যাঁরা অংশ নিলেন
অধ্যাপক আব্দুল আউয়াল রিজভী
পরিচালক
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান
অধ্যাপক ডা. এ কে এম আনোয়ার উল্লাহ্
নিউরোমেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
মিজ ভেলেরি টেইলর
প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও
সিআরপি
শহীদুর রহমান
সহযোগী অধ্যাপক, ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেলবিশ্ববিদ্যালয়
সোহরাব হোসেন
বিভাগীয় প্রধান
ফিজিওথেরাপি, সিআরপি
মাহফুজুর রহমান
বিভাগীয় প্রধান
অকুপেশনাল থেরাপি, সিআরপি
সঞ্চালক
আব্দুলকাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
ডা. ইকবাল কবীর
বিভাগীয়সম্পাদক, স্বাস্থ্যকুশল, প্রথম আলো
আব্দুল কাইয়ুম
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হলো ‘পক্ষাঘাত ও পুনর্বাসন: আমাদের করণীয়’। অনেকেই আছে, যারা কিনা এই রোগের পর হতাশ হয়ে পড়ে। মনে করে, পক্ষাঘাত ভালো হওয়ার নয়। কিন্তু এই রোগ থেকে অনেকাংশেই, এমনকি ৯০ শতাংশ সুযোগ থাকে ভালো হওয়ার, পুনর্বাসনের।
এ ক্ষেত্রে আজ আলোচনার শুরুতে মিস ভেলেরিকে আজকের বিষয় নিয়ে প্রারম্ভিক একটি বক্তব্য দেওয়ার অনুরোধ করছি।
ভেলেরি এ টেইলর
ধন্যবাদ প্রথম আলোকে। পক্ষাঘাত অনেক কারণে হতে পারে। এর মধ্যে নন-ট্রোমাটিক স্ট্রোক এ রোগের বড় কারণগুলোর একটি। পক্ষাঘাত হলো শরীরের যেকোনো একটি অংশ দুর্বল হয়ে যাওয়া বা কর্মক্ষমতা হারানো। স্ট্রোক থেকে বাঁচতে হলে কখনো উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, কখনো বা ওষুধ সেবন করতে হবে এবং ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্টদের সহযোগিতা নিতে হবে। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে একটি পেশাদার গোষ্ঠীর কথা আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, যেটা একেবারেই নতুন, যা কিনা স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এবার প্রথম এ বিষয়ে একটি দল পাস করে বেরিয়েছে। চার বছরের বিএসসি অনার্স এবং সঙ্গে এক বছরের ইন্টার্নিশিপ শেষ করেছে তারা। এটা এত বড় জনগোষ্ঠীর জন্য সংখ্যায় খুবই নগণ্য। তবে আমরা খুশি, একটা দল তো অন্তত বেরিয়েছে। রোগীদের দরকার কাউন্সেলিং ও সহযোগিতা, কিছু ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ। ট্রোমাটিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি। স্পাইনাল কর্ডের ইনজুরির ওপর নির্ভর করে রোগীর পক্ষাঘাত কোন অংশে হবে। এর ওপর নির্ভর করেই কখনো পক্ষাঘাত হতে পারে আংশিক, কখনো বা পুরোপুরি। শরীরের এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত অংশগুলোতে কোনো ধরনের অনুভূতি থাকে না। রোগী পরিবারের বোঝা হয়ে ওঠে। এবার পুনর্বাসনের কথায় আসি। পুনর্বাসন বলতে রোগীকে দুর্ঘটনার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসাকেই বোঝায়। গত ৩০ বছর ধরে সিআরপি পুনর্বাসনের ওপর কাজ করে আসছে। আমরা বিশ্বাস করি, শারীরিক পুনর্বাসনই বড় কথা নয়, মানসিকভাবে পুনর্বাসনও দরকার। একজন শক্ত-সামর্থ্য মানুষ গাছে উঠেছেন, কিন্তু সেখান থেকে পড়ে গেলেই মুহূর্তে তাঁর জীবন পাল্টে যেতে পারে। তারপর তাঁর জায়গা হতে পারে হুইল চেয়ারে! এ ধরনের রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক পুনর্বাসনও জরুরি। অনেকেই আমাদের জিজ্ঞেস করে, আমরা কী করব? তাই প্রথমেই তাদের সচেতন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন খুব জরুরি একটি বিষয়। অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে আমাদের। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। শিক্ষাও বড় ভূমিকা রাখতে পারে এতে। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই সচেতন হতে হবে আমাদের। প্রশাসনকে সচেতন হতে হবে। গণমাধ্যম তো ভূমিকা রাখতেই পারে।
ইকবাল কবীর
অনেক ধন্যবাদ, মিস টেইলর। আমরা পক্ষাঘাত ও পুনর্বাসনের প্রেক্ষাপটটা জানলাম। আমরা এখন নিউরোমেডিসিনের দৃষ্টিকোণ থেকে পক্ষাঘাত বিষয়ে কথা শুনব। পক্ষাঘাতে আমাদের করণীয় কী, এসব বিষয়ে এখন কথা বলবেন অধ্যাপক এ কে এম আনোয়ার উল্লাহ।
এ কে এম আনোয়ার উল্লাহ
