ক্যান্সার শব্দ কী করে এল
ক্যান্সার, এ শব্দটির জন্য আমরা ঋণী গ্রিক চিকিৎসক হেপোক্রিতেসের কাছে, যাঁকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি টিউমার শব্দটি বর্ণনার জন্য গ্রিক শব্দ কার্সিনোস এবং কার্সিনোসা ব্যবহার করেছিলেন। ক্যান্সারকে গ্রিক শব্দে বলা হতো “karkinos”। এই শব্দের অর্থ হলো ‘কর্কট’ এবং হেপোক্রিতেসের ধারণা ছিল ক্যান্সার দেখতে কাঁকড়া বা কর্কটের অবয়বের মতো। হেপোক্রিতেস ক্যান্সার শব্দটি নামকরণ করে থাকলেও সম্ভবত তিনি এই রোগ প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন, তা কিন্তু নয়। এর ইতিহাস অনেক পুরোনো।
প্রথম ক্যান্সারের বিবরণ
যত দূর জানা যায়, ক্যান্সার রোগের সবচেয়ে পুরোনো নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল প্রাচীন মিসরে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে। এর বি্নৃত বর্ণনা ছিল প্যাপিরাস নামের একটি কাগজে, স্তনের আটটি ক্যান্সার বিবরণ ছিল এতে। ‘কটারাইজেশন’ বা ‘তাপদগ্ধকরণ’ প্রক্রিয়ায় এদের চিকিৎসা হয়েছিল। ‘ফায়ার ড্রিল’ নামে উত্তপ্ত শলাকা দিয়ে কোষকলাকে ধ্বংস করা হতো এই পদ্ধতিতে। এও জানা গিয়েছিল যে এ রোগের কোনো নিরাময় ছিল না, রোগ প্রশমন করাই কেবল সম্ভব ছিল।
এমনও তথ্য-প্রমাণ আছে যে প্রাচীন মিসরীয়রা নির্দোষ ও প্রাণসংহারী টিউমারগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে সমর্থ ছিল। কাগজে ও শিলালিপিতে উৎকীর্ণ লিপি উদ্ধার করে জানা যায়, ত্বকের ওপর সৃষ্ট টিউমারগুলোকে এখনকার মতোই অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করা হতো।
ক্যান্সারের কারণ সম্পর্কে প্রাচীন যুগের চিকিৎসকদের ধারণা
আমরা মানবশরীর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি এখন; কিন্তু প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসকেরা এত সৌভাগ্যবান ছিলেন না। ধারণা ও অনুমাননির্ভর ছিল সিদ্ধান্ত। হেপোক্রিতেস মনে করতেন, শরীর চারটি তরল পদার্থ নিয়ে গঠিত ছিল। বুক, শ্লে্না, হলুদ পিত্ত ও কৃষ্ণ পিত্ত। তাঁর ধারণা ছিল, দেহের কোনো স্থানে কৃষ্ণ পিত্তের আধিক্য দেখা দিলে ঘটত ক্যান্সার। এরপর এক হাজার ৪০০ বছর পর্যন্ত ক্যান্সারের কারণ সম্পর্কে এমন ধারণাই ছিল। প্রাচীন মিসরে এমন ধারণা ছিল, ক্যান্সার হয় দেব-দেবতার কোপের কারণে।
শব ব্যবচ্ছেদ করে রোগ নির্ণয়
১৬২৮ সালে বিজ্ঞানী হার্ভে শব ব্যবচ্ছেদ করে রোগ নির্ণয় করার যে রীতি চালু করেন, এতে মানবশরীরতত্ত্ব ও শারীরবৃত্ত সম্পর্কে অনেক জানা গেল। রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়াও আবিষ্কৃত হলো এবং এতে রোগ সম্পর্কে আরও গবেষণার দ্বার উ্নুক্ত হলো। অবশ্য ১৭৬১ সালে প্রথম অটোপসি বা শব ব্যবচ্ছেদ করে রোগগ্রস্ত মৃত লোকের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের কাজ শুরু হলো। পাদুয়ার জিওভানি মরগাগনি প্রথম এ ধরনের অটোপসি করা শুরু করলেন।
রেনেসাঁর পর ইতিবৃত্ত আবার ক্যান্সারের কারণ নিয়ে আরও তথ্য
হেপোক্রিতেসের কৃষ্ণ পিত্ত তত্ত্বের বদলে সতেরো শতকে এল ক্যান্সারের কারণ হিসেবে নতুন তত্ত্ব ‘লসিকা-রস তত্ত্ব’। লসিকা-নালি আবিষ্কারের পর ক্যান্সারের কারণ সম্পর্কে নতুন কিছু জানা গেল। ধারণা করা হলো, লসিকা-নালিতে অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে তবেই ক্যান্সার হয়।
ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানী রুডল্ফ ভার্কো বলেন, কোষগুলো, এমনকি ক্যান্সার কোষও আসে অন্যান্য কোষ থেকে।
আরও তত্ত্ব এল সেই সঙ্গে। মনে করলেন কেউ কেউ ক্যান্সারের পেছনে আঘাত বা ক্ষত, পরজীবী-এসব কারণ থাকতে পারে। মনে করা হতো, ক্যান্সার ছড়ায় ‘তরল পদার্থের’ মতো। আর সিদ্ধান্ত হলো, জার্মান সার্জন কার্ল থিয়াসের মতে ক্যান্সার ছড়ায় সংহারী কোষগুলোর মাধ্যমে। মজার কথা, ১৯২৬ সালে পাকস্থলী ক্যান্সারের কারণ হিসেবে ‘পোকা বা কীট’ এমন তত্ত্বের আবিষ্কারের জন্য ভুলক্রমে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো একজন বিজ্ঞানীকে। এই তত্ত্ব যে কতটা ভুল, তা সাধারণ মানুষও এখন বুঝতে পারে। বিংশ শতকে ক্যান্সার গবেষণায় এল বড় রকমের অগ্রগতি।
গবেষণায় দেখা গেল, এর পেছনে রয়েছে ক্যান্সারজনক তন্তু বা ‘কার্সিনোজেন’। এল চিকিৎসার জন্য কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি। রোগ নির্ণয়ের অনেক উন্নত পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলো। এখন আগাম ধরা পড়লে অনেক ক্যান্সার নিরাময় হয়, চলছে আরও গবেষণা। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং গবেষণা চলছে নিরাময়সূত্র আবিষ্কারের জন্য, প্রতিরোধের সঠিক পথ আবিষ্কারের জন্য।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
সূত্রঃ প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২০, ২০০৮।
Leave a Reply