নিরাপদ রক্ত বলতে ক্ষতিকর ভাইরাস, প্যারাসাইট, ব্যাকটেরিয়া, মাদকদ্রব্য ও রাসায়নিক পদার্থমুক্ত রক্তকে বোঝায়। রক্তদাতাকে সুস্থ স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে এবং জটিল রোগমুক্ত থাকার ইতিহাস থাকতে হবে; রক্ত নেওয়ার পর গ্রহীতার কোনো ক্ষতি হবে না এবং রক্তদাতা রক্তদানের জন্য কোনো ঝুঁকি-ঝামেলার সম্মুখীন হবেন না। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে রক্তগ্রহীতাকে রক্ত পরিবাহিত রোগের সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখা হয়। শরীরের লাল রক্তকণিকাগুলো ৯০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে; এরপর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে ও নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়। নিয়মিত রক্ত দিলে রক্তকণিকা দ্রুত তৈরি হয় এবং রক্তকণিকা তৈরির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সতেজ থাকে। দেশে বছরে ৪ দশমিক ৫ লাখ ব্যাগ (এক ব্যাগে ৪০০-৫০০ মিলি অ্যান্টিকোয়াগুলেন্টসহ) রক্তের প্রয়োজন হয়, যার মাত্র এক লাখ ৫০ হাজার ব্যাগ জোগাড় হয় নিরাপদ রক্তদাতার থেকে; বাকি তিন লাখ ব্যাগ আসে ঝুঁকিপূর্ণ পেশাদার রক্তদাতাদের বিক্রি থেকে।
২০১০ সালের মধ্যে এশিয়ার অন্তত দুই মিলিয়ন মানুষ এইডসে আক্রান্ত হবে এবং অধিকাংশই মৃত্যুবরণ করবে। এভাবে চিকিৎসা ও আর্থসামাজিক অবস্থা বিপন্ন হবে এবং রাষ্ট্র ও পরিবারের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। বাংলাদেশে এইচআইভির প্রকোপ এখনো কম। এক জরিপে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জে পতিতা জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতি হাজারে শূন্য দশমিক ছয়জন শারীরিক মিলনকর্মী এইচআইভি/এইডসে আক্তান্ত। বিভিন্ন গবেষণামূলক জরিপে দেখা গেছে, ৭০-৭৫ শতাংশ রক্ত পাওয়া যায় পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। পেশাদার রক্তদাতাদের ২৯ শতাংশ হেপাটাইটিস-বি ও ২২ শতাংশ সিফিলিস রোগে আক্রান্ত। দেশব্যাপী একান্ত গোপন রোগ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে শারীরিক মিলনরোগীর সংখ্যা ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হলো ছাত্র। সামগ্রিকভাবে এসব পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের নিমিত্তে যেসব রোগ স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে সেগুলো হচ্ছে—
এইচআইভি-১; এইচআইভি-২ (এইডস)
হেপাটাইটিস-বি
হেপাটাইটিস-সি
সিফিলিস
ম্যালেরিয়া
দুর্ঘটনা, বড় অস্ত্রোপচার, রক্তশূন্যতা, প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ, পুড়ে যাওয়া, ক্যানসার, হেমোফিলিয়া, থেলাসেমিয়া ও অন্যান্য রক্ত-রোগের জন্য প্রয়োজন হয় রক্তের এবং এ প্রয়োজন মেটানোর জন্য দরকার নিরাপদ রক্ত। যিনি রক্ত দান করবেন, তিনি শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে সুস্থ থাকবেন। তিনি সমকামী বা বহুগামী হতে পারবেন না। দুবার রক্তদানের মাঝামাঝি তিন মাস অতিবাহিত করতে হবে। একজন রক্তদাতার যেসব গুণ ও শর্তাবলিসম্পন্ন হতে হবে সেগুলো হচ্ছে—
রক্তদাতার দেহের ওজন সর্বনিম্ন ৪৫ কেজি হবে।
রক্তদাতার বয়স অবশ্যই ১৮ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত থাকতে হবে।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১২ গ্রাম/ডিএল বা তার বেশি থাকতে হবে।
নাড়ির গতি ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে।
ওষুধ সেবন ব্যতীত রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় থাকতে হবে।
শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত ব্যাধিমুক্ত থাকবে।
চামড়ার যে স্থান থেকে সুঁই ঢুকিয়ে রক্ত নেওয়া হবে, সেই স্থান চর্মরোগমুক্ত থাকতে হবে।
বাহ্যিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নির্ণয় করে নিতে হবে যে রক্তদাতা রক্তবাহিত রোগমুক্ত।
রক্তদাতার বাহুর বা নিম্ন বাহুর সম্মুখভাগ সুঁইয়ের আঘাতজনিত চিহ্নমুক্ত থাকতে হবে; কেননা সুঁইয়ের আঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিরা পেশাদার রক্তদাতা বা স্বপ্রণোদিত ব্যথা নিবারণ গ্রহণকারী নেশাগ্রস্ত বলে চিহ্নিত।
অণুজীব সংক্রমণের উদাহরণ কম হলেও যদি অসাবধানতার কারণে তা সংঘটিত হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত মারাত্মক। তাই লক্ষ রাখতে হবে, ত্বকের যে স্থানের শিরা থেকে রক্ত নেওয়া হবে, সেই স্থানের কেন্দ্র থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার এলাকা পর্যন্ত জীবানুধ্বংসী দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। সুঁই শিরায় প্রথম প্রচেষ্টায়ই ঢোকাতে হবে। রক্ত পরিমাণমতো নেওয়ার জন্য রক্তদাতাকে আরামদায়ক ডোনার চেয়ারে বা মাথার নিচে বালিশ দিয়ে শুইয়ে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে একটি আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে। রক্তদান শেষ হওয়ার পর রক্তদাতাকে কিছুক্ষণ যত্নসহ নজর দিতে হবে এবং অন্তত পাঁচ মিনিট চেয়ার বা বিছানায় শুইয়ে রাখতে হবে, রক্তদাতা সম্পূর্ণ সুস্থবোধ করলেও। কারণ এই পাঁচ মিনিট তাঁকে গিডিনেসের মতো একটি বৃহৎ প্রতিক্রিয়া থেকে সুরক্ষা করে। তারপর আরও ১০ মিনিট একটি রিফ্রেশমেন্ট কক্ষে আরাম-আয়েশে তরল পানীয় গ্রহণ করবে। লক্ষ রাখতে হবে, শিরায় সুঁই ঢোকানোর স্থানে কোনো রক্তক্ষরণ বা চামড়ায় বিক্রিয়া হচ্ছে কি না এবং হলে সেমতে ব্যবস্থা নিতে হবে। খুব বেশি ব্যথা অনুভূত হলে বরফ লাগাতে হবে। রক্তদানের দিনে বেশি করে তরল পানীয় পান করতে হবে এবং বেশি পরিশ্রমী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। গিডিনেস, কনভালশন, বমি, মাংসপেশিতে সংকোচন (টিটেনি), হেমাটোমা, একজিমেটাস স্কিন রি-অ্যাকশন ও সিনকোপের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কদাচিৎ লক্ষ করা যায় বিধায় সামগ্রিক রক্তদানের সেশনটি একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত চিকিৎসক দলের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক। তাই নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করে জীবন রক্ষার জন্য সমাজের সর্বস্তরের, সব ধর্মের, সব পেশার নারী-পুরুষের কাছে ঐকান্তিক আহ্বান—
১৮ থেকে ৬০ বছরের সব সুস্থ নারী-পুরুষ যাঁদের ওজন ১০০ পাইন্ড বা তার বেশি, তাঁরা প্রতি চার মাস অন্তর নিয়মিত রক্তদান করুন।
পরিচিত ব্যক্তিদের রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করুন।
স্বেচ্ছায় রক্তদাতা তৈরির আয়োজনে সক্রিয় সহযোগিতা করুন।
স্ক্রিনিং ছাড়া রক্ত নেবেন না, এমনকি আপনজনের হলেও নয়, কারণ তার রক্তেও সুপ্ত থাকতে পারে সংক্রামক ঘাতক ব্যাধির জীবাণু।
কখনো পেশাদার রক্তদাতার রক্ত কিনবেন না।
রক্ত দিলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না এবং বোন ম্যারো নতুন রক্তকণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়।
রক্তদান জীবনদান, তাই নিয়মিত রক্তদানের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
উপাধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৬, ২০১০
Leave a Reply