ফাস্টফুড খাওয়া অনেকের শখ। একসময় তা বাতিক হয়ে গেল, যাকে ক্রেজ বলা যায়। কিন্তু কেন? পুষ্টিগুণের বিচারে এত বাজে খাবার এই ফাস্টফুড খেতে কেন এত দৌড়ানো? আসলে যাঁদের ঘরে হাঁড়ি চড়ে না উনুনে, রান্না করার অভ্যাস ও ইচ্ছা যাঁদের নেই, তাঁরাই তো এসব ফাস্টফুড খান। অবশ্য যাঁরা ব্যাচেলর বা একা থাকেন, ফাস্টফুড খেতে হয় তাঁদেরও—বলেন অনেকে। যাঁদের খুব ব্যস্ততা, রান্নার সময় নেই, কেবল কাজ আর কাজ তাঁদেরও। তারপরও যে কথা, তা হলো ফাস্টফুড খাওয়া অনেকটা কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে তরুণদের মধ্যে। বাসায় মাছের ঝোল, সবজি হলেও তা তাঁদের বড় অপছন্দ। স্বাস্থ্যকর আহার, পুষ্টিপছন্দের সব খাবার না খাওয়া—এতে যে কত ক্ষতি, তা অনেকেই হয়তো জানেন না। আমরা কী খাচ্ছি, শরীর, মন ও এনার্জি লেভেলের ওপর এসব খাবারের যে অনেক প্রভাব, তা আমরা কজনই জানি? যখন বাইরে রেস্তোরাঁয় খান, তখন কী খাওয়াল, তা কি সব সময় জানা যায়? কী তেলে ভাজল, সাত দিনের পুরোনো কালো তেল, নুন কতটুকু দিল, খাদ্য প্রস্তুতিতে কী সব ক্ষতিকর উপকরণ যোগ হলো, কত রকম রেস্তোরাঁই তো আছে। রাস্তার পাশে রেস্তোরাঁয় রান্না, ধুলা-ময়লা মিশিয়ে রান্না, নোংরা জলে ধোয়া সবজি ও মাংস—তাও তো লোকজন খাচ্ছে! ঘরে রান্না করা খাবার কত ভালো! একটু কষ্ট করে রান্না করলে কী হয়, আলসেমি ছেড়ে। খাওয়ার আগে একটা কথা বলি।
পুষ্টি রক্ষা করতে গেলে খাবার ভালো করে চিবিয়ে খেতে হবে। খাবার গেলার আগে ভালো চিবানো চাই। আর খাবার চিবালে পাকস্থলীও জানতে পারে অন্ননালি দিয়ে কী যাচ্ছে ওই থলিতে। আর চিবালে লালা ঝরে, সেইসঙ্গে আসে অনেক হজমের এনজাইম ও নানা পুষ্টির উপকরণ। খাবার চিবালে হজম হয় ভালো, শরীরে ক্ষুদ্র খাদ্যকণাও ঢোকে সহজে। তা না হলে পেটে প্রচুর গ্যাস হয়। পেটে ভুটভাট চলবেই।
স্বাস্থ্যকর আহারের আরেকটি দিক হলো মন ভালো রেখে খাওয়া, খাওয়া উপভোগ করা। অনেক ধর্মের সংস্কৃতিতে খাদ্য গ্রহণের আগে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা বা বন্দনা করার নিয়ম আছে। যে মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের আহারের জোগান দেন, তাঁর স্তুতিবন্দনা করে, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আহার শুরু করার নিয়ম।
মানসিক চাপের ভারে মন—এ অবস্থায় খাওয়া ঠিক নয়। দৌড়ের ওপর জীবন, দৌড়ের ওপর খাওয়া, হজমের গোলমাল হবেই তো। কী আর করা। অনেকের জীবনই এ রকম। তাই প্রতিবেলা আহারের আগে মিনিটখানেক চোখ বুজে, গভীর শ্বাস নিয়ে তারপর আহার, কিছু শান্তি হবে মনে। স্নায়ুর পরিসমবেদি দিকটা শরীরে আনে প্রশান্তি। সমবেদি স্নায়ু উদ্দীপ্ত হলে উত্তেজনা বাড়ত, পরিপাকতন্ত্র থেকে রক্ত দৌড়ে যেত হাতে-পায়ে।
খাবেন ধীরেসুস্থে, শিথিল হয়ে, প্রতিটি গ্রাস উপভোগ করে। খাদ্যের সুবাস, সংযুতি, স্বাদ, বুনন সবই মন ভরায়। আর এতে হজম যেমন হয় ভালো, তেমনি এনার্জি লেভেলও যায় বেড়ে। খাওয়ার সময় দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ দূরে রাখা উচিত; বরং চর্বণকর্মে মনোনিবেশ করা ভালো।
কী খাব এ নিয়ে কত কথা! নিরামিষাশী হলেও খাবারে আমিষ থাকবেই যথাযথ পরিমাণে। শরীরের বাড়ন-গড়নের জন্য আর স্বাস্থ্যের জন্য আবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড খুবই দরকার।
নানা বর্ণের শাকসবজি ও ফল খেলে পুষ্টির জোগান হয় সহজে। কেন খাবেন ফাস্টফুড, প্যাকেটজাত ও টিনজাত খাবার? চিনি-মিঠাই আর কোমলপানীয় কেন? হাটবাজার থেকে শাকসবজি কেনা খুব ভালো। পুষ্টিকর খাবার খেতে হলে হাটবাজার তো করতেই হবে। কোমলপানীয় আর নয়; বরং ডাবের পানি অনেক ভালো। সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ বেশ জটিল ব্যাপার। যেমন—প্রোবায়োটিকস, এসেনশিয়াল মেদঅম্ল, স্পিরুলিনা, নীলসবুজ আলজি, ক্লোরেলা এসব। এমনকি মাছের তেলও। সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খেলে ভিটামিন বড়ি তেমন খাওয়ার দরকার হয় না। যারা রান্না করে না, তাদের জন্য খাবার তৈরি করার ব্যাপারটা চ্যালেঞ্জিং বটে। রান্ন অত সহজ নয়, কুশলী কাজ। একটা কথা বলি, প্রাতরাশ কিন্তু দিনের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ খাবার। অনেকে বলে ওটমিল। দুধ-মুড়ি, দই-খই, কলাও বেশ ভালো। ডিম পোচ, টোস্ট ফল, দই কেন নয়? বেশ ভালো।
মধ্যাহ্ন আহারে মাছের ঝোল বা কচি দেশি মোরগের ঝোল, ভাত, সবজি বা সালাদ ভাপে সেদ্ধ হলে ভালো। পাঁচফোড়ন অথবা কালিজিরা ও কাসুন্দি দিয়ে ভাপে সেদ্ধ সবজি, সবজির সালাদে ভিনেগার। পেঁয়াজ, রসুন, জলপাই তেল, গাজরের সালাদ। আলুতে বেশ পুষ্টি, পটাশিয়ামও আছে। মিষ্টি আলুও বেশ পুষ্টিসমৃদ্ধ। আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, টাকি মাছের ভর্তা নয় কেন? সঙ্গে ধনেপাতা, পুঁদিনাপাতা…। রান্না করে দেখা যাক না?
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল
সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১১, ২০১০
Leave a Reply