প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক
কিডনি রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিস্থাপন: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত
যাঁরা অংশ নিলেন
অধ্যাপক হারুন অর রশীদ
প্রেসিডেন্ট, কিডনি ফাউন্ডেশন
ডা. হাবিবুর রহমান
সহযোগী অধ্যাপক, রেনাল ট্রান্সপ্লান্টেশন ইউনিট
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক রফিকুল আলম
চেয়ারম্যান, নেফ্রোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম
চেয়ারম্যান, ইউরোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ফিরোজ খান
পরিচালক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি
অধ্যাপক জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া
বিভাগীয় প্রধান, ইউরোলজি
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি
ডা. কাজী রফিকুল আবেদীন
সহকারী অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি
ডা. পিনাকী ভট্টাচার্য্য
মতিউর রহমান
সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুলকাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
ডা. ইকবাল কবীর
বিভাগীয়সম্পাদক, স্বাস্থ্যকুশল, প্রথম আলো
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের বিষয় হচ্ছে কিডনি রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিস্থাপন: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত। আপনারা হয়তো দেখেছেন, প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক বিষয়, যেটা দেশ পরিচালনার বিষয় নিয়ে। পাশাপাশি আবার স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা—এ ধরনের কতগুলো ছোট ছোট বিষয় নিয়েও আমার গোলটেবিল বৈঠক করি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। পলিসি মেকারদের করণীয়গুলো সামনে নিয়ে আসা।
ইকবাল কবীর
আমরা দুটো উদ্দেশে এ আয়োজন করেছি। একটা হচ্ছে, কিডনি রোগ প্রতিরোধ করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। আরেকটা হচ্ছে, বাংলাদেশেও যে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন হচ্ছে, সে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা। শুরুতেই ডা. হারুন অর রশিদ এ বিষয়ে সামগ্রিক কিছু বলবেন।
হারুন অর রশীদ
আমি মনে করি, কিডনি রোগ সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষজন খুব বেশি সচেতন নয়। এই সচেতনতাটা তৈরি করা সম্ভব পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৭০ সাল থেকে এ দেশে কিডনি রোগের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। তখন কিডনি রোগটাকে ঠিক এভাবে বিবেচনা করা হতো না। গত ১০ বছর থেকে কিডনি রোগকে একটা আলাদা অসংক্রামক ব্যাধি হিসেবে ধরা হচ্ছে। এও বলা হচ্ছে, এটা আগামী দশকে একটা সাইলেন্ট এপিডেমিক হিসেবে পৃথিবীজুড়ে বিস্তার লাভ করবে। বিশ্বের কিডনি রোগের বিভিন্ন কর্ণধারের গবেষণায় এটা বেরিয়ে এসেছে। ১০ বছর আগে আমরা সাভারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক হাজার রোগীর ওপর একটা সমীক্ষা করেছিলাম। তখন আমরা দেখেছিলাম, ১০ শতাংশ লোক হাই ব্লাড প্রেসারে ভোগে, আড়াই শতাংশ ডায়াবেটিসে ভোগে আর আড়াই ভাগ লোকের প্রস্রাব পরীক্ষা করে অ্যালবুমিন পাওয়া যায়। তখন আমরা দেখেছিলাম, বাংলাদেশের ৭০ থেকে ৮০ লাখ লোক কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভোগে। এবং প্রায় ২০ হাজার লোকের কিডনি প্রতিবছর অকেজো হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এর ১০ বছর পর আমরা দু-তিনটা সমীক্ষা করি। তখন আমরা দেখেছি, ডায়াবেটিসের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ শতাংশে পৌঁছেছে, ব্লাড প্রেসারের সংখ্যা বেড়ে সাড়ে ১৮ শতাংশ হয়েছে আর ছয় শতাংশ লোকের প্রস্রাব দিয়ে অ্যালবুমিন যাচ্ছে। অর্থাৎ যাদের অ্যালবুমিন যাচ্ছে, তাদের সবারই কিডনি রোগ হয়ে গেছে। এবং অন্যদেরও কিডনি রোগ হওয়ার আশঙ্কা আছে। এখন বাংলাদেশে কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ। অতএব বলা যায়, বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশের মতো একটা দেশে কিডনি রোগ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আমাদের দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ জানেই না যে তাদের প্রস্রাবে অ্যালবুমিন আছে বা তার হাই ব্লাড প্রেসার আছে। জানে না বলেই কিন্তু তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না। যখন কোনো লক্ষণ শুরু হয়, তখনই তারা চিকিৎসার জন্য আসে। তখন তার প্রায় ৭০ ভাগ কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। তখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে হয়। দুনিয়াজুড়ে এখন বলা হচ্ছে, যেহেতু কিডনি রোগ ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনের একটা প্রধান কারণ এবং নেফ্রাইটিস আরেকটা কারণ। সে জন্য এ রোগকে প্রতিরোধ করার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যখন রোগী একবার ডায়ালাইসিস করাতে যায়, তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমেরিকায় সবাই ডায়ালাইসিস করাতে পারছে। তারা সামনের বাজেটে প্রায় ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করবে শুধু এই ডায়ালাইসিসের জন্য। আর আমাদের সরকারের গোটা স্বাস্থ্য বাজেট হচ্ছে জিএনপির দেড় শতাংশ। ফলে আমরা কোনো দিকেই যেতে পারছি না। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের প্রায় চার শতাংশ মানুষের ডায়ালাইসিস করার সামর্থ্য আছে। বাংলাদেশে এখন ৪২টি ডায়ালাইসিস সেন্টার আছে আর আটটি কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন সেন্টার আছে। এই সেন্টারগুলো মাত্র তিন হাজার নতুন রোগীকে ডায়ালাইসিস দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে, ডায়ালাইসিস ও ট্রান্সপ্লান্টেশনকে সম্প্রসারণ করা। আমরা চেষ্টা করছি ডব্লিউএইচওর তালিকায় কিডনি রোগকে রাখার জন্য।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ হারুন স্যারকে। এবার অনুরোধ করছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রফিকুল আলমকে এ বিষয়ে কিছু বলার জন্য।
রফিকুল আলম
সারা দুনিয়ায় সবাই এখন কিডনি রোগটাকে সাইলেন্ট এপিডেমিক হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছে। আমি আশা করি, ডব্লিউএইচও ও অন্য সংগঠনগুলোও এ সত্যটা মেনে নেবে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে এই চিকিৎসার কোনো রকম সাপোর্ট সিস্টেম নেই বললেই চলে। আমাদের দেশের জন্য এই চিকিৎসা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে শতকরা ৪৫ ভাগ কিডনি রোগ হচ্ছে নেফ্রাইটিস থেকে। বেশির ভাগ নেফ্রাইটিস যদি প্রথম অবস্থায় ধরা পড়ে, সেগুলোর বিভিন্ন রকম অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা যায়। অর্থাৎ আপনি ক্রনিক কিডনি ডিজিজ প্রিভেন্ট করতে পারছেন। এ জন্য অবশ্য ডায়াবেটিসের উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ দরকার। হেলথ ইন্স্যুরেন্স যদি আমরা চালু করতে পারি, এর মাধ্যমে আমরা ডায়ালাইসিস চিকিৎসার একটি অংশের সংস্থান করতে পারি। ব্যাপক সচেতনতা যদি আমরা সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে হয়তো অনেকেই এগিয়ে আসবেন। এতে ব্যয়টা অনেক কমে যাবে। এ ছাড়াও কিডনি রোগ প্রতিরোধের প্রচলিত ধারাগুলোও আমাদের বেগবান করা জরুরি।
ইকবাল কবীর
আলোচনা ভালোর দিকে এগোচ্ছে। আমরা আমাদের সফলতার খবরও শুনতে চাই। আমাদের এখানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুর রহমান আছেন। এবার তিনি বলবেন।
হাবিবুর রহমান