স্ট্রোক আসলে মস্তিষ্কের রোগ। বিষয়টি অনেকেই জানে না। অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে স্ট্রোক একটি হূদরোগ। স্ট্রোক দুই রকমের—এক হয় ধমনির ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে। এটাকে আমরা এমবুলিজম বা থ্রোমবোসিস বলি। প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষেরই এমনটা হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে রক্তক্ষরণ হওয়া। মস্তিষ্কের ভেতরে শিরা ছিঁড়ে যায়। ফলে রক্তক্ষরণ হয়। সেটা মাত্র ১৫ শতাংশের বেলায় ঘটে থাকে। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সীদের ক্ষেত্রেই স্ট্রোক খুব বেশি দেখা যায়। স্ট্রোক হয় আসলে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের কারণেই। আমার কাছে যেসব রোগী আসে, তাদের অধিকাংশই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে এ কারণেই অধিকাংশ সময় স্ট্রোক হয়। উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না আনলেও একই সমস্যায় পড়তে হয় অনেকের। অন্য কারণগুলো মধ্যে কোলেস্টেরল ও লিপিডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া মোটাসোটা হয়ে গেলেও তা হতে পারে। কখনো কখনো হূদরোগের জটিলতা হিসেবেও স্ট্রোক হতে পারে। এখন আমাদের দেশে সংখ্যায় কমে গেলেও আগে বাতজ্বরের কারণেও স্ট্রোক হতো। এগুলো আমাদের দেশে স্ট্রোক হওয়ার খুব সাধারণ কারণ। স্ট্রোক হলে প্রথমে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। তবে রোগীর অবস্থা যদি খুব খারাপ হয়, তাহলে তো তাকে হাসপাতালে নিতেই হবে। আমাদের গোটা শরীর কিন্তু মস্তিষ্কই চালায়। মস্তিষ্কের কোন অংশে স্ট্রোক হলো, তার ওপর নির্ভর করবে রোগীর শরীরের কোন অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হবে। শারীরিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়া রোগীরা যে শুধু ফিজিওথেরাপি নেবে, তা নয়। অকুপেশন থেরাপিও দরকার তাদের জন্য। আমার মনে হয়, এখনো বাংলাদেশের সরকারি মেডিকেলগুলোতে ফিজিওথেরাপির ব্যাপারটি ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তা ছাড়া শুধু ফিজিওথেরাপিই নয়, অকুপেশন থেরাপি, সাইকো থেরাপিরও প্রয়োজন আছে, যা কিনা বাইরের দেশগুলোতে হয়ে থাকে। তাই এ বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তা না হলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকে।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ এ কে এম আনোয়ার উল্লাহ স্যারকে। স্ট্রোকের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার কথা ও কোন কোন জায়গায় আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে, তাও বললেন তিনি। আমরা এবার অধ্যাপক আবদুল আউয়াল রিজভীকে অনুরোধ করব এই সামগ্রিক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে।
আবদুল আউয়াল রিজভী
ধন্যবাদ। পক্ষাঘাত যার হয়, তার সমস্যাই বেশি। বিশেষ করে, তার পরিবারও ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হয় এতে। দুটি শ্রেণী এর শিকার হয়—এক হলো তরুণ শ্রেণী, আরেকটি হলো বৃদ্ধ শ্রেণী। পক্ষাঘাতের কারণ সম্পর্কে তো অনেক আলোচনা হয়েছে, তাই সেদিকে যাচ্ছি না। তবে এটুকু বলি, আমাদের দেশে ট্রোমাটিক প্যারালাইসিসের বড় কারণ উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া, বিশেষ করে গাছ থেকে। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে উঁচু দালান। এই দালান গড়ার সময় কোনো রকম নিরাপত্তাব্যবস্থা না নিয়েই অধিকাংশ কাজ চালানো হয়। ফলে এখানেও একই সমস্যা। মুটে-মজুরেরাও এ পরিস্থিতির শিকার হন। শরীরের চেয়ে দ্বিগুণ ওজন বহন করেন তাঁরা। এটা একটা বড় সমস্যা ও কারণ। চিকিৎসাক্ষেত্রে দেখা যায়, এমনটা প্রায়ই হচ্ছে। কিন্তু এর চিকিৎসা কী? আমাদের নিটোরে মোটে ৪০টি আসন আছে। আর সিআরপির আছে মাত্র ১০০টি। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে স্পাইনাল ইউনিটে মোটে ১০-১৫টি শয্যা আছে। এত মানুষের জন্য এই শয্যা অত্যন্ত নগণ্য।
