো কারণে যদি বুকের দুধ খাওয়ানো সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে তবে মা যখনই আবার খাওয়াতে চাইবেন তখনই শিশুকে বুকের দুধ টানাতে হবে। শিশু চুষলেই আস্তে আস্তে আবার আগের মতো দুধ আসবে।
* তবে কোনো অবস্হায়ই শিশুর মুখে বোতল বা চুষনী দেয়া উচিত না। তাহলে শিশু তার মায়ের বোঁটা মুখে নিতে চাইবে না। সে ওই নরম রাবারের বোঁটা বেশি পছন্দ করবে।
* আপনার শিশুর বয়স যদি দুই বছরের কম হয় এবং আপনি যদি তাকে বুকের দুধ কখনো না দিয়ে থাকেন তবে চেষ্টা করে দেখুন-আজ এবং এখনই। বুকের দুধ পান করা শিশুর জন্মগত অধিকার। তাকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার আমাদের কারো নেই।
* শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়া উচিত নয়। এতে বুকের দুধ কমে যেতে পারে। তাই অন্য কোনো ব্যবস্হা নেয়া উচিত।
ডা. আইনুন আফরোজ
দৈনিক আমারদেশ, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
Leave a Reply