স্বাস্থ্য আর মাদক দুটি বিপরীতমুখী শব্দ। স্বাস্থ্যের সর্বজনীন স্বীকৃত সংজ্ঞায় শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার কথা বলা হয়েছে, আর যেকোনো ধরনের মাদক গ্রহণের কারণে স্বাস্থ্যের এই তিনটি উপাদানই দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ২৬ জুন, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ধরা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্যের কথা ভাবুন—মাদক নয়’। কিছু মাদকদ্রব্য আছে, যার পরিমিত ও বৈধ ব্যবহার, নীরোগ স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়—যেমন মরফিন, পেথিড্রিন ইত্যাদি। আবার এগুলোর অপব্যবহার মানুষকে নিয়ে যায় অন্ধকারের পথে। এ ছাড়া অন্যান্য মাদক রয়েছে, যেগুলোর কোনো প্রয়োজনীয় বৈধ ব্যবহার নেই। সেগুলোর একমাত্র কাজ আমাদের শরীর, মন আর নৈতিকতাকে ধ্বংস করা।
যেকোনো ধরনের মাদক গ্রহণের পরপর, তা আমাদের মস্তিষ্কের ‘পুরস্কারকেন্দ্র’ বা রিওয়ার্ড সেন্টারকে উদ্দীপ্ত করে। এর ফলে একটা সাময়িক ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়। এই ভালো লাগা থেকেই তৈরি হয় শারীরিক ও মানসিক নির্ভরশীলতা। মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের (রাসায়নিক পদার্থ) তারতম্যের কারণে শরীর চায় বারবার মাদক গ্রহণ করতে; আর মন চায়, একটা ভালো লাগার অনুভূতি পেতে। এ কারণে একজন ব্যক্তি মাদকাসক্ত হয়ে গেলে, সে বারবার মাদক গ্রহণ করতে চায়। এই ভালো লাগার অনুভূতি কিন্তু ক্ষণস্থায়ী এবং কিছুদিন পর মাদক স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত দেহযন্ত্রের সব অংশকে বিকল করতে থাকে, পাশাপাশি শুরু হয় নানা মানসিক সমস্যা। চিন্তা আর আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক মাদকাসক্তি মস্তিষ্কের রোগ হিসেবে চিহ্নিত। ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজ, ১০ম সংস্করণ, যা আইসিডি ১০ হিসেবে পরিচিত, সেখানে মাদক ব্যবহারজনিত রোগগুলোকে কোড নম্বর দেওয়া হয়েছে এফ ১০ থেকে এফ ১৯ পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী পুনরাসক্তির হার অনেক বেশি হলেও, মাদকাসক্তি একটি নিরাময়যোগ্য রোগ।
মাদকাসক্তি নিয়ে বাংলাদেশে তো বটেই, এমনকি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও রয়েছে নানা মিথ ও ভ্রান্তধারণা। এসব ভ্রান্তধারণার কিছুটা অজ্ঞতাপ্রসূত, আর কিছুটা মাদকব্যবসায়ীদের প্রচারণা। প্রচার করা হয় যে মাদকাসক্তি কখনো ভালো হয় না এবং এর কোনো চিকিৎসা নেই। প্রকৃতপক্ষে, এই রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা আছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনটা বলা হয় যে মাদকাসক্তি চিকিৎসায় কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না, আসলে ডিটক্সিফিকেশনের সময়, উইথড্রয়াল সিম্পটম দূর করতে এবং মাদকনির্ভরতা কমাতে সারা পৃথিবীতে ওষুধের ব্যবহার হয়। পাশাপাশি কাউন্সিলিং ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, সবকিছুর সমন্বয়ে মাদকাসক্তির চিকিৎসা করতে হয়।
আরেকটি বড় ভুল ধারণা হচ্ছে, সিগারেট কোনো মাদক নয়; কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সিগারেট (নিকোটিন) এক ধরনের মাদক এবং গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তি শুরুর প্রথম ধাপ শুরু হয় সিগারেট দিয়ে।
আরেক দল প্রচার করে যে মাদক সেবন করলে সৃষ্টিশীল কাজ করা, গান গাওয়া, কবিতা লেখা, অভিনয়ের দক্ষতা বাড়ে—অথচ ব্যাপারটা পুরোপুরি উল্টো। মাদক গ্রহণের পরপরই সাময়িকভাবে ভালো লাগার অনুভূতি হয় বটে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে মাদক সেবনের কারণে বুদ্ধিবৃত্তি কমে যায়, কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়। অনেকেই মনে করে থাকে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি একজন অপরাধী, তার শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে অপরাধী নয়, বরং সে অপরাধের শিকার, শাস্তির বদলে তাকে চিকিৎসা দেওয়া উচিত।