প্রথমেই প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য। আমরা আলোচনায় দেখলাম, কিডনি ফেইলড হয়ে যাওয়ার পরপর আমাদের হাতে যা চিকিৎসা থাকে, তা হলো ডায়ালাইসিস। আরেকটা হলো কিডনি প্রতিস্থাপন করা, যাকে আমরা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন বলি। আমাদের দেশে দুই যুগ ধরে আমরা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করে আসছি। প্রথম দিকে আমাদের অভিজ্ঞতা কম ছিল। আমাদের রেজাল্টও তেমন একটা ভালো ছিল না। কিন্তু পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপনের যে রেজাল্ট, পৃথিবীর অন্যান্য যে ভালো সেন্টার আছে, সেগুলোর মোটামুটি কাছাকাছি। যদিও আমাদের লোকবল, আমাদের সুযোগ-সুবিধা ওদের তুলনায় অনেক অনেক কম। তার পরও আমরা অনেক দূর এগিয়ে আছি। আমাদের একটা দুঃখের বিষয় যে আমাদের এই সফলতার কথা ফলাও করে প্রচার হয়নি। এ দেশে মোট আটাট সেন্টারে আমরা কিডনি প্রতিস্থাপন করছি সফলতার সঙ্গে। আমাদের এখন উদ্দেশ্য হবে, প্রথম আলো বিশেষ করে মিডিয়ার কাছে আমাদের একটা আবেদন থাকবে এই জিনিসগুলো তুলে ধরর। জনগণের এই চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বাইরে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার যে অনেকে জানেও না, কিডনি প্রতিস্থাপন করার পর তাকে লাইফ লং একটা চিকিৎসার আওতায় আসতে হবে। তাকে পরবর্তী সময়ে অনেক ওষুধ খেতে হবে। এই কাউন্সেলিংটা হয় না। বাইরে গিয়ে ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করার পর সে চলে এল। চলে আসার পর আবার বারবার যেতে হবে। প্রতিবারই তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। একসময় সে ফলোআপে যেতে পারছে না। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা খুব কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি এবং আমি বলব, এ ব্যাপারে সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভ তো হয়ই না, বরং লোকসান হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক লাখ টাকার মতো আমরা একটা বাজেট নিই। যেটা বাইরে গেলে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। কিডনির যে প্রতিস্থাপন, এটা খুব জটিল একটা ব্যাপার। কিডনি খুব সেনসিটিভ ইস্যু। এখন জনগণ সচেতন হচ্ছে। এখন ডোনারের অভাব আস্তে আস্তে দেখা দিচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য যেসব রোগী আইসিইউতে মারা যায়, তার থেকে আমরা কিডনিটা নিতে পারি। এই সচেতনতাটা জনগণের মধ্যে আনতে হবে। তাহলে আমরা এ ব্যাপারে আরও সফল হব। জরুরি বিভাগে যেসব রোগী বেওয়ারিশ হয়ে যাচ্ছে, এদের কাছ থেকেও আমরা কিডনি নিতে পারি। ফলে ডোনারের যে স্বল্পতা আমাদের, তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারি। আগে আমরা পেট কেটে কিডনিটা নিতাম। এখন আরও উন্নত ব্যবস্থা চলে এসেছে। যা মাত্র চারটা ফুটো করে আমরা কিডনিটা নিতে পারি। আমরাও আশা করি, ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে আমরা এটাও করতে পারব। ফলে লিভিং ডোনার কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবে। আমাদের বর্তমান যে লোকবল আছে, তা দিয়েই আমরা প্রতি সপ্তাহে একটা করে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করছি। আমরা প্রতি সপ্তাহে দুটি করে করার মতো ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন আমাদের অনেক রোগী অপেক্ষমাণ তালিকায় আছে। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণক্ষমতা অনেক কম থাকায় অনেক প্রস্তুত রোগীকেও আমরা সময়ের অভাবে ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারছি না। আর ভবিষ্যতে আমরা ব্যয়টা কমিয়ে আনতে পারব। আমরা যদি সেন্টারগুলো বাড়াতে পারি, আমার মনে হয় আর বাইরে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা যে খরচ হচ্ছে, এ থেকে আমরা মুক্তি পাব এবং জনগণ উপকৃত হবে।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ। আমাদের এখানে অধ্যাপক জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া আছেন। তিনি বাংলাদেশ কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজিতে এই ট্রান্সপ্লান্টেশনের কাজে জড়িত আছেন। সামগ্রিকভাবে এর সাকসেস রেটটা কী? আমরা তো শুনলাম, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, আপনাদের ওখানেও হচ্ছে। এ বিষয়টা যদি একটু আলোকপাত করেন।
জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া
এ রকম একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য মতিউর রহমানকে ধন্যবাদ জানাই। প্রথমেই বলতে চাই, কিছু কিছু ডিজিজ আছে, যেগুলো ইউরোলজিক্যাল ডিজিজ। যেমন পাথর। পাথর নিয়ে অনেক সময় দেখা যায়, রাগীরা এলে আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি এত দিন ধরে বসে আছেন কেন? তারা জবাব দেয়, স্যার, ব্যথা তো হয় না। এ রকম কতগুলো ডিজিজ আছে যেমন—পাথর, টিউমার, ক্যানসার, প্রোস্টেট গ্লান্ড বেড়ে যাওয়া। এ ছাড়া মা-বোনদের ব্যাপারে আমি বলব, আমাদের মহিলা ইউরোলজিস্ট নেই। হয়তো কিছু দিনের মধ্যে আমরা তা পেয়ে যাব। তারা সহজেই একটা পুরুষ ডাক্তারের কাছে আসতে চায় না। হয়তো দেখা গেল, তার প্রস্রাবের রাস্তাটা একটু সরু হয়ে আছে। সে কষ্ট করে প্রস্রাব করে। কিন্তু সে আসে না। যখন এল তখন দেখা গেল, কিডনি ড্যামেজ করে চলে আসে। অথচ আমাদের কাছে এলে এই চিকিৎসা পাঁচ মিনিটও লাগে না। এ ধরনের কিছু কিছু রোগ যেগুলো প্রিভেন্ট করা যায়, আমার মনে হয় এগুলো মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার আমাদের দেশে একটা ইনস্টিটিউট তৈরি করেছে, যেটার নাম ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি। ২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা বছরে প্রায় তিন হাজার অপারেশন করেছি। ট্রান্সপ্লান্ট করছি দেড় বছর ধরে। এখানে খুব কম খরচে চিকিৎসা হয়। যেমন কিডনির পাথর ভাঙা। এ জন্য যদি কেউ বাইরে যায়, অনেক সময় ৬০ হাজার টাকার মতো লাগে। আর আমাদের এখানে লাগে পাঁচ হাজার টাকা। এরপর আবারও যদি ওই একই চিকিৎসায় তিনি আমাদের কাছে আসেন, তখন কোনো টাকা লাগে না। এ বিষয়গুলো প্রচার করার জন্য আমি বেশি বলব।
হারুন অর রশীদ
১৯৮২ সাল থেকে আমাদের দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, এর ফলাফল অত্যন্ত ভালো। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, যার টাকা আছে, তার ডোনার নেই আর যার ডোনার আছে তার টাকা নেই। সমাজের প্রতি রাষ্ট্র ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বেশ দায়িত্ব আছে। আর স্কুল হেলথের ক্ষেত্রে শুধু স্কুলে নয়, আমাদের দেশের মা-বোনেরা যখন শপিংয়ে যায়, দেখবেন আমাদের দেশে মার্কেটগুলোয় কোনো ভালো টয়লেট নেই। এটা নারীদের ইউরিন ইনফেকশনের একটা অন্যতম কারণ। আরেকটা বিষয় হলো, আমাদের ব্রেন ডেথ কোনো ডোনার নেই। আমরা যা পাই, তাঁরা হলেন লিভিং ডোনার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই ব্রেন ডেথ ডোনার আছে। এতে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই।
কাজী রফিকুল আবেদিন
আমি এই আলোচনার শেষ কথাটি দিয়ে শুরু করতে চাই। বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষ তাদের জন্যই আমাদের চিকিৎসা। আমরা শুধু চিকিৎসা দিয়ে থাকি। আমাদের জিডিপির এক দশমিক পাঁচ ভাগ মাত্র ব্যয় হয় চিকিৎসা ক্ষেত্রে। আমরা বাজেটে একজনের চিকিৎসার জন্য যে টাকা পাই তা হলো ১.০৭ টাকার মতো। এ দেশের জনসংখ্যার বিরাট অংশ শুধু দারিদ্র্যপীড়িত নয়, প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কুসংস্কারের বেড়াজালে এদের জীবন অতিষ্ঠ। এই জনগোষ্ঠী এখনো আধুনিক চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে। আমরা তাদের জন্য রাষ্ট্রই বলি, সামাজিক সংগঠনই বলি আর আমাদের ব্যক্তি উদ্যোগের কথাই বলি না কেন, কেউই আজ পর্যন্ত তাদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক অথবা চিকিৎসার যে পরিধি ও নিরাপত্তাবলয়, তা তৈরি করতে পারেনি। এ রকম একটা অবস্থায় আমরা কিডনি রোগ ও প্রতিস্থাপন নিয়ে কথা বলব। কিডনি অসুস্থতার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বলতে চাই, এ দেশে কিডনি অসুস্থতার মূল কারণ হচ্ছে বহুমূত্র, উচ্চরক্তচাপ ও কিডনিতে প্রদাহ। এর বাইরেও কিছু অসুস্থতা আছে, যা কিডনিকে অসুস্থ করে, জাতিকে অসুস্থ করে এবং চিকিৎসাব্যয়টা প্রায় অসম্ভবের জায়গায় দাঁড় করায়।
