শুভর বয়স ২০ বছর। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। হঠাৎ একদিন রাতে শোবার সময় মনে হতে লাগল পায়ের নিচে কেমন যেন একটু কামড়াচ্ছে। ভাবলেন, আজকে হয়তো একটু বেশি হাঁটাচলা হয়েছে, সে জন্য এমনটি হচ্ছে। পাত্তা না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে দেখেন পা যেন অবশ হয়ে গেছে এবং কেমন যেন ঝিনঝিন করছে। পা দুটো খুব একটা নাড়াতে পারছেন না। মাকে ডাকতে লাগলেন। মা-বাবা তখনই হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। চিকিৎসক শুভকে পরীক্ষা করে জিজ্ঞাসা করলেন, দু-চার সপ্তাহখানেক আগে শুভর কোনো পাতলা পায়খানা হয়েছিল কি না। মা বললেন, দুই-তিন সপ্তাহ আগে পাতলা পায়খানা হয়েছিল। কিন্তু এত সামান্য ছিল যে ওষুধ পর্যন্ত লাগেনি। চিকিৎসক ছোট্ট একটা হাতুড়ি দিয়ে হাত ও পায়ে হালকা বাড়ি দিয়ে দেখলেন শুভর কোনো রিফ্লেক্স নেই। তারপর বললেন, শুভর জিবিএস হয়েছে। অর্থাৎ ডায়রিয়া থেকে প্যারালাইসিস। শুভর মা-বাবা কোনো দিন এই রোগের নাম শোনেননি বা রোগ দেখেননি। এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করায় চিকিৎসক বললেন, জিবিএস রোগটি নার্ভের রোগ। সাধারণত এই রোগ হওয়ার দুই থেকে চার সপ্তাহ আগে রোগীর ডায়রিয়া বা হালকা ঠান্ডা, জ্বর, কাশি হতে পারে। তারপর ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়। ডায়রিয়া হওয়ার দুই থেকে চার সপ্তাহ পর হঠাৎ করে শুভর মতো প্যারালাইসিস হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পা থেকে প্যারালাইসিস ওপর দিকে উঠতে থাকে। প্যারালাইসিস যখন বুকে ধরে, তখন রোগী শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না। হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হতে হয় এবং মেশিনের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হয়। নতুবা রোগী মারা যায়। আমাদের শরীরের নার্ভকে তুলনা করা যেতে পারে ইলেকট্রিক তারের সঙ্গে। অর্থাৎ ইলেকট্রিক তারের বাইরে যেমন প্লাস্টিক আছে তেমনি নার্ভের বাইরে একটা আবরণ আছে, তাকে মাইলিন বলে। এটা নষ্ট হলে আবার তৈরি হয়।
ইলেকট্রিক তারের ভেতরে যেমন ধাতু আছে, তেমনি নার্ভের ভেতরও আছে। তাকে বলে এক্সজোন। এটা নষ্ট হলে তৈরি হয় না।
যখনই ডায়রিয়া হয়, তার পরপরই শরীরে একটা রি-অ্যাকশন হয়। এই রি-অ্যাকশনটা নার্ভের ভেতরের এক্সজোন বা বাইরের মাইলিনের ওপর হতে পারে।
এক্সজোনের মধ্যে হলে খুবই খারাপ, ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু মাইলিনের ওপর হলে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব।
আমাদের দেশে ডায়রিয়া একটা কমন রোগ। এই ডায়রিয়া বিভিন্ন জীবাণু দিয়ে হতে পারে। এসব জীবাণুর মধ্যে কেমফাইলো জেজুনি দ্বারা একটা বিরাট অংশ হয়। সাধারণত পানিবাহিত বা খাদ্যের মধ্য দিয়ে এই জীবাণু শরীরে ঢোকে।
এই জীবাণু দিয়ে ডায়রিয়া হলেই জিবিএস বা প্যারালাইসিস হতে পারে। ঢাকা কলেরা হাসপাতালের (আইসিডিডিআরবি) মাধ্যমে নেদারল্যান্ড থেকে কিছু চিকিৎসক বাংলাদেশে আসেন এই জিবিএস রোগের ওপর রিসার্চ করার জন্য। তারা বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এই জিবিএস রোগী সংগ্রহ করে তাঁদের রক্ত, সিএসএফ ও নার্ভ পরীক্ষা করে। এতে প্রকাশ পায় যে ৫৭ শতাংশ জিবিএস এই কেমফাইলো জেজুনি জীবাণু দিয়ে হয়েছে।
এই জিবিএসের ২৫ শতাংশ আইসিইউতে ভর্তি হয়েছে, ৬৭ শতাংশ এক্সজোনাল জিবিএস। অর্থাৎ নার্ভের ভেতরের ধাতুতে ধরে, অর্থাৎ তাদের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। ১৪ শতাংশ রোগী মারা যায়। ২৯ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে বেঁচে থাকে।
সুতরাং কেমফাইলো জেজুনি জীবাণু একটু সামান্য ডায়রিয়ায় কী সাংঘাতিক রোগের সৃষ্টি করে!
এই জিবিএসের চিকিৎসার কোনো বিশেষ ওষুধ নেই। আইভিআইজি বা প্লাজমা এক্সচেঞ্জ অর্থাৎ শরীরের সব রক্তের পানি ফেলে দিয়ে নতুন করে রক্তের পানি শরীরে ঢোকানো হয়। এগুলো আমাদের দেশে আছে, তবে খুবই ব্যয়বহুল, যা সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে।
ওই নেলারল্যান্ডের স্টাডিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এক্সজোনাল ভ্যারাইটির জিবিএসটা খুব বেশি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই কেমফাইলো জেজুনি দিয়ে হয়। এই জিবিএস রোগীর মৃত্যুহারও বেশি এবং যারা বেঁচে থাকছে তারা শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে বাঁচছে।
পরামর্শ
নিরাপদ পানি ও খাদ্যের দিকে খেয়াল করুন।
হাত খুব ভালো করে ধুয়ে খাবার ধরুন।
সেলিনা ডেইজী
সহযোগী অধ্যাপক, নিউরোলজি বিভাগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৮, ২০১০
Leave a Reply