আমাদের দেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে একটা ভুল ধারণা আছে যে বিদেশে পাঠিয়ে দিলে বা বিয়ে দিলে মাদকাসক্তি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এসব করে বাস্তবে মাদকাসক্তি দূর তো হয়ই না, বরং আরও নানা রকম জটিলতা বাড়ে।
বাংলাদেশে গাঁজা, তামাকসহ বেশ কিছু মাদক অবৈধভাবে উৎপাদন হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের ওপরে শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। ইদানীং শিশু-কিশোরদের মধ্যে নানা রকম মাদক সেবনের প্রবণতা বাড়ছে। ২০০৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত আরেক জরিপে দেখা গিয়েছিল, সারা দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা ৪৬ লাখেরও বেশি। আর কোনো কোনো সূত্র মতে, এই সংখ্যা ৭০ লাখের কাছাকাছি। এদের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ কিশোর ও যুবক এবং নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এক হিসাবে দেখা গেছে, মাদকের পেছনে বছরে খরচ হয় ১৭ হাজার কোটি টাকা। দেশের মোট জিডিপির ১ শতাংশ খরচ হয় কেবল ধূমপানের পেছনে।
মাদক গ্রহণের একটিও ভালো দিক নেই। স্বাস্থ্যহানি, মানসিক সমস্যা ও নৈতিক স্খলনসহ নানামুখী বিপর্যয় করে এই মাদক। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ ছোট-বড় নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্তি যদিও নিরাময়যোগ্য একটি রোগ, তবুও এর প্রতিরোধ করা চিকিৎসা করার চেয়ে সহজ। মাদকের সহজলভ্যতা হ্রাস, চাহিদা হ্রাস এবং মাদক ব্যবহারজনিত ঝুঁকি হ্রাস করে মাদকের অপব্যবহার কমানো যায়। চিকিৎসার বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে—প্রথম পর্যায়ে কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদকাসক্তির ধরন নির্ণয় করে শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা করা হয়। এরপর তার মধ্যে মোটিভেশন তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। ‘উইথড্রয়াল’ সিনড্রম ও মাদকজনিত শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা করা হয়। এরপর তার শরীর থেকে মাদকের ক্ষতিকর রাসায়নিক অংশগুলো বের করে দেওয়া হয়, এই ধাপটিকে বলা হয় ‘ডিটক্সিফিকেশন’। এ সময় রোগীর পুষ্টি নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। মাদকমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন স্বীকৃত ওষুধ নির্দিষ্ট নিয়মে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শে সেবন করা লাগতে পারে। পরবর্তী ধাপে তাকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মাদকমুক্ত থাকার প্রেরণা দেওয়া হয়। আবার পরবর্তী সময়ে সে যাতে মাদক গ্রহণ না করে, সেই বিষয়ে উপযুক্ত পরামর্শ দেওয়া হয় এবং আবার আসক্ত হওয়ার জন্য তার মধ্যে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ রয়েছে, সেগুলো থেকে দূরে থাকতে বলা হয়। পরে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য এবং নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করা হয়। পুনর্বাসনমূলক কাজ দেওয়া হয়। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রয়োজনে তাকে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ত করা হয়। ধাপগুলো যত সহজে বলা হলো, বাস্তবে এতটা সহজ নয়। প্রতিটি ধাপে থাকে নানা জটিলতা। আবার পুনরাসক্তির ঝুঁকি তো রয়েছেই। কিন্তু স্বাস্থ্যবান জাতি গঠন করতে গেলে অবশ্যই মাদকমুক্ত তরুণসমাজ প্রয়োজন। তাই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সমন্ব্বিতভাবে।
আহমেদ হেলাল
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৩, ২০১০
Leave a Reply