আমাদের দেশে এখন অনেক পুষ্টিকর খাদ্যের চেয়ে ওষুধ অনেক সস্তা ও সহজলভ্য। আরেকটা কথা বলা দরকার, তা হলো খাদ্যে বিষক্রিয়া বা খাদ্যে ভেজাল। এটাও কিডনি অসুস্থতার একটা কারণ। এসব কারণ কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য। উচ্চরক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগও কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আর এ জন্য বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতা। আমার কাছে মনে হয়, যেসব কারণে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয় তার শতকরা ৮০ ভাগই প্রতিরোধযোগ্য এবং এটা প্রতিরোধ করে আমরা আমাদের দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে কিডনি বিকল থেকে রক্ষা করতে পারি। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য আমাদের কিডনি দরকার। এই কিডনি আমরা পাই জীবিত মানুষের কাছ থেকে, আরেকটি পাই আমরা স্নায়ুবিকভাবে মৃত মানুষের কাছ থেকে। বর্তমান সরকার ১৯৯৯ সালে তাদের শাসন আমলে একটি আইন করেছে। আইনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথেষ্ট যৌক্তিক। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করার জন্য এ আইনটি করা হয়েছিল। আমি আশা করব, এ আইনটি যদি গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, তাহলে মানুষের সচেতনতাটা বেড়ে যাবে। ব্রেন ডেথের কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার আমাদের সমস্যা হলো, আমরা একেবারে ভৌত অবকাঠামো তৈরি করতে পারিনি। এ জন্য দেশব্যাপী একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যার কিডনি লাগবে এবং যে কিডনি দিতে চায়, তাদের ডেটাগুলো এন্ট্রি করা থাকে। পরে মিলে গেলে তাদের খোঁজ দেওয়া হয়।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ ডা. কাজী রফিকুল আবেদীনকে। এবার ডা. পিনাকী ভট্টাচার্যকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।
পিনাকী ভট্টাচার্য
হারুন স্যারের চাপাচাপিতে প্রথম ডায়ালাইসিস মেশিনটা এখানে আনা হয়েছিল। এটা এনে তিন বছর ধরে আমরা বাংলাদেশের মানুষকে সেবা দিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল যে এটা আমাদের প্রোফিট সেন্টার হবে না। তাই আমরা অনেক সুলভে এটাকে সরবরাহ করছি। কিন্তু পরে সরকার এটার ওপর ভ্যাট চালু করে। যেটা এখনো আছে। এটা কিন্তু আসলে ঠিক নয়। এখন CAPD-এর মাধ্যমেও ডায়ালাইসিস করা যায়। এর মাধ্যমে পেটে একটা টিউব বসিয়ে দিতে হয়। এটা রোগী বাসায় বসে করতে পারে। আমার কাছে মনে হয়, যাঁরা প্রাইমারি লেভেলে কিডনি চিকিৎসা দেন, তাঁরাও যদি সচেতন হন, তাহলে রোগীদের আর্থিক বোঝা অনেকটাই কমে যাবে।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ। এবার আমি অনুরোধ করব অধ্যাপক ফিরোজ খানকে কিছু বলার জন্য।
ফিরোজ খান
প্রথম আলো বদলে দেওয়ার কথা বলে। পরিস্থিতি বদলানোটাই বড় কথা। সব কথা প্রায়বলা হয়ে গেছে। আমাদের ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন আউটডোরে ৩০০-৪০০ রোগী আসে। তাই কিডনি রোগ প্রতিরোধ করাটা খুবই যুগোপযোগী। যেমন চুলকানি থেকে যে ঘা হয়, সেই ঘা থেকে আবার কিডনি ডিজিজ হতে পারে। এসব রোগ কিন্তু আবার সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।
ইকবাল কবীর
এবার অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলামকে বলার জন্য অনুরোধ করছি।
আনোয়ারুল ইসলাম