আমাদের নন-ট্রোমাটিক প্যারালাইসিসের কথা বাদ দিলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে আছে এমন রোগীর সংখ্যা ১৫-২০ লাখের নিচে নয়! আমার ধারণা, প্রতিবছর ১৫-২০ হাজার মানুষ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, আমাদের নিটোরে অকুপেশন থেরাপির ওপর ৮৭ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাইরে থেকে কাউকে আনতে হচ্ছে না আমাদের। সরকার অবশ্য বিভিন্ন থেরাপির জন্য বাইরে থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে আসছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা, আমাদের চিকিৎসাসেবা খুবই সীমিত। আমাদের প্রতিটি বড় হাসপাতালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য আলাদা বিভাগ থাকা উচিত। আরেকটি জিনিস খেয়াল করতে হবে, আমাদের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা বেশ উন্নত হয়েছে। কিন্তু তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিচ্ছে না, বিশেষ করে ট্রোমাটিক প্যারালাইজডদের। এ বিষয়েও পরিবর্তন জরুরি। শিক্ষাক্রমে একটি অধ্যায়ই রাখা যেতে পারে রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয় নিয়ে। আমরা বছরে স্কুলে স্কুলে দু-চারটা বক্তৃতা দিতে পারি। রোড ট্রাফিকের ব্যাপারেও আমাদের অনেক করণীয় আছে।
আব্দুল কাইয়ুম
খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আনোয়ার উল্লাহ স্যার ও রিজভী স্যার। ঢাকার যানজট আসলেই আমাদের বড় সমস্যা। প্রথম আলো এ ব্যাপারে কাজ করছে। তার পরও বলব, আপনাদের আলোচনায় আমরা খুবই উপকৃত হয়েছি। ধন্যবাদ আপনাদের।
ইকবাল কবীর
আমরা এবার পুনর্বাসনের দিকে যাই। এ বিষয়ে এখন কথা বলবেন শহীদুর রহমান।
শহীদুর রহমান
স্ট্রোক নিয়ে অনেক ভুল ধারণা আছে। ওষুধ দিয়ে এ রোগ সারানো সম্ভব নয়। কিন্তু ফিজিওথেরাপি দিয়ে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আর কিছুক্ষণ আগেই বলা হলো বড়লোকেরাও এর চিকিৎসা ঠিকমতো পায় না। তা ঠিক আছে। অন্যদিকে গরিব রোগীদেরও সংখ্যা অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে সরকারি যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। কিছুদিন আগে অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সিআরপির আদলে সারা দেশে এ রকম পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হবে। যদি সত্যিকারের পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাই, তাহলে দরকার হবে দক্ষ লোকের। এত দক্ষ লোক কিন্তু আমাদের দেশে নেই। আমাদের সরকারি মেডিকেলগুলোতে যদি নতুন পদ তৈরি করে ফিজিক্যাল মেডিসিনে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে খুবই ভালো হবে। এখন দেশে ১৭টি সরকারি মেডিকেল আছে। বেসরকারিও আছে কতগুলো। এগুলোতেও ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ খোলা উচিত। যেহেতু এ ক্ষেত্রে আমাদের অক্ষমতা আছে, তাই আমাদের উচিত মানুষকে সামাজিকভাবে সচেতন করা। এর যে চিকিৎসা আছে, এটাও জানাতে হবে আমাদের। এই আশ্বাসটুকু জনগণকে দিতে হবে। তাদের দোরগোড়ায় যেতে হবে আমাদের। হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটি তৈরি করতে হবে এবং প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটিজে পুনর্বাসনের বিষয়টি যুক্ত করতে হবে। আমাদের হেলথ কেয়ার ডেলিভারি সিস্টেম খুব ভালো, কিন্তু এর প্রয়োগ হচ্ছে না। তাই নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের পরামর্শ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য কিছু করতে চাইলে এ কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে। আমরা যদি গোটা বাংলাদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য কাজ করতে চাই, তাহলে কমিউনিটি বেজড রিহ্যাবিলিটেশনের দরকার। সিআরপি বাংলাদেশে এই কনসেপ্ট নিয়ে এসেছে। আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ফিজিওথেরাপির ব্যাপারটিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য অনেক লোকবলের দরকার। তবুও আমাদের খুব শিগগির শুরু করা উচিত।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ শহীদুর রহমানকে। আসলে অকুপেশনাল থেরাপি, ফিজিওথেরাপি, ফিজিক্যাল মেডিসিন—এগুলোর যে টিম অ্যাপ্রোচের কথা তিনি বলেছেন, তা চালু করা দরকার।
সোহরাব হোসেন