কিছু কিছু ইউরোলজিক্যাল ডিজিজ আছে, যেটার আমরা সঠিক সময়ে যদি চিকিৎসা করি, তাহলে কিডনিকে পুরোপুরি নষ্ট হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারি। জন্মগত ত্রুটি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জন্মগত ত্রুটিগুলোর সঠিক সময়ে যদি আমরা চিকিৎসা করি, তাহলে আমরা জটিল কিডনি রোগ প্রতিরোধ করতে পারব। ইউরোলজিক্যাল ডিজিজ থেকেও কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে। বয়স্কদের প্রস্রাবে বাধাজনিত কারণে এই কিডনি রোগ হতে পারে। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের মধ্যে বেশ কিছু ইস্যু আছে। আমরা যদি ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে চাই, তাহলে কিন্তু আমাদের দায়িত্বটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এর মধ্যে আমাদের আর্থসামাজিক ও শিক্ষাগত সমস্যা জড়িত। তাই আমাদের সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। আর এ ধরনের চিকিৎসার জন্য ফান্ড গঠন করতে হবে। তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক দায়িত্বটা অনেক। ব্রেন ডেথের ধারণাটা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করা যেতে পারে। পুরোটাই আমাদের উদ্যমের ব্যাপার। ডায়ালাইসিস ও ট্রান্সপ্লান্টেশনের মাঝামাঝি আরেকটা পন্থা আছে। আর তা হলো সরাসরি ট্রান্সপ্লান্টেশন। এর মাধ্যমে রোগীদের অর্থনৈতিক খরচটা অনেক কমে আসবে। এতে ডায়ালাইসিসের আর্থিক কষ্টটা লাঘব হবে।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলামকে।
ফিরোজ খান
আগে কিন্তু কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার জন্য সার্জন পাওয়া যেত না। আর এখন শুধু কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্যও সার্জন পাওয়া যায়। এটা আমাদের জন্য অনেক ভালো একটা দিক।
ইকবাল কবীর
আমরা এখানে একটা সামগ্রিক আলোচনা পেলাম। আমি আশা করব, এ সরকার বিষয়টির প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেবে। আমি আবারও হারুন অর রশীদ স্যারকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।
হারুন অর রশীদ
আমরা প্রায় এক বছরধরে চেষ্টা করছিলাম, বাংলাদেশে ট্রান্সপ্লান্টেশন কীভাবে করা যায়। আমাদের শরীরে দুটো কিডনি ছাড়াও লিভার, হার্ট এগুলো ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে এ ব্যাপারে বর্তমান চিকিৎসকদের যথেষ্ট ধারণা আছে। তাই আমরা মনে করছি, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা খুবই জরুরি। আমাদের যদি পর্যাপ্ত পরিবেশ এবং কিডনি দেওয়া যায়, তাহলে আমরা এ প্রক্রিয়া এখনই চালু করতে পারি। কিন্তু এর জন্য লাগবে ব্রেন ডেথ কিডনি ও ব্রেন ডেথ কমিটি, যে কমিটিটা এখনো আছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং আমরা আশা করি, টিম যদি সেভাবে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়, তাহলে মরণোত্তর ট্রান্সপ্লান্টেশন আমাদের বাংলাদেশে সম্ভব। এবং লিভার ও হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট এর সঙ্গে করা যাবে। আমরা এখন চাইছি যে জনসাধারণ এ বিষয়টা ব্যাপকভাবে জানুক। কিডনি রোগ প্রতিরোধে চল্লিশ পেরুলেই প্রস্রাবে অ্যালবুমিন মাপুন, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস চেক করুন।
মতিউর রহমান
আপনাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করার জন্য। আপনারা যে প্রস্তাবগুলো করলেন, আমরা আমাদের পত্রিকার মাধ্যমে সেগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করব। এটা খুব সুখের বিষয় যে বাংলাদেশে সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। কিডনি বিষয়ে জনসচেতনতামূলক লেখা কিংবা দৃষ্টি আকর্ষণী বিজ্ঞাপনের মতো কিছু তৈরি করে দিলে আমরা স্বাস্থ্যপাতাসহ প্রথম আলোতে ছাপার ব্যবস্থা করব। প্রথম আলো থেকে আমরা বদলে দেওয়ার কথা বলি, আসুন, সবাই মিলে আমরা জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার কাজ করি। অধ্যাপক হারুন এবং আপনাদের উদ্যোগের পাশে আমরা সব সময়আছি। আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।
আব্দুল কাইয়ুম
আমরা আলোচনাটা শেষ করতে চাই। আপনাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৯, ২০১০
Leave a Reply