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এরই মধ্যে আলোচিত হয়েছে। আমি পুনর্বাসন চিকিৎসার ব্যাপারে সংক্ষেপে কিছু বলব। আমরা জানি, পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগ একটি পরিবারের জন্য আঘাত। তাই চিকিৎসকেরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে। আপনারা জানেন, স্ট্রোক বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর রোগীর শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। রোগীর শরীরে ব্যথা হয়, রোগী কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং তার হাত-পা বাঁকা হয়ে আসে। রোগীর শরীরে ঘা বা শ্বাস-প্রশ্বাসেরও সমস্যা দেখা দিতে পারে। তো এ ক্ষেত্রে আমরা একটা পূর্বপরিকল্পনা করি, রোগীর বর্তমান সমস্যা সমাধান এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিই আমরা। তবে অনেক সময় ভুল ফিজিওথেরাপির ফলে রোগীর সমস্যা আরও বেড়ে যায়। তাই এ ক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি? সেন্টার অব কন্ট্রোল, মানে রোগীর বুক ও শোল্ডার জয়েন্টে কী সমস্যা আছে, তা দেখতে হবে। রোগীকে প্রেসার দিয়ে নয়, রিলাক্সের মধ্য দিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। মোট কথা, সঠিক চিকিৎসা দিতে হবে। আমাদের দেশে অনেক রোগীই জানে না, পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলে কোথায় যেতে হবে! নিটোর ও সিআরপিতে এই চিকিৎসা হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও চিকিৎসকেরা এই রোগীদের দেখেন। এ কথাগুলো সবাইকে জানতে হবে। আমরা চাই, সারা দেশে এই চিকিৎসাব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ুক, সহজলভ্য হোক। আরেকটি বিষয়ে বলার আছে, ইনস্টিটিউট বেজড পুনর্বাসন ও কমিউনিটি বেজড পুনর্বাসন নিয়ে। আমাদের দেশে কমিউনিটি বেজড পুনর্বাসন খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে গণমাধ্যম বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রাখতে পারে। তা ছাড়া ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া প্রভৃতি সমস্যা আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, সেগুলোর দিকে সবাইকে নজর দিতে হবে। নিয়মিত হাঁটাচলা করা যেতে পারে।
আরামদায়ক জীবনযাপন ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্ঘটনার ব্যাপারেও সচেতন হওয়া জরুরি। ধূমপান—এটা একদম ছেড়ে দেওয়া উচিত।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ সোহরাব হোসেনকে। এবার অকুপেশনাল থেরাপির বিষয়ে কথা বলবেন মাহফুজুর রহমান।
মাহফুজুর রহমান
অকুপেশনাল থেরাপিতে আমরা রোগীদের দৈনন্দিন কাজে স্বনির্ভর করার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু সময় এটা খুব কঠিন হয়ে যায়। কারণ, আমাদের সংস্কৃতিতে দেখা যায়, পরিবারের একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকি সবাই বেশ সাহায্য-সহযোগিতা করে। ফলে রোগীকে নিজে কিছু করতে হয় না। তবে আমরা অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা রোগীকে শুধু শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রেই সহযোগিতা করি না, পারিপার্শ্বিক আরও কিছু সমস্যারও সমাধান দিই। অনেক স্ট্রোকের রোগীই আছে, যারা পুরোপুরি সুস্থ হবে না। এটা ধরেই আমাদের অনেক সময় এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রেও আমাদের সাহায্য করতে হবে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা যদি এ ক্ষেত্রে রোগীদের সব কাজ করে দেয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর উন্নতি হয় না। রোগীর অ্যাডাপটেশনের জন্য তাই হুইল চেয়ারে একটি বিশেষ টেবিল বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যা দিয়ে রোগী নিজের কাজ নিজেই করতে পারবে। স্ট্রোক হওয়ার পর ভালো হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় রোগীদের। সেখানে কয়েক দিনের চিকিৎসা দেওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপর তারা কী করবে? আমাদের হাসপাতালগুলোতে তাদের পরবর্তী সময়ের সেবা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই গণমাধ্যমের কাছে আমাদের চাওয়া—এ ব্যাপারগুলো নিয়ে যদি কিছু করা যায়, তাহলে তা আমাদের জন্য, বিশেষ করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
আমার মনে হয়, আজকের আলোচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। কারণ, আমরা অনেকেই যা জানতাম না, অথবা অনেকেরই হয়তো ভুল ধারণা ছিল, তা ভেঙে গেছে। আপনাদের সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৪, ২০১০
Leave a